অভিমত

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণ-উত্তর ব্যবহার

আবু তাহের খান

বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের লক্ষ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য (যদিচ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে) সরকার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) আওতায় ২০১১ সালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি লিমিটেড (সিপিজিসিএল) গঠন করে। ওই কোম্পানির আওতায় আমদানীকৃত কয়লা বহনকারী জাহাজ ভেড়ানোর জন্য মাতারবাড়ীতে যে জেটি নির্মাণ করা হয়েছিল তা সম্প্রসারণের মাধ্যমে একে একটি পূর্ণাঙ্গ সমুদ্রবন্দরে রূপদানের উদ্যোগের মধ্য দিয়েই বস্তুত মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ধারণার যাত্রা, সে লক্ষ্যে ওই জেটিকে এরই মধ্যে সিপিজিসিএল কর্তৃক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বর্তমান মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর তাই জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন সিপিএর একটি প্রকল্প, যার আওতায় পরিকল্পনাধীন দুটি টার্মিনালের একটির নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো ১১ নভেম্বর। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সাল নাগাদ এর সমুদয় নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।

প্রকল্পটি যেহেতু জাইকার মতো খ্যাতিমান সংস্থার আওতায় বাস্তবায়ন হচ্ছে, তাই আশা করা যায় যে এর বাস্তবায়ন যথাসময়ে অর্থাৎ ২০২৬ সালের ডিসেম্বর নাগাদই সম্পন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বন্দরের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর পরই এর কাম্যস্তরের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এখন থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের কার্যকর চিন্তাভাবনা কি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে? এক্ষেত্রে একেবারে প্রথমেই এ প্রশ্নের নিষ্পত্তি হওয়া দরকার যে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর কি সিপিএর আওতায় কাজ করবে নাকি এ নিয়ে একটি আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অনুমোদিত ডিপিপিতে কী উল্লেখ আছে আমরা জানি না। তবে ডিপিপিতে যা কিছুই উল্লেখ থাকুক না কেন, সে অনুযায়ী এখন থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়নোত্তর স্তরে এটি যেভাবে পরিচালিত হওয়ার কথা, রাজস্ব বাজেটের আওতায় সে অনুযায়ী স্থায়ী জনবল কাঠামো সৃষ্টির উদ্যোগ যেন এখন থেকেই নেয়া হয়। নইলে এ দেশে উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরের যে জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, তা সম্পন্ন করতে গিয়ে মাতারবাড়ী বন্দরের পরিচালন কার্যক্রম বিলম্বিত ও বিঘ্নিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থেকে যাবে।

বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা এই যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধরেই নেয়া হয় যে কোনো একটি প্রকল্প রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তর হওয়া মানেই তার সমূদয় জনবল রাজস্ব বাজেটে চলে যাওয়া। ধারণাটি একেবারেই সঠিক নয়। কিন্তু তা সঠিক না হলেও রাজনৈতিক, মানবিক, মনস্তাত্ত্বিক ও অন্য নানা কারণে শেষ পর্যন্ত এ দেশে তেমনটিই ঘটে থাকে। এর ফলে সেখানে বহু অপ্রয়োজনীয় লোককে যেমন অহেতুক পুষতে হয়, তেমনি আবার বহু সময় প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে উপযুক্ত লোকবলও খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ উন্নয়ন প্রকল্প ও রাজস্ব কাঠামোর আওতাধীন পরিচালন কার্যক্রমের প্রকৃতি, পরিধি ও বৈশিষ্ট্য এক নয়। অথচ সেটিকে জোড়াতালি দিয়ে এক বানিয়ে ফেলার ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, বিভাগ বা দপ্তরের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ব্যাপক মাত্রায় কর্মদক্ষতার অবনমন ঘটে থাকে। আশা করব যে মাতারবাড়ী বন্দরের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটবে না এবং তেমনটি ঘটা থেকে বিরত থাকতে চাইলে এখন থেকেই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতে হবে।

এখন দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হচ্ছে, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম লাভজনক ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টি। এক্ষেত্রে একেবারে প্রথমেই বলব যে একে কোনোভাবেই শুধু একটি দেশভিত্তিক বন্দর হিসেবে বিবেচনা করলে হবে না। বরং একে দক্ষিণ এশিয়ার পরিধি ছাড়িয়ে উত্তর-পূর্ব এশিয়ার একটি আঞ্চলিক বন্দর হিসেবে ভাবতে ও গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নেপাল, ভুটান, উত্তর-পূর্ব ভারত ও চীনের ইউনান প্রদেশের ব্যবহারকারীরা হবে মূল লক্ষ্য। কিন্তু সেটি করতে হলে ২০২৬ সালে গিয়ে হঠাৎ উদ্যোগ নিলে হবে না; এখন থেকেই তা করতে হবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নোত্তর সময়ে এটি সিপিএর আওতায় বা আলাদা যেভাবেই থাকুক না কেন এখন এ উদ্যোগ সিপিএকেই নিতে হবে। অন্যদিকে মাতারবাড়ী বন্দরের উল্লিখিত আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারীদের কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ও সংখ্যায় পেতে হলে তা শুধু সিপিএ বা নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে বা তাদের নিজস্ব চেষ্টা ও উদ্যোগে সম্ভব নয়। এর জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বলিষ্ঠ ও কার্যকর ভূমিকারও প্রয়োজন হবে এবং বহুক্ষেত্রে শেষোক্ত দুই মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাই হবে মুখ্য। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ ও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার কাজটি অবশ্যই সিপিএ ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পকেই করতে হবে।

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের উল্লিখিত সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারীদের মধ্যে বর্তমানে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে একাধিক পর্যায়ের ট্রানজিট চুক্তি রয়েছে। এ চুক্তিগুলোর মধ্যে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ৫ মে ২০২৩ তারিখের চুক্তি, নেপালের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ২২ মার্চ ২০২১ তারিখের চুক্তি ও ভুটানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ২২ মার্চ ২০২৩ তারিখের চুক্তিগুলো বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। তবে এ চুক্তিগুলোয় এবং এ বিষয়ে উল্লিখিত দেশগুলোর সঙ্গে এর আগে স্বাক্ষরিত কোনো কোনো চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষিত হয়নি বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, বিশেষত ভারতের সঙ্গ স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে। এ অবস্থায় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের ব্যবহার নিয়ে উল্লিখিত দেশগুলোর সঙ্গে যখন নতুন করে চুক্তি স্বাক্ষর বা পূর্ববর্তী চুক্তিগুলো সংশোধন বা সংযোজনের প্রয়োজন হবে, তখন উপরোক্ত অসংগতিগুলো দূরীকরণের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করি। আশা করব যে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে দেশের পরিপূর্ণ স্বার্থ রক্ষায় সক্ষম হবেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ যে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করতে গিয়ে অনেক সময় নিজ দেশের স্বার্থরক্ষায় ব্যর্থ হয় সেটি সবসময় ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটছে এমন নয়। অনেক সময় সেটি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনিচ্ছাকৃত অদক্ষতার কারণেও ঘটে থাকে। অতএব অনুরোধ থাকবে যে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারী বাড়ানের উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি সে উদ্যোগে দক্ষতার স্বাক্ষরটুকুও যেন থাকে।

অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের একাধিক বাণিজ্য চুক্তি থাকলেও সমুদ্রবন্দরের ব্যবহার নিয়ে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। ফলে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ট্রানজিট চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষিত না হওয়ার যে আক্ষেপ রয়েছে, চীনের ক্ষেত্রে তেমনটি এখনো ঘটতে পারেনি। ফলে নিকট ভবিষ্যতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের পাশাপাশি অন্য তিন সমুদ্রবন্দর (চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা) নিয়ে যদি চীনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের সুযোগ ঘটে, তাহলে সেটি যেন ওই ধরনের দুর্বলতা থেকে মুক্ত থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি হয়ে উঠতে পারে। আর ইউনান প্রদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের বিবেচনা থেকে বলা যে এক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে এখন থেকেই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা না করে অন্য তিন বন্দর নিয়ে এখনই চুক্তি স্বাক্ষর হয়ে যেতে পারে, যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরকেও এ চুক্তির সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে।

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের নিকট ভবিষ্যতের অর্থনীতি ও আঞ্চলিক কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি সম্পূর্ণ নতুন অনুষঙ্গ। এটি একদিকে যেমন সম্ভাবনার ইঙ্গিতবাহী, অন্যদিকে তেমনি এ সম্ভাবনাকে সতর্কতা ও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে না পারলে তাতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে না পারার আশঙ্কাও রয়েছে, এমনকি রয়েছে আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বের মুখে বিপদে পড়ার ঝুঁকিও। ফলে এ বন্দর নিয়ে আমরা যেন পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও সময় নিয়ে যতটা সম্ভব গুছিয়ে দক্ষতা, দৃঢ়তা ও সতর্কতার সঙ্গে এগোনোর চেষ্টা করি। মোট কথা, আগের ট্রানজিট চুক্তিগুলোয় যেসব ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থহানি ঘটেছে, সেগুলোর যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। সব মিলিয়ে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা প্রচণ্ডভাবে আশাবাদী।

আবু তাহের খান: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত; সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন