এক বছরে গরু-ছাগল জবাই কমেছে ৬৬ লাখ

উচ্চমূল্যের কারণে দেশে মাংস খাওয়া কমেছে

শাহাদাত বিপ্লব

উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছে দেশের মানুষ। খরচ মেটাতে খাদ্যতালিকায় করতে হচ্ছে ব্যাপক কাটছাঁট। উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তের তালিকায় প্রায়ই গরু, খাসি, মহিষসহ বিভিন্ন গবাদিপশুর মাংস থাকলেও এখন তা কমিয়ে আনা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে মাংসের দামও বেড়ে যাওয়ায় আমিষের চাহিদা মেটাতে মানুষ বিকল্প খাবারে ঝুঁকছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, কোরবানি বাদে এক বছরের ব্যবধানে এ বছর গরু-ছাগল জবাই উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

পশু খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা থাকায় কোরবানিতে দেশে পশু জবাই কমেনি। তবে অন্যান্য খাদ্যপণ্যের সঙ্গে জীবনধারণের সার্বিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় মানুষ মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। দেশে গবাদিপশুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জবাই হয় গরু ও ছাগল। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে কেবল এ দুই পশু জবাই কমেছে প্রায় ৬৬ লাখ। 

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট গবাদিপশু জবাই হয় ৩ কোটি ২৯ লাখ ৬৬ হাজার ৮১৩টি। এর মধ্যে দেশী গরু ১ কোটি ১৭ লাখ ৯৪ হাজার ৫১০টি, সংকর জাতের গরু ৪৭ লাখ ৩৭ হাজার ১১৮টি, ছাগল ১ কোটি ৪৯ লাখ ৫৯ হাজার ৬৪৭টি, মহিষ ৩ লাখ ৯১ হাজার ৩৫১টি, ভেড়া ১০ লাখ ২৭ হাজার ৭১৭টি এবং অন্যান্য গবাদিপশু জবাই হয় ৫৬ হাজার ৪৭০টি। যদিও গত অর্থবছরে তার থেকে প্রায় ২০ শতাংশ কমে মোট ২ কোটি ৬৭ লাখ ১৫ হাজার ২৫৬টি গবাদিপশু জবাই হয়েছে। এর মধ্যে দেশী গরু ৮৬ লাখ ৯১ হাজার ১৫৪টি, সংকর গরু ৪৭ লাখ ৭ হাজার ৯১৮টি, ছাগল ১ কোটি ১৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬১৪টি, মহিষ ৫ লাখ ৮৩ হাজার ৯৫১টি, ভেড়া ১১ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৯টি ও অন্যান্য গবাদিপশু জবাই হয় মোট ৭৫ হাজার ৪৩০টি।

গরু ও ছাগল মিলিয়ে গত অর্থবছরে জবাই হয়েছে ২ কোটি ৪৮ লাখ ৯২ হাজার ৬৮৬টি, যেখানে আগের অর্থবছরে জবাই হয়েছিল ৩ কোটি ১৪ লাখ ৯১ হাজার ২৭৫টি। যদিও প্রতি বছরই পশু কোরবানি বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। গত কোরবানিতে জবাই হয় মোট ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৯৬৩টি পশু। এর আগের বছর অবশ্য ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু কোরবানি হয়েছিল।  

রাজধানীর বাজারগুলোয় বর্তমানে প্রতি কেজি গরু ও মহিষের মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৮০০ টাকায়। আর ছাগলের মাংস ৯০০-৯৫০ ও খাসির মাংস ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। গত এক বছরে গবাদিপশু দুটির মাংস প্রতি কেজিতে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। 

রাজধানীর মহাখালীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মো. রায়হান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। ১ হাজার টাকার একটি নোট নিয়ে বাজারে গিয়ে সবজি ও মসলা কিনলেই শেষ হয়ে যায়। মাছ-মাংস কেনা অনেক কমিয়ে দিয়েছি। কিনলেও মুরগি কিনছি। যে আয় তাতে গরু বা খাসির মাংসের বাজারে যাওয়ার সাহস হয় না। কোরবানির সময় কিছু গরুর মাংস ছিল তা খেয়েছি। এরপর আর গরু কিংবা ছাগলের মাংস কেনা হয়নি। আয় তো বাড়েনি আমার।’

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা শারমিন আক্তার পেশায় একজন ফার্মাসিস্ট। স্বামী-সন্তানসহ চার সদস্যের পরিবার। প্রতি মাসে স্বামী ও তার আয় প্রায় ৮০ হাজার টাকা। বণিক বার্তাকে শারমিন বলেন, ‘আগে প্রতি সপ্তাহে অন্তত বাসায় একবার গরুর মাংস রান্না হতো। কিন্তু অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে মাংসের দামও বেড়েছে। তাই এখন আর তেমন গরু কেনা হয় না বললেই চলে। কোরবানির পর সপ্তাহ দুয়েক আগে একবার গরুর মাংস কেনা হয়েছিল।’  

মাংস বিক্রেতারা জানিয়েছেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের জন্য মাংস কেনা মানুষের সংখ্যা অনেকাংশেই কমেছে। হোটেলগুলোই এখন তাদের মূল ক্রেতা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দীর্ঘদিন ধরে গরুর মাংস বিক্রি করছেন মো. কানুন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আগে ৩০০-৪০০ কেজি গরুর মাংস অনায়াসেই বিক্রি করা যেত। হোটেলগুলোই নিত ১০০-১৫০ কেজি। বাকি মাংস কিনত সাধারণ মানুষ। কিন্তু এখন বড়জোর ১০০-১২০ কেজি মাংস বিক্রি হয়, যার প্রায় সবটাই হোটেলগুলো কিনে নেয়। সারা দিনে ২০-২৫ কেজির মতো বিক্রি হয় সাধারণ ক্রেতাদের কাছে। অর্থাৎ আগে যেখানে প্রতিদিন ৪-৫টা গরু জবাই করতাম, এখন একটা বা দুইটা জবাই করি। এর মধ্যেও বিক্রি না হওয়ায় অনেক মাংস থেকে যায়।’ 

বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে এ মাংস বিক্রেতা বলেন, ‘মানুষের সব ধরনের খরচ বেড়েছে। বাজারে এখন ৬০-৭০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। মানুষকে তো আর প্রতিদিন মাংস খেতে হয় না। ভাত-তরকারি তো খেতে হয়। তাই মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে অনেকেই। কেউ কেউ আবার জমা করে রাখা কোরবানির মাংস খাচ্ছে।’ 

একই কথা জানিয়েছেন কারওয়ান বাজারের খাসির মাংস বিক্রেতা মো. খোরশেদ আলম। বর্তমানে তেমন বিক্রি নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত বছরের এ সময়েও প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫-২০টা ছাগল কিংবা খাসি জবাই করতাম। এখন ৪-৫টার বেশি হয় না। কেনার মানুষ নেই। কিছু হোটেল থেকে নিয়মিত মাংস নেয়। আর অল্প কিছু খুচরা ক্রেতা পাওয়া যায়। সাপ্লাইও অনেক কম। অবশ্য ক্রেতা থাকলে সাপ্লাই বাড়ত। এখন মানুষ এত বেশি দামের মাংস কিনতে চায় না।’

আগের বছরের তুলনায় গরু-ছাগলের জবাই কমে যাওয়ার তথ্য দিয়েছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তাও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে তিনি জানান, বিভিন্ন নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। সে কারণে খাদ্যতালিকা থেকে অনেকেই মাংসকে ছেঁটে ফেলছেন। 

খামারিদের বিক্রিও অনেক কমে গেছে জানিয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব শাহ ইমরান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে মাংসের উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। আবার মফস্বল থেকে ঢাকায় চার থেকে পাঁচ হাত ঘুরে গবাদিপশু আসে। এতে ২৫ শতাংশ দাম বেড়ে যায়। এর সঙ্গে বাড়তি পরিবহন খরচ তো আছেই। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সবাইকে তো চাল, ডাল, তেল, সবজি এগুলো কিনে খেতে হয়। প্রতিটি জিনিসেরই দাম এখন অনেক বেশি। সব মিলিয়ে মানুষের অনেক ব্যয় বেড়েছে। স্বল্প আয় দিয়ে গরুর মাংস কীভাবে খাবে?’  

গরুর মাংসের ক্ষেত্রে উচ্চমূল্যের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম জানিয়ে শাহ ইমরান আরো বলেন, ‘বিশ্বব্যাপীই গরুর মাংসের দাম বেড়েছে। দাম কমাতে আমরা সরকারের কাছে কিছু দাবি জানিয়েছিলাম। ব্রাহ্মা জাতের গরু দুই বছরে ৫০০-৬০০ কেজি হওয়া সম্ভব, যেখানে দেশী গরু ১২০-১৫০ কেজি হয়। ব্রাহ্মা জাতের গরু আমাদের আবহাওয়া উপযোগীও। কিন্তু এ গরু আমাদের দেশে আনতে দেয়া হচ্ছে না। পশুখাদ্যের কিছু বিষয় রয়েছে। তাহলে সার্বিকভাবে গরুর মাংসের দাম কমিয়ে আনা সম্ভব।’

বাজারে সব পণ্যের দামই বেড়েছে উল্লেখ করে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মানুষের তো আগে খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে, তারপর আমিষের চাহিদা পূরণ। মানুষ আগে চাল, ডাল, তেল এসব কেনে। আলুর কেজি এখন ৫০ টাকা। কাঁচামরিচের কেজি লাফ দিয়ে ২০০ টাকার বেশি উঠে গেছে। এসব কেনার পর মানুষ মাংস কিনতে যায়। আগে শুক্রবার এলে মহল্লার মধ্যে গরু জবাই হতো, ভাগ করে মানুষ মাংস কিনত। এখন কিন্তু এসব চোখে পড়ে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে গরু-খাসি খাওয়া কমবে এটাই স্বাভাবিক।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন