সিমেন্ট শিল্প

আমদানিকারক থেকে উৎপাদনে স্বনির্ভর

মেহেদী হাসান রাহাত

ছবি : বণিক বার্তা

ব্রিটিশ ভারতের অধীনে ১৯৪১ সালে সিলেটে প্রথম সিমেন্ট কারখানা এবং ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় সিমেন্ট কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে এ দুই কারখানায় উৎপাদিত সিমেন্ট দেশের পুরো চাহিদা মেটাতে সক্ষম ছিল না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে আমদানির মাধ্যমেই দেশের সিমেন্টের চাহিদা মেটাতে হয়েছে। তবে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করে নব্বই ও এর পরের দশকগুলোয়। এ সময়ে একে একে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা সিমেন্ট খাতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। বাড়তে শুরু করে উৎপাদন সক্ষমতা। একসময়ের আমদানিনির্ভরতা থেকে রূপান্তর ঘটে সিমেন্টে স্বনির্ভর বাংলাদেশের। পরিমাণে কম হলেও সিমেন্ট রফতানিকারকের খাতায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ।

৯০-এর দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত দেশের সিমেন্টের মোট চাহিদার ৯৫ শতাংশই আমদানি করা হতো। তবে এর পর থেকেই সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগের কারণে দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো সিমেন্ট খাতের ব্যবসায় প্রবেশ করে। এ সময়ে কনফিডেন্স সিমেন্ট, হুন্দাই সিমেন্ট বাংলাদেশ, বসুন্ধরা গ্রুপের মেঘনা সিমেন্ট মিলস, আহাদ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, আরামিট সিমেন্ট, সেনা কল্যাণ সংস্থার মোংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, ডায়মন্ড সিমেন্ট, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট ও ইস্টার্ন সিমেন্টসহ আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সিমেন্ট উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করে। এর পরের দশকে আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান যেমন শাহ সিমেন্ট, এমআই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি (বর্তমানে ক্রাউন সিমেন্ট), মেঘনা গ্রুপের ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ, প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেড, সেভেন সার্কেল বাংলাদেশ, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ, হোলসিম বাংলাদেশ, রয়েল সিমেন্ট ও সিমেক্স সিমেন্ট বাংলাদেশ কারখানা স্থাপন করে। এর পর থেকে দেশের সিমেন্ট উৎপাদকরা ক্রমেই তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছেন। পাশাপাশি এ সময়ে আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান নতুন কারখানা চালু করেছে। 

দেশের সিমেন্টের বাজারে একসময় পর্যন্ত বহুজাতিক সিমেন্ট কারখানাগুলোর আধিপত্য ছিল। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে প্রথম বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে হুন্দাই সিমেন্ট কারখানা স্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে হাইডেলবার্গ, লাফার্জ, হোলসিম, সিমেক্স, তেইহেইয়ো এবং আল্ট্রাট্রেকের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এখানে তাদের কারখানা স্থাপন করে। তবে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়ার কারণে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে তাদের ব্যবসায়িক কৌশল পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ একীভূতকরণের মাধ্যমে বাজারে তাদের অংশীদারত্ব ধরে রাখার উদ্যোগ নেয়, যেমন লাফার্জ ও হোলসিম। অন্যদিকে কেউ তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে টিকতে না পেরে বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়েও নিয়েছে। যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক এমিরেটস সিমেন্ট ও মেক্সিকোভিত্তিক সিমেক্স সিমেন্ট। 

দেশের বেশকিছু নদী-তীরবর্তী স্থানকে কেন্দ্র করে সিমেন্ট শিল্প গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে মুন্সিগঞ্জে ধলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী মুক্তারপুর, নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর তীর, মেঘনা নদী-তীরবর্তী মেঘনাঘাট, ঘোড়াশাল, মোংলা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি সিমেন্ট কারখানা অবস্থিত। এর বাইরে সিলেটসহ দেশের আরো বেশকিছু অঞ্চলে কিছু সিমেন্ট কারখানা রয়েছে। বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) তথ্যানুসারে, দেশে বর্তমানে চালু থাকা সিমেন্ট কারখানার সংখ্যা ৪০। এ কারখানাগুলোর মোট স্থাপিত সক্ষমতা ৯ কোটি ২০ লাখ টন আর কার্যকর সক্ষমতা ৭ কোটি ৮১ লাখ ৭০ হাজার টন। পাঁচ বছর ধরে সিমেন্ট খাতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়লেও এ সময়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে সিমেন্টের চাহিদা কমেছে। ২০১৯ সালে দেশের সিমেন্ট খাতের কার্যকর সক্ষমতা ছিল ৬ কোটি ১ লাখ ৮০ হাজার টন। সে বছর সিমেন্টের চাহিদা ছিল ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টন, যা মোট সক্ষমতার ৫৬ শতাংশ। ২০২০ সালে আগের বছরের মতো কার্যকর সক্ষমতা একই থাকলেও সিমেন্টের চাহিদা কিছুটা কমে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৩০ হাজার টনে দাঁড়ায়, যা মোট সক্ষমতার ৫৫ শতাংশ। ২০২১ সালে দেশে সিমেন্টের কার্যকর সক্ষমতা ছিল ৭ কোটি ৮১ লাখ ৭০ হাজার টন। এ সময়ে মোট সিমেন্টের চাহিদা ছিল ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৮০ হাজার টন, যা মোট সক্ষমতার ৫০ শতাংশ। এরপরের দুই বছরে কার্যকরী সক্ষমতা একই থাকলেও কমেছে সিমেন্টের চাহিদা। এর মধ্যে ২০২২ সালে সিমেন্টের চাহিদা ছিল ৩ কোটি ৮৪ লাখ ৩০ হাজার টন ও ২০২৩ সালে ৩ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার টন, যা মোট সক্ষমতার ৪৯ শতাংশ। টাকার অংকে দেশে বর্তমানে সিমেন্টের বাজারের আকার ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। 

২০২৪ সাল শেষে দেশের সিমেন্ট খাতে আরো ৫৩ লাখ ২০ হাজার টন সিমেন্ট উৎপাদন সক্ষমতা বাড়বে এরই মধ্যে ক্রাউন সিমেন্ট এ বছর তাদের উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ লাখ ৭০ হাজার টন বাড়িয়েছে। মির সিমেন্ট ও দুবাই-বাংলা সিমেন্ট এ বছর তাদের সক্ষমতা বাড়াবে। আগামী বছর আরো প্রায় ৯৮ লাখ ৩০ হাজার টন সিমেন্ট উৎপাদন সক্ষমতা যোগ হবে। এর মধ্যে সিটি গ্রুপের ৬৫ লাখ ৫০ হাজার টন, কনফিডেন্স গ্রুপের ২৫ লাখ ৩০ হাজার টন ও আনোয়ার গ্রুপের ৭ লাখ ৪০ হাজার টন সক্ষমতা যোগ হবে। এতে ২০২৬ সালে দেশের সিমেন্ট খাতের কার্যকর উৎপাদন সক্ষমতা ১০ কোটি টন ছাড়িয়ে যাবে।

দেশের সিমেন্টের বাজারের সিংগভাগই রয়েছে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের কাছে। এর মধ্যে শাহ সিমেন্ট, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, সেভেন রিংস সিমেন্ট, ফ্রেশ সিমেন্ট, ক্রাউন সিমেন্ট, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, আকিজ সিমেন্ট, আমান সিমেন্ট ও আনোয়ার সিমেন্টের দখলে রয়েছে সিমেন্টের মোট বাজারের ৮০ দশমিক ৬৯ শতাংশ। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে ২০০৩ সালে এমআই সিমেন্ট প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে ভারতের সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলে সিমেন্ট রফতানি শুরু করে। পরবর্তী সময়ে মিয়ানমার, নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলংকায় বাংলাদেশ থেকে সিমেন্ট রফতানি হয়েছে।

বাংলাদেশে জনপ্রতি সিমেন্টের ব্যবহার অন্যান্য দেশের তুলনায় কম হলেও ধারাবাহিকভাবে এর পরিমাণ বাড়ছে। গত ১০ বছরে দেশে সিমেন্টের জনপ্রতি ব্যবহার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৪ সালে দেশে জনপ্রতি সিমেন্টের ব্যবহার ছিল ১২৪ কেজি। এর পরের বছর ২০১৫ সালে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ১৩০ কেজিতে। ২০১৬ সালে জনপ্রতি সিমেন্টের ব্যবহার ছিল ১৫৩ কেজি। ২০১৭ সালে জনপ্রতি ১৬৫ কেজি সিমেন্ট ব্যবহার হয়েছে। ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৮৮ কেজি। ২০১৯ সালে দেশে জনপ্রতি সিমেন্টের ব্যবহার বেড়ে ২০০ কেজিতে দাঁড়ায়। ২০২০ সালে জনপ্রতি সিমেন্টের ব্যবহার ছিল ১৯৬ কেজি। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ২২৭ কেজি। ২০২২ সালে দেশে জনপ্রতি সিমেন্টের ব্যবহার হয়েছে ২২৫ কেজি। ২০২৩ সালে দেশের জনপ্রতি সিমেন্টের ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ২১৮ কেজি।

গত ১০ বছরের মধ্যে তিন বছর সিমেন্ট খাতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে আর সাত বছর ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে ছিল খাতটি। ২০১৪ সালে সিমেন্ট খাতে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর পরের ২০১৫ সালে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ। ২০১৬ সালে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ দশমিক ২১ শতাংশ। ২০১৭ সালে সিমেন্ট খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১৮ সালে এ খাতে ১৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। ২০১৯ সালে সিমেন্ট খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ। কভিড-১৯-এর কারণে ২০২০ সালে সিমেন্ট খাতের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং এ বছর এ খাতে দশমিক ৯৫ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। ২০২১ সালে কভিডের প্রভাব কাটিয়ে সিমেন্ট খাতে ১৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। যদিও এর পরের দুই বছর ধরেই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এ খাতে। এর মধ্যে ২০২২ সালে ১ দশমিক ৪০ শতাংশ ও ২০২৩ সালে দশমিক ৭৭ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে দেশের সিমেন্ট খাতে। খাতসংশ্লিষ্টদের প্রক্ষেপণ অনুসারে ২০২৪ সালে সিমেন্ট খাতের প্রবৃদ্ধি একই জায়গায় স্থির থাকতে পারে। তবে এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হতে পারে।

বর্তমানে অর্থনীতির শ্লথগতি ও ডলার সংকটের প্রভাবে দেশের সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়েছেন। একদিকে সিমেন্টের চাহিদা কমেছে এবং প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান না হওয়ার কারণে প্রয়োজন অনুসারে কাঁচামাল আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ তীব্র হতে শুরু করেছে। পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং জাহাজ ভাড়াসহ পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাবে সিমেন্ট উৎপাদনের ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু তীব্র প্রতিযোগিতা বিদ্যমান থাকায় সিমেন্টের দাম সে অনুপাতে বাড়াতে পারছেন না উৎপাদকরা। তার ওপর অগ্রিম আয়কর ও আমদানি শুল্কের কারণেও ব্যয় বৃদ্ধির চাপে রয়েছে সিমেন্ট খাত। এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোয় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের বিদ্যমান শ্লথগতি অব্যাহত থাকলে সিমেন্ট খাত বড় ধরনের বিপদে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন