বাংলার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগ পর্বে বাংলার স্থাপত্য শিল্পে ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছিল, কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় প্রাচীন বাংলায় স্থাপত্যের অধিকাংশই যেমন আমরা সরাসরি প্রত্যক্ষ করতে পরিনি, মধ্যযুগের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। এ যুগের স্থাপত্যকলায় গুণগত পরিবর্তন এসেছিল, তাতে প্রতিকূল প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেশকিছু সংখ্যক স্থাপত্য টিকে আছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার সংরক্ষণের মধ্য দিয়েও টিকিয়ে রাখা গেছে কিছু সংখ্যক স্থাপত্য। তবে যেসব স্থাপত্য নিদর্শন এখনো টিকে আছে, তার অধিকাংশই ধর্মীয় ইমারত। এর কারণও সুস্পষ্ট। ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে ইমারতগুলো পরিত্যক্ত হলেও এর সংরক্ষণে বংশপরম্পরায় অনেকেই ছিলেন সোচ্চার, আবার যেগুলো পরিত্যক্ত হয়েছিল, তাও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় এর উপাদান উপকরণ-উপকরণ অপহূত বা লুণ্ঠিত হয়নি। অন্যদিকে গৌড়-লক্ষৌতি ও পাণ্ডুয়া-ফিরুজাবাদের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, ব্যক্তিগত ইমারত তৈরির জন্য কীভাবে পুরনো সেক্যুলার ইমারতগুলো অপহূত বা লুণ্ঠিত হয়েছে।
বাংলায় মুসলিম সমাজ বিকাশের পেছনে শাসকশ্রেণী, সুফি সাধক, মুসলিম পণ্ডিত শ্রেণী এবং পারিপার্শ্বিকতার সমন্বিত প্রভাবই কমবেশি ভূমিকা রেখেছে। এ সমন্বিত প্রচেষ্টা মুসলমান সমাজ বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছে। আর এরই প্রতিফলন হিসেবে স্থাপন হতে থাকে মসজিদ, মাদ্রাসা (মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান), খানকাহ (সুফি সাধকদের আস্তানা ইত্যাদি। মুসলমান সমাজের সঙ্গে উপাসনাগৃহ মসজিদের সম্পর্ক ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কারণ প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় মুসলমানদের বাধ্যতামূলক ধর্মীয় বিধান। মসজিদ ছিল মুসলমানদের সালাত বা প্রার্থনাগৃহ।
মধ্যযুগে প্রায় পাঁচশ বছর (তের থেকে আঠার শতক পর্যন্ত) বাংলা যথাক্রমে সুলতানি ও মোগল শাসনভুক্ত ছিল। সুলতানি শাসন পর্বের ২০০ বছর (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রি.) পর্যন্ত ছিল বাঙালির স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বহির্ভারতীয় অবাঙালি মুসলমান সুলতানরা এ সময় দিল্লির মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাংলাকে স্বাধীনতার মর্যাদা দেন। ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাঁর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, সে সময় থেকে সুলতানি যুগের সূত্রপাত। ১৫৭৬-এর পর মোগল আক্রমণ শুরু হয় ১৬০৮, সঙ্গে মোগলদের প্রদেশে পরিণত হয়।
মুসলমানরা তাদের শৌর্য-বীর্যের প্রমাণ দিতে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের জন্য একটি বড় এবং শক্তিশালী ইমারত নির্মাণের প্রয়োজন অনুভব করে। পাশাপাশি শাসকরা তাদের পরিবার-পরিজন ও নিজেদের সমাধিসৌধও নির্মাণ করে। এভাবে ১৩৩৮ থেকে ১৫৭৬ পর্যন্ত স্বাধীন সুলতানি যুগ অতিক্রম করে বাংলা দিল্লির মোগল শাসনের আওতায় আসে। মোগলরাও ইসলাম ধর্মাবলম্বী, সুতরাং তাদের প্রেরিত প্রতিনিধিরাও এ দেশে প্রচুর ইমারত নির্মাণ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সুলতানি ও মোগল স্থাপত্যের মধ্যে বেশকিছু স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান। দৃশ্যত এসব স্বাতন্ত্র্য সময়, রুচি, উপকরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি নিয়ামক দ্বারা পরিবর্তিত হয়। রাজনৈতিক কারণ হলো, বাংলা তার স্বাধীন সত্তা হারিয়ে মোগল আমলে একটি প্রদেশে পরিণত হয়। বিভিন্ন স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলার বিভিন্ন সুলতানি ও মোগল মসজিদের মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্য খুঁজে পাওয়া যায় তা হলো :
নির্মাণ