পোশাক শিল্পে সবচেয়ে কম মজুরি বাংলাদেশে

ন্যূনতম সাড়ে ১৭ হাজার টাকা মজুরির প্রস্তাব সিপিডির

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের রফতানি আয়ের প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক। এ খাতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ রফতানিকারক বাংলাদেশ। অথচ শীর্ষস্থানীয় রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি পান এ দেশের শ্রমিকরা। আর সবচেয়ে বেশি মজুরি চীনে। দেশটিতে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন ৩০৩ ডলার ৫৯ সেন্ট। ইন্দোনেশিয়ায় ন্যূনতম মজুরি ২৪২ ডলার ৯৪ সেন্ট। কম্বোডিয়ায় এর পরিমাণ ২০০ ডলার। আর প্রতিবেশী ভারতে এ খাতে একজন শ্রমিকের সর্বনিম্ন বেতন ১৭১ ডলার ১৮ সেন্ট। বাংলাদেশে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৭২ ডলার ৪২ সেন্ট। রাজধানীতে গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সংলাপে উঠে এসেছে এমন তথ্য। 

‘গার্মেন্টস খাতে ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ: পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এ সংলাপের আয়োজন করে সিপিডি ও বেসরকারি সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান এইড। সংলাপে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি। মূল্যস্ফীতি ও শ্রমিকের আর্থিক নিরাপত্তা বিবেচনায় এ প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। 

সিপিডি বলছে, ৭৬টি কারখানার ২২৮ জন শ্রমিকের ওপর গবেষণা করে মজুরি বাড়ানোর এ প্রস্তাব দিয়েছে তারা। ক্রেতারা যদি প্রতি পিস পণ্য মাত্র ৭ সেন্ট (প্রায় ৮ টাকা) বেশিতে নেয় তাহলে এ মজুরি দিতে কোনো চাপ তৈরি হবে না। আগামী নভেম্বরে পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার কথা রয়েছে। তবে ঘোষণার পর সেটি কার্যকর হচ্ছে কিনা সেটি অন্তত তিন মাস পর্যবেক্ষণের তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। কেননা ২০১৮ সালে ঘোষিত মজুরি কাঠামো এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। 

সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও সিনিয়র গবেষণা সহকারী তামিম আহমেদ। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, ন্যূনতম মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান, শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। 

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘দুজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে সামনে রেখে একটি পরিবারের ন্যূনতম খরচ হিসাব করে এ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একজন পোশাক শ্রমিকের পরিবারের খাওয়া খরচ ১৬ হাজার ৫২৯ টাকা। অন্যান্য খরচ ১২ হাজার ৮৮১ টাকা। মোট মাসিক খরচ দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৪১০ টাকা। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতি যোগ করলে দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৯৪২ টাকা।’ 

শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল গার্মেন্টস এমপ্লয়িজ লিগের (বিএনজিডব্লিউইএল) সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ‘শ্রমিকদের মৌলিক বিষয়গুলো উল্লেখ করায় সিপিডিকে ধন্যবাদ। এখানে গ্রেড পদ্ধতি দুই বছর পর বৃদ্ধির কথা আমরা বলে আসছি। অন্যদিকে, শ্রমিকের মজুরি যেখানে বাড়ে সেখানে বাড়ি ভাড়াও বেড়ে যায়। ফলে তার কোনো লাভ হয় না। সেক্ষেত্রে আমরা প্রস্তাবে বলেছি, স্থানীয় প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে শিল্প অঞ্চলে যাতে বাড়ি ভাড়া না বাড়ে সেদিকে নজর দেয়ার জন্য। আরেকটা বিষয় হলো, মূল্যস্ফীতির কারণে সব জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ফলে যা-ই মজুরি দেয়া হোক না কেন, রেশনিং ব্যবস্থা জরুরি। তাহলে তাদের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হবে। মাতৃত্বকালীন সুবিধা চার মাসের বদলে ছয় মাস করা প্রয়োজন।’ 

তিনি বলেন, ‘এখানে সাতটি গ্রেড রয়েছে। সেগুলো কমিয়ে পাঁচটি করার দাবি জানাচ্ছি আমরা। যেখানে অধিকসংখ্যক শ্রমিক কাজ করে গ্রেড পদ্ধতি নিয়ে তাদের সমস্যা হয়। আর গ্র্যাচুইটি চালু করা দরকার। শ্রমিক যদি ভালো না থাকে, তাহলে শিল্পের গুণগত মান ভালো হবে না। ক্রেতাদেরও সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।’ 

মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লাহ বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী বোর্ড গঠনের পর ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছি। গার্মেন্টসে এখন বিবিএ, এমবিএ করা ছেলে-মেয়েরাও কাজ করছে। মালিক-শ্রমিক উভয়ের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। মালিকেরও সমস্যা, শ্রমিকেরও সমস্যা। এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে শ্রমিকও বাঁচে, মালিকও বাঁচে। না হলে শিল্পের ক্ষতি হয়ে যাবে।’ 

মালিকপক্ষের প্রতিনিধি বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘দেশের তৈরি পোশাক খাত আজ ৮৭ বিলিয়ন ডলার রফতানি করছে। তিলে তিলে গত ৫০ বছরে এ পর্যায়ে এসেছে। প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ব্যাকওয়ার্ড, ফরোয়ার্ড মিলিয়ে বললে এক কোটির কিছু বেশি মানুষ এ ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে। এখানে পরিবারে দুজন করে শ্রমিক ধরে হিসাব করা হয়েছে। আসলে সবাই কিন্তু বিয়ে করেনি। কারণ ৩০ বছরের বেশি বয়স হলে আর এখানে কাজ করে না কেউ। তাদের হাতে টাকা-পয়সা হয়, তখন অন্যদিকে চলে যায়। যারা কাজ করে, তাদের বেশির ভাগই অবিবাহিত। আমার শ্রমিক ২৫ হাজার। আমি জানি তাদের বিস্তারিত। ডিজিটালি বেতন দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আমরা তো কভিডের পর থেকেই ডিজিটালি বেতন দিচ্ছি। ক্রেতারা ৭ সেন্ট করে বাড়িয়ে দিলেই আর সমস্যা হবে না, বলা হলো। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্রেতাদের চাপ দেয়া কঠিন।’ 

তিনি বলেন, ‘প্রথম মজুরি বোর্ড গঠনের পর ১৯৯৪ সালে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৯৩০ টাকা করা হয়। তারপর ১২ বছর পর করা হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা। ২০১০ সালে ৩ হাজার টাকা করা হলো। এর তিন বছর পার হতেই আবার বাড়ানো হলো। তখন আমরা ৫ হাজার ৩০০ টাকা করি। ২০১৮ সালে আবার ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করি। তখন কিন্তু শ্রমিকদের থেকে বা অন্য কেউ আমাদের কিছু বলেনি। আমরা নিজেরাই অনুভব করেছি। তখন ৮ হাজার টাকা করা হলো। এ বছরও আমরা বিজিএমইএ থেকে শ্রম মন্ত্রণালয়কে মৌখিকভাবে বলেছি, সময় কম, মজুরি বোর্ড গঠন করেন। তখন ওনারা করলেন, এখন কাজ চলছে।’ 

সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। কারণ তাদের নিজেদের তুলা আছে, গভীর সমুদ্রবন্দর আছে। আমাদের এসব কিছুই নেই। আমাকে সবকিছুর জন্য আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। তার পরও আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। গুণগত মানের বিষয়টা কিন্তু মালিকদের হাতে, যেটাতে আমরা তুরস্ক ও চীন থেকে ভালো। তার পরও ক্রেতারা আমাদের পণ্যের দাম কম দেন।’ 

উল্লেখ্য, বর্তমানে ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি পান তৈরি পোশাক শ্রমিকরা। এটি ২৪ হাজার টাকা করার দাবি বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন