হাই-টেক পার্কে বিদেশী বিনিয়োগ

খুব বেশি প্রচার, খুব সামান্য অর্জন

শেখ তৌফিকুর রহমান

তথ্যপ্রযুক্তি খাত তথা হাই-টেক শিল্পের বিকাশে দেশব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করছে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। এরই অংশ হিসেবে সারা দেশে গড়ে তোলা হচ্ছে হাই-টেক পার্ক, আইটি পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার, আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর সেন্টার, ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। খাতটিতে এখন পর্যন্ত কিছু দেশী বিনিয়োগ হলেও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় দশকের বেশি সময়ে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ১৮ কোটি ডলার। 

আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে এ খাতে ৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশী বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এ বিষয়ে তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে আমাদের। সেই লক্ষ্যেই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।’

দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিদেশী বিনিয়োগের শ্লথগতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিদেশী বিনিয়োগ প্রতিনিয়তই বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ সামিট করেছি। ওটার কারণে নতুন নতুন স্টার্টআপ আসছে এবং ওই স্টার্টআপগুলোতে বিদেশীরা বিনিয়োগ করবে। এটার প্রতিফলন শিগগিরই দেখা যাবে।’

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বিভিন্ন সময় আইসিটি খাতের উন্নয়ন ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে দেশে-বিদেশে নানা সামিট, সেমিনার ও বৈঠকে অংশ নেন। সর্বশেষ গত ২১ আগস্ট ভারতের নয়াদিল্লিতে ইন্ডিয়ান কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিমের (সার্ট ইন্ডিয়া) মহাপরিচালক ড. সঞ্জয় বাহলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। এর আগে গত ২৫ এপ্রিল জাপান সফরে যান তিনি। সেখানে বাংলাদেশের হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার বিষয়ে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) চেয়ারম্যান ও সিইও নরিহিকো ইশিগুরুর সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়া চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি সৌদি সরকারের আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ডিজিটাল কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (ডিকো)’ দ্বিতীয় সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেন জুনাইদ আহমেদ পলক। গত বছরও তিনি থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে সফর করেন। যদিও এসব উদ্যোগ ও প্রয়াসের সুফল দেখা যাচ্ছে না তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিদেশী বিনিয়োগের পরিসংখ্যানে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কম্পিউটার, সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নিট বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে ১৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে ২০২০ সালে ৫৮ লাখ ডলার, ২০২১ সালে ১ কোটি ৪৪ লাখ এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে ১ কোটি ১৭ লাখ ডলার বিদেশী বিনিয়োগ আসে। 

আইসিটি-সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৯২টি তথ্যপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে, যার মধ্যে এখন পর্যন্ত ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয়েছে মাত্র আটটিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রফতানি আয়ের অংশটি সার্বিক সেবা খাতের ‘টেলিকমিউনিকেশন, কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের’ অংশ হিসেবে দেখানো হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ বাবদ রফতানি আয় হয়েছিল ৪৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এখান থেকে রফতানি হয়েছে ৭৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ)। বিএইচটিপিএর অধীনে বর্তমানে হাই-টেক পার্ক, আইটি পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারসহ মোট ৯২টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আইসিটি খাতের বৃহৎ পরিসরের উৎপাদন হাব হিসেবেই গড়ে তোলার লক্ষ্য থেকেই এসব প্রতিষ্ঠান নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি প্রকল্পের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে সংস্থাটি। এতে মোট ব্যয় হয়েছে ৭৮৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। এছাড়া আরো ১০টি প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ১২৯ কোটি ৯৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। 

কয়েক বছর ধরে প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে। এছাড়া সিলেট ও রাজশাহীতে নির্মিত হাই-টেক পার্কে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্বল্প পরিসরে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। এসব পার্কে খুব সামান্য পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে।

কালিয়াকৈরের হাই-টেক সিটিতে বড় পরিসরে সাতটি প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করেছে। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান আইওটি ডিভাইস, দুটি প্রতিষ্ঠান অপটিক্যাল ফাইবার ও দুটি প্রতিষ্ঠান সেলফোন তৈরি করছে। এর মধ্যে চীনভিত্তিক ওরিক্স বায়োটেক লিমিটেড পার্কটিতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে জায়গা বরাদ্দ নেয়। বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি থাকলেও এখন পর্যন্ত কার্যক্রম শুরু করেনি ওরিক্স বায়োটেক। 

বিদেশী বিনিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (গ্রেড-১) জিএসএম জাফরউল্লাহ্ (এনডিসি) বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে বিদেশী অনেক বড় কোম্পানি আমাদের দেশে অ্যাসেম্বল করছে। স্যামসাংয়ের মোবাইল এখন বাংলাদেশে অ্যাসেম্বল হচ্ছে। কয়েকদিন আগে সৌদি আরবের একটা দল পরিদর্শন করে গেছে, তারাও এখানে বিনিয়োগ করবে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে আরো বিনিয়োগ আসবে। তবে আশানুরূপ বিনিয়োগ হচ্ছে না, তার কারণ আমরা এখনো ডেভেলপমেন্টের পর্যায়ে রয়েছি।’ 

তিনি বলেন, ‘যশোরের সফটওয়্যার পার্ক ভালোভাবেই চলছে। শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারে আমাদের যুবসমাজ খুব ভালো কাজ করছে। এছাড়া সিলেটের আইটি পার্কে র‌্যাংগস গ্রুপও বিশাল কার্যক্রম শুরু করেছে। একটা ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে গেছে, অদূরভবিষ্যতে তা আরো বাড়বে বলে আমরা আশাবাদী।’ 

২০২৫ সাল পর্যন্ত বিদেশী বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, ‘এটা একেবারে টাকার পরিমাণে বলা সম্ভব না। তবে এখন যা আছে তার প্রায় দ্বিগুণ হবে। এটা অর্জনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

তবে প্রযুক্তি জ্ঞানে সীমাবদ্ধতা, দক্ষ জনশক্তি ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে প্রযুক্তি খাতে প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নয়ন হচ্ছে না বলে মনে করছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, বিদেশী বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার অন্যতম বড় কারণ দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ধীরগতি ও বিশ্বের সঙ্গে চাহিদায় তাল মেলাতে না পারা। 

বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান ও তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা ডা. তানজিবা রহমান বলেন, ‘ব্যবসায়িক মডেলের মধ্যে পরবর্তী ২০ বছর পরও চাহিদা থাকবে এমন পরিকল্পনা দেখাতে হয়। কিন্তু পাঁচ বছর পরই যদি কোনো পণ্য অকেজো হয়ে যায়, তাহলে মানুষ কেন বিনিয়োগ করবে। আমরা বিজনেস প্রবৃদ্ধি মডেল দেখাতে পারছি না। অবকাঠামো উন্নয়নে পিছিয়ে থাকার পাশাপাশি পরিকল্পনায় ভুল হচ্ছে আমাদের। বিদেশীদের চাহিদা কিংবা ১০ বছর পর কোন পণ্যের চাহিদা বাড়বে তা চিন্তা করছি না। শিক্ষিত স্নাতকদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা নেই। সর্বোপরি বাইরের চাহিদার সঙ্গে আমরা খাপ খাওয়াতে পারছি না। এ খাতে যারা কাজ করছেন তারা যথাযথ দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। সেজন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব কম টাকায় আমাদের কাজ করতে হয়।’

এ বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার কাছ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন