ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড, ডেমোক্রেসি ও ডিমান্ড

আমাদের সামনে তিনটি ‘ডি’ খুব গুরুত্বপূর্ণ

ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে বাংলায় জনমিতিক লভ্যাংশ বলা হয়। একটি দেশের ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন মডেলের তৃতীয় ধাপে জন্মহার ও মৃত্যুহার কমে এলে বয়স কাঠামোর পরিবর্তনের ফলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে যায়। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বলতে ১৫-৬৪ বছর বয়সীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী হিসেবে ০-১৪ বছর বয়সী এবং ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে যারা রয়েছে তারা এ শ্রেণীভুক্ত। এখন এর আনুপাতিক আকার লক্ষ করলে দেখা যায়, একটি দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যখন বেশি থাকে তখন সে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার সুযোগ তৈরি হয়। মোটাদাগে জনমিতিক লভ্যাংশ বলতে বোঝায়, একটি দেশের প্রজনন ও মৃত্যুহার এ দুটো কমে আসার কারণে বয়স কাঠামোর মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে। সে বয়স কাঠামোর পরিবর্তনে অর্থাৎ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যখন নির্ভরশীল জনসংখ্যার অনুপাতে সর্বাধিক দাঁড়ায়, তখন নির্ভরশীলতার হার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনুকূলে থাকে বা এরকম একটি সুযোগ তৈরি হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে যদি বিদ্যমান অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি আরো বেশি ত্বরান্বিত করা যায়, তবেই সেটি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হবে। ব্যাপারটি এ রকম নয় যে শুধু কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী থাকা মানেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। এটি তখনই হবে যখন কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সর্বাধিক হবে তাদের কাজে লাগিয়ে বিদ্যমান প্রবৃদ্ধিকে যদি ত্বরান্বিত করা যায়। নীতিনির্ধারক বা জনমনে একটি ধারণা রয়েছে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যেহেতু বাংলাদেশে বেশি, তাই বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু আসলে সেটি নয়, বস্তুত বাংলাদেশের সামনে প্রথম ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন এ সুযোগ কাজে লাগাতে গেলে কতগুলো বিষয় লক্ষণীয়। একটি হচ্ছে, আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী রয়েছে, কিন্তু এদের সুশিক্ষা পেতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, আর্থিক ক্ষেত্রে তাদের চাকরি নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত, সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে নিয়ম-নীতির সঠিক প্রয়োগ থাকবে। এসব বাস্তবায়নে সহায়ক পরিবেশ যদি থাকে তাহলে জন্ম-মৃত্যুহার পরিবর্তন কমে আসার কারণে যে জনগোষ্ঠীকে পাচ্ছি একে তখনই কাজে লাগানো যাবে যখন সহায়ক পরিবেশের মধ্যে প্রতিটি চাকায় যদি একটি হুইল হিসেবে চিন্তা করা যায়। মানসম্মত শিক্ষা, উৎপাদনশীল সবল জনশক্তি, অর্থনৈতিক নীতি, সুশাসন এ প্রত্যেকটি চাকা যদি সুবিন্যস্তভাবে কাজ করে তাহলে একটি দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের উপকারিতা পেতে পারে। এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সর্বশেষ গৃহগণনা ও জনশুমারি ২০২২ যেটি হয়ে গেল, সেখানে দেখা যাচ্ছে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী (১৫-৬৪ বছর) ৬৫ দশমিক ২৩ শতাংশের মতো। এটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বোচ্চ পরিমাণে কর্মক্ষম মানুষ। দেখা যাবে যে সামনে এটি আরো বাড়বে। বৃদ্ধি পেতে পেতে ২০৩৪-৩৫ বা ২০৩৬ পর্যন্ত আমাদের অনুকূলে থাকবে অর্থাৎ প্রথম ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনের সর্বাধিক সুবিধা পাওয়ার কাঙ্ক্ষিত সময়। এ সময়টি আমাদের কাজে লাগাতে হবে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে শ্রমবাজারে কীভাবে কাজে লাগানো হবে। এক্ষেত্রে মূল কথা হচ্ছে, এদেরকে দক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে তৈরি করতে হবে। এটি করতে গেলে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। খেয়াল করতে হবে যুবকদের বেকারত্বের হার আমাদের এখানে অনেক বেশি। যে পরিমাণে কর্মসংস্থান তৈরি করার কথা, সে পরিমাণে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। তরুণদের বেকারত্বের হার সামগ্রিক বেকারত্বের দ্বিগুণের কোঠায়। এ তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা শিক্ষা, চাকরি, প্রশিক্ষণের মধ্যে নেই, তাদের সংখ্যাও অনেক বেশি। তরুণ-যুবাদের সুরক্ষাহীনতা বা ভালনারেবিলিটির বিষয়টি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তরুণদের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাল্যবিবাহ, কিশোরী মাতৃত্ব বা গর্ভধারণ সেটি দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি তা থেকে উত্তরণ। এখানে দেখা যাচ্ছে, জেন্ডার সমতা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে পারলেও বাল্যবিবাহের কারণে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বা পরবর্তী সময়ে বেশ ব্যবধান তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এ ঝরে পড়ার কারণে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। যেমন পঞ্চম শ্রেণী শেষ করে ২০১৫ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও ইবতেদায়ি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল ৩০ লাখ ৪৮ হাজার ৫৪০ জন। স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারলে এদের সবারই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে যারা এইচএসসি ও সম্মানের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছে তাদের সংখ্যা মাত্র ১৩ লাখ ৫৯ হাজারের কিছু বেশি। অর্থাৎ ১৭ লাখ বা ৫৫ শতাংশ স্বাভাবিক পথ থেকে ছিটকে পড়েছে। বাল্যবিবাহ ও দারিদ্র্যই এক্ষেত্রে মুখ্য কারণ বলে জানা যায়। ফলে এদের অনেকেই আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ করতে পারবে না বা পারছে না। ভবিষ্যতে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজারে অংশগ্রহণটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

দ্বিতীয়ত, আমাদের শ্রমবাজারে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে যে শিক্ষা আমরা দিচ্ছি, তাতে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, শ্রমিকরা যে কর্মসংস্থানের জন্য তৈরি হচ্ছেন, তাতে দক্ষতার ক্ষেত্রে এক ধরনের অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। অর্থাৎ যে বিষয়ে একজন মানুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, শিক্ষা বা পাঠদান নিয়েছে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে ওই কাজে যুক্ত নয়। এক ধরনের ব্যবধান রয়ে গেছে। আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, টেকনিক্যাল বা ভোকেশনাল ট্রেনিং এখানে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে না। এটি আমাদের দেশে অত্যন্ত গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। সনাতন শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে টেকনিক্যাল শিক্ষার প্রতি আমাদের ‍গুরুত্ব দেয়া দরকার। 

এক্ষেত্রে প্রথম ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনের জন্য বেশি সময় আমাদের হাতে নেই। এখন এ সময়কে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ কিন্তু তৈরি হয়েছে, এটির সদ্ব্যবহার করতে হবে। এজন্য আমাদের কিছু নীতি গ্রহণ করতে হবে। এটি দীর্ঘায়িত করার জন্য নীতি-কৌশল প্রয়োজন হবে। 

এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যেসব দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনের ক্ষেত্রে সুবিধা পেয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের শ্রমবাজারের যে জনসংখ্যা রয়েছে, তাদের চাহিদা বা বৈশিষ্ট্য কী সেটি উপলব্ধি করা প্রয়োজন। যেহেতু বৈশ্বিক শ্রমবাজারের প্রেক্ষাপটে আমরা একটি পরিবর্তিত বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দীর্ঘায়িত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সেখানে লক্ষ করলে দেখা যাবে আমাদের যে স্থানীয় শ্রমবাজার সেখানে কী ধরনের কাজের চাহিদা রয়েছে। সরকারি (বিএমইটি) তথ্যে জানা যায়, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারেও দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ কোটি ৫৬ লাখ ৫২ হাজার ১৩৫ জন মানুষ ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিদেশে গিয়েছে। এক্ষেত্রে ৬২ শতাংশ মানুষ কিন্তু অদক্ষ, কম দক্ষ কাজে যুক্ত। অর্থাৎ আমরা পেশাদার দক্ষ অভিবাসী সেভাবে তৈরি করতে পারছি না। এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এছাড়া স্থানীয় ও বৈশ্বিক শ্রমবাজারে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণের হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আবার একইভাবে দেখতে পাচ্ছি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কাজ এসবের কোনোটির মধ্যেই নেই। সেখানেও দেখা যাচ্ছে, তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীরাই অধিকতর ভালনারেবল। এখন এ বাস্তবতায় আমাদের কী করা প্রয়োজন? ইতোপূর্বে যে দেশগুলো রয়েছে—যারা জনমিতিক লভ্যাংশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করেছে—সে দেশগুলোর অভিজ্ঞতা যদি কাজে লাগাতে হয় এক্ষেত্রে পূর্ব-এশিয়ার দেশগুলো উদাহরণ হতে পারে। যেমন ওই দেশগুলো গুণগত মানবসম্পদ, উচ্চ সঞ্চয় ও বিনিয়োগ, সাফল্যের সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও অনুকূল বিনিয়োগ আকর্ষণ, গুণগত পাবলিক প্রতিষ্ঠান তৈরি, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো ইত্যাদি। 

বাংলাদেশের বাস্তবতায় গুণগত মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে। বাজারে ‘স্কিল মিস ম্যাচ’ কমাতে হবে। দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে চাকরি নিশ্চিত করতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রতি বছরই কাঙ্ক্ষিত হারে চাকরির সংখ্যা বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, আমাদের যে বাজার ব্যবস্থা এখানে অনুকূল বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। চতুর্থত, পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে। 

শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশ কিন্তু জনমিতিক লভ্যাংশের সুযোগ এলেও তারা সেটি গ্রহণ করতে পারেনি। আমাদের হাতে যেহেতু সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন এ সুযোগ কাজে লাগাতে সঠিক কর্মকৌশল নিতে হবে। এখানে খেয়াল করতে হবে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য এ দুটো হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। যদি মানবসম্পদ তৈরি করতে চাই, আমরা বিভিন্ন গবেষণায় দেখেছি শিক্ষা, স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করলে তার ফলাফল কিন্তু ভালো আসবে। সেক্ষেত্রে আমাদের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা করা আছে। সেখানেও দেখা যায়, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জনমিতি লভ্যাংশের যেভাবে বরাদ্দের কথা চিন্তা করা হচ্ছে সেটি কিন্তু জনমিতি লভ্যাংশ অর্জনের জন্য সহায়ক নয়। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য এ দুটো যেহেতু ‍গুরুত্বপূর্ণ খাত। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ২০৪১ সালে জিডিপির ৪ শতাংশ শিক্ষায় ও ২ শতাংশ স্বাস্থ্যে বরাদ্দ আসবে। কিন্তু আমাদের দরকার এখন বিনিয়োগ করা। ২০৪১ সালে করা হলে সে উপকারিতা পাওয়া যাবে না। এর আগেই জনমিতি লভ্যাংশ অর্জনের কথা, কাজেই এখনই সময় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে জিডিপির বরাদ্দ বিনিয়োগ করার। এক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মকৌশল নিতে হবে। কাজেই সরকারকে এ বিষয়ে আরো দৃষ্টিপাত করতে হবে। পাশাপাশি বয়স্ক মানুষের সংখ্যাও আমাদের এখানে দ্রুত বাড়ছে। ভবিষ্যতে দ্বিতীয় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জন আমরা যেন সঠিকভাবে করতে পারি, এজন্য আমাদের এখন থেকেই কর্মকৌশল নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সেজন্য ভালনারেবিলিটির যে জায়গাটি বলছিলাম, অর্থাৎ বয়স্ক মানুষের আর্থিক, স্বাস্থ্য, সামাজিক ক্ষেত্র এ জায়গাগুলো আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে বয়স্ক মানুষের দক্ষতাও আনতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের শ্রম জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি, তবে ২০১৬-১৭ সালের জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৩১ শতাংশ মানুষ শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ করছে। দেশে দ্রুত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও বাড়ছে এবং সামনে আরো বাড়বে। সুতরাং এখানে সামাজিক নিরাপত্তা জাল, স্বাস্থ্যসেবা, সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিবান্ধব সেবা কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। দ্বিতীয় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের প্রস্তুতিও আমাদের নিতে হবে। মোটা দাগে বাংলাদেশের জন্য সামনে যে সুযোগটি রয়েছে, এটির সদ্ব্যবহার করতে হবে। এজন্য বিনিয়োগ করতে হবে, সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশলগুলো নিতে হবে। মনে রাখতে হবে এখনই সঠিক সময় বিনিয়োগ করার জন্য, তারপর এ সময় হারিয়ে যাবে। আমরা আর এ সময় ফিরে পাব না। একটি দেশের জন্য এ সুযোগ একবারই আসে। ফলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ বিবেচনায় নিয়ে সামনের কর্মকৌশলগুলো নিতে হবে। মানব পুঁজিকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হবে, সে অনুযায়ী আমাদের বিদ্যমান শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, জনসংখ্যা নীতি হালনাগাদ করতে হবে। এ নীতিগুলোর অধিকাংশই ২০১৫ সালের আগে তৈরি করা। জাতীয় দক্ষতা নীতি ২০২২ যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং বেসরকারি খাতকে অধিকতর সংযুক্ত করতে হবে। 

বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি চতুর্থ ও পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে আমাদের ভবিষ্যতের শ্রমবাজারের প্রেক্ষাপটে তরুণদের তৈরি করতে হবে। বাজারের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক শিক্ষা দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার, একাডেমিয়া ও ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে সমন্বয় লাগবে। সর্বোপরি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনের জন্য জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের সামনে এখন তিনটি ‘ডি’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড, ডেমোক্রেসি ও ডিমান্ড। এ ‘থ্রিডি’-এর জন্য কর্মকৌশল লাগবে। সেটি করতে গেলে আমাদের জনমিতিক, গণতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক—এ তিনের সমন্বয়ের মাধ্যমে যদি কর্মকৌশল নেয়া যায়, তাহলে মানুষের জীবনের মান ও অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং সে অনুযায়ী আমরা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়তো জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে পারব। এটি না করতে পারলে সেটি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড না হয়ে ডেমোগ্রাফিক বার্ডেন হয়ে যাবে। এমনটি যেন না হয়, এজন্য আমাদের কাজ করতে হবে। 

ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান

শ্রুতলিখন: তৌফিকুল ইসলাম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন