ঘূর্ণিঝড় হামুন

নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, দেয়াল ও গাছচাপায় তিনজনের মৃত্যু

বণিক বার্তা প্রতিনিধি I কক্সবাজার

ঘূর্ণিঝড় হামুনের কারণে গতকাল বন্ধ ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম ছবি: আজীম অনন

ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ অনেকটা দুর্বল হয়ে উপকূলে আঘাত হানলেও কক্সবাজারে তাণ্ডব চালিয়েছে। দেয়াল ও গাছচাপায় প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন। এর আগে গতকাল সন্ধ্যা ৬টার পর ঘূর্ণিঝড়টি কুতুবদিয়া দিয়ে উপকূল অতিক্রম শুরু করে বলে জানায় বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে হামুনের মূল অংশটি আঘাত হানে সন্ধ্যা ৭টার দিকে। এ সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার। সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চল। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় হামুনের প্রভাবে উপকূলের অনেক স্থানে স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে পাঁচ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চল এতে প্লাবিত হয়েছে। ঝড়ের কারণে বেশকিছু গাছপালা ভেঙে পড়েছে। তবে বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। ঘূর্ণিঝড়টি বুধবার সকালের মধ্যে কুতুবদিয়া উপকূল দিয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ড অতিক্রম করতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। 

আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় হামুনের প্রভাবে গতকাল বিকাল থেকেই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বৃষ্টি শুরু হয়। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় কক্সবাজারের টেকনাফে, ৮৭ মিলিমিটার। খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলায়ও মাঝারি বৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে বেশির ভাগ উপকূলীয় এলাকায় দমকা হাওয়া বয়ে যায়। 

ঘূর্ণিঝড় হামুনের কারণে কক্সবাজারে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। উপকূলের বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে মাইকিং করা হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সতর্কতা হিসেবে গতকাল সন্ধ্যার পর থেকেই কক্সবাজার বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এদিকে হামুনের কারণে সৃষ্ট ঝড়ো বাতাসে কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকায় গাছপালা ভেঙে পড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ও সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাত ৮টা থেকে বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে পুরো কক্সবাজার শহর। 

স্থানীয়রা জানান, ঘূর্ণিঝড় হামুনের প্রভাবে ভারি বৃষ্টিপাত ও তীব্র বাতাস বইছিল। ওই সময় পাহাড়তলীর জিয়ানগর এলাকার আবদুল খালেক (৩৮) বাসায় কাজ করছিলেন। রাত ৯টার দিকে হঠাৎ বাড়ির দেয়াল ভেঙে তার ওপর এসে পড়ে। পরিবারের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে পথেই তার মৃত্যু হয়। 

এদিকে গাছ পড়ে চকরিয়া উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের আসকর আলীর মৃত্যু হয়েছে। মহেশখালীর বড় কুলাল পাড়ায়ও একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তবে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার পরিচয় জানা যায়নি।

জেলা প্রশাসক শাহীন ইমরান জানান, ঝড়ে কিছু কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপক আকারে। অনেক জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে, তার ছিঁড়ে গেছে। দেয়াল ও গাছচাপায় মৃত্যুর খবরও এসেছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় হামুনের অগ্রভাগ সন্ধ্যার পর থেকে কক্সবাজারসহ উপকূল অতিক্রম শুরু করে। শহরের মতো উপকূলের গ্রামের অনেক কাঁচা ঘরবাড়ির চালা, গাছপালা উপড়ে পড়েছে বলে প্রাথমিকভাবে খবর পেয়েছি। পুরো অতিক্রম করা শেষ হলে বুধবার দিনের বেলায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে সঠিক জানা যাবে।’

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব মোকাবেলায় গতকাল সকালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সতর্কতা ‘অ্যালার্ট-৩’ জারি করে। এরপর নিয়ম অনুযায়ী, জেটি থেকে সব জাহাজ সাগরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঝড়ের সময় প্রচণ্ড বাতাস ও ঢেউয়ের তোড়ে জাহাজের ধাক্কায় জেটি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য এ ব্যবস্থা নেয়া হয় বলে জানায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে বন্দর থেকে পণ্য খালাসের কার্যক্রমও বন্ধ রাখা হয়। সুরক্ষিত করা হয় বন্দরের মূল্যবান যন্ত্রপাতি, কনটেইনার ও অন্যান্য স্থাপনা।

প্রবল ঘূর্ণিঝড় হামুনের কারণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দরকে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে বলা হলেও সর্বশেষ বুলেটিনে তা নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এছাড়া মোংলা ও পায়রা বন্দরকে ৫ নম্বর বিপৎসংকেতের পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতের আশঙ্কায় পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সারা দেশে নৌপথে সব নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এর আগে একই কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ১০ জেলার ১৫ লাখ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার নির্দেশ দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। জেলাগুলো হলো পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর।

ঘূর্ণিঝড়ের ‘হামুন’-এর নাম দিয়েছে মূলত ইরান। ফার্সি ভাষায় মরুভূমিতে প্রাকৃতিক হ্রদ বা বড় জলাশয়কে বলা হয় হামুন। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এ ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টি হওয়ার পর দ্রুত তা বাংলাদেশ উপকূলের দিকে এগোতে থাকে। ফলে শক্তি অর্জনের জন্য হামুন তেমন সময় পায়নি। বাংলাদেশ উপকূলের কাছাকাছি এসে তাই এটি বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন