বিদ্যুতে ভর্তুকির ৮১ শতাংশই ক্যাপাসিটি চার্জ

আবু তাহের

ছবি : বণিক বার্তা

উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রি করায় প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আর্থিক ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি)। এ ঘাটতি মেটাতে সংস্থাটিকে প্রতি বছর ভর্তুকি হিসেবে বড় অংকের অর্থ দিচ্ছে সরকার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ৪০৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। অন্যদিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া বাবদ (কাপাসিটি চার্জ) ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি। তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিদ্যুৎ খাতের জন্য দেয়া ভর্তুকির ৮১ শতাংশই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের এ প্রাক্কলন যদিও বিপিডিবির সাময়িক হিসাব। সংস্থাটির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, যখন এ প্রাক্কলন করা হয়েছিল, তখন গ্যাসভিত্তিক বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসেনি। ফলে অর্থবছর শেষে এ বাবদ ব্যয় প্রাক্কলিত অর্থের বেশি কিংবা কমও হতে পারে।  

দেশে গ্যাসভিত্তিক বৃহৎ দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্প্রতি উৎপাদনে এসেছে। নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে সামিট ও ইউনিক গ্রুপের এ দুটি কেন্দ্রের সক্ষমতা ১ হাজার ১৬৭ মেগাওয়াট। ওই এলাকায় রিলায়েন্সেরও একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে। কেন্দ্রটির সক্ষমতা ৭১৮ মেগাওয়াট, যা যুক্ত হলে কেন্দ্র ভাড়া বাবদ ব্যয় আরো বেড়ে যাবে বিপিডিবির।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতে ভর্তুকি হিসাবে প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হয় তার বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ। অন্যদিকে বছরে চার ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে আগামী তিন বছরের মধ্যে এ খাতের ভর্তুকি তুলে নেয়ার পরিকল্পনা সরকারের। তবে বিপিডিবির পক্ষে দাম বাড়িয়ে আর্থিক চাপ সামাল দেয়া সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে। কেননা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি বছরই খরচ বাড়ছে। এর পেছনে কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ অন্যতম কারণ। পাশাপাশি এ খাতে অযৌক্তিক ব্যয়, দুর্নীতিসহ নানা কারণেও খরচ বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়ে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা ইতিবাচক। এ অর্থ গ্রাহকের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ খাতে লোকসান কমাতে কীভাবে এ অর্থ ব্যয় হচ্ছে তার পরিষ্কার একটা পথ থাকা দরকার। সরকার প্রতি বছর বিদ্যুৎ খাতে যে পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিচ্ছে, তার বড় অংশই চলে যাচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জে। বসিয়ে রেখে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। এটি তো হতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না। আবার অনেক সময় অর্থের অভাবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনা যাচ্ছে না। ব্যয়বহুল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম কমানোর যথাযথ পথ নয়। ফলে এগুলো ঠিক করতে হবে। তাহলেই দেখা যাবে, সরকারের এ খাতে ব্যয় অনেকটাই কমে গেছে।’

অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি হিসেবে অনুমোদিত বাজেট ছিল ৫০ হাজার ২৩৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। যদিও পরে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩৯ হাজার ৪০৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা করা হয়। মূলত ভর্তুকির বিপরীতে বিদ্যুতে বিশেষ বন্ড ইস্যুর কারণে তা কমেছে। এখন পর্যন্ত বিদ্যুতে মোট ১৬ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করা হয়েছে।

এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরেও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়া হয় ৩৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকার বেশি। ওই সময় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া বাবদ বা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো, যা ওই অর্থবছরে দেয়া মোট ভর্তুকির ৬৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ।  

অর্থ মন্ত্রণালয়, বিপিডিবি ও একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে মোট ৭৮ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ হাজার ২৪১ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ হাজার ৯২৯ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩ হাজার ২০০ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৪ হাজার কোটি এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে পরিশোধ করতে হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো।

বিপুল পরিমাণ এ অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে বিপিডিবি দেনার দায়ে পড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের কাছ থেকে নেয়া ভর্তুকির পরও সংস্থাটি আর্থিক লোকসান করেছে ১১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ এ লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও ব্যয় কমানো যাচ্ছে না, বরং বাড়ছে। 

বিদ্যুৎ খাতে আর্থিক লোকসান কমানোর অংশ হিসেবে বিপিডিবির দেনার বোঝা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। এ প্রচেষ্টাকে অবশ্য ইতিবাচকভাবেই দেখছে ঢাকায় সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল। তবে বসিয়ে রেখে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংস্থাটির প্রতিনিধিরা। 

আইএমএফের প্রতিনিধি দলটি গত বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে। সেখানে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভর্তুকির চাপ সামলাতে বছরে চারবার বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করবে সরকার। এ প্রক্রিয়ায় আগামী তিন বছরে বিদ্যুৎ খাতে সব ধরনের ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে।

দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ১৬২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে স্বাভাবিক সময়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। তবে সম্প্রতি তীব্র তাপপ্রবাহে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড করা হয়। সর্বোচ্চ সক্ষমতার বিদ্যুৎ ব্যবহার ধরলেও প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্র বসে থাকছে। এ কেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সালের পর থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৪ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা দেশের বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পরিশোধ করতে হয়েছে বলে গত বছর সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ভর্তুকি কমিয়ে আয় ও ব্যয় সমান করার পন্থা নিয়ে এগোচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এরই অংশ হিসেবে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে খরচ কমানোর চেষ্টা চলছে। বিপিডিবি যাতে আর্থিকভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে ফিরতে পারে—এ চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেল।

সংস্থাটির মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন কিছুদিন আগে বণিক বার্তাকে বলেছিলেন, ‘বিনিয়োগ সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত রেখে বিদ্যুৎ খাত উন্নত হবে, এমন পরিকল্পনা থেকেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ক্যাপাসিটি চার্জ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি প্রত্যেক দেশের বিদ্যুৎ খাতেই রয়েছে। বিগত বছরগুলোয় ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে, সেগুলোর মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজন রয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে “নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট” ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নবায়ন হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বিদ্যুৎ খাতকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করতে সরকার ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে। যে কারণে সীমিত আকারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এটি এক পর্যায়ে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ও এ খাতের রাজস্ব আদায়ের সমান করা হবে।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন