কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ৫২ আবেদন জমা

ডিজিটাল ব্যাংকের এত আবেদন কেন

হাছান আদনান

দেশে ব্যাংকের ছড়াছড়ির মধ্যেই ‘ডিজিটাল ব্যাংক’ গঠনের জন্য আবেদন আহ্বান করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সে আবেদনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোক্তারা হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। ডিজিটাল ব্যাংক করতে জমা পড়েছে ৫২টি আবেদন। যদিও ঠিক কয়টির অনুমোদন দেয়া হবে, সেটি নির্ধারণ করতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

ঠিক কী কারণে এত বেশি আবেদন জমা পড়ল, সেটি নিয়ে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিস্মিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের আবেদন ফি ছিল ৫ লাখ টাকা। এজন্য প্রযুক্তি খাতে কোনো অভিজ্ঞতা নেই এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোও লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করেছে। ফি বেশি হলে আবেদন হয়তো কিছুটা কমত। ৫২টি আবেদন পর্যালোচনা ও যাচাই-বাছাই করতে সময় লাগবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদই ঠিক করবে, ঠিক কয়টি ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হবে।’

আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ ও ব্যাংকারদের ভাষ্য হলো, ডিজিটাল ব্যাংক যেসব সেবা দেবে, সেগুলো বিদ্যমান ব্যাংকিং সেবার উন্নয়ন ঘটিয়েই দেয়া সম্ভব। তারা বলছেন, কয়েক বছর ধরে দেশের ব্যাংকগুলোর প্রযুক্তি সক্ষমতা বেড়েছে। ব্যাংকে না গিয়েও এখন গ্রাহক হিসাব খুলতে পারছেন। অর্থ জমা, উত্তোলন, স্থানান্তর, ঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়াও এখন ডিজিটাল। বেশির ভাগ ব্যাংক ডিজিটাল সেবা সহজ করতে অ্যাপস চালু করেছে। আবার মোবাইল ব্যাংকিং বা এমএফএসের মাধ্যমে যেকোনো মুহূর্তে লেনদেন করা যাচ্ছে। এ অবস্থায় ‘ডিজিটাল ব্যাংক’-এর লাইসেন্স অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ না করে ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে। 

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদ্যমান ব্যাংকগুলোই সুষ্ঠুভাবে তদারক করতে পারছে না। প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো ব্যাংক সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ বের হচ্ছে। ফলে ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থায় চিড় ধরেছে। এ অবস্থায় ডিজিটাল ব্যাংক অর্থনীতিতে ডিজিটাল স্ক্যাম তৈরি করার আশঙ্কাই বেশি। কেননা যদু-মধু-কদু সবাই ডিজিটাল ব্যাংক করার আবেদন করেছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেকে লাইসেন্স পেয়ে যাবে। তাদের কারণে যোগ্যরা বঞ্চিতও হবে।’ 

বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে দেশে বর্তমানে ৬১টি তফসিলি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ৪৩টি বেসরকারি খাতের। সরকারি বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত নয় ব্যাংকের পাশাপাশি বিদেশী নয়টি ব্যাংকও দেশে ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে গত এক দশকে এক ডজনের বেশি ব্যাংকের লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। যদিও খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার বিপক্ষে ছিল। কিন্তু সরকারের নির্দেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। ফলে দেশের ব্যাংক খাত দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি অসুস্থ প্রতিযোগিতা বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করে আসছেন।

অর্থনীতির চাহিদার তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও গত জুনের মাঝামাঝি সময়ে ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে গত ১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে ডিজিটাল ব্যাংক চালুর ঘোষণা দেন। জুনের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের লাইসেন্সের জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়। ১৭ আগস্ট ছিল আবেদনের শেষ দিন। ওইদিন পর্যন্ত ৫২টি আবেদন জমা পড়েছে। 

নীতিমালা অনুযায়ী, ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে ১২৫ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন থাকার শর্ত আরোপ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে ৫০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন থাকতে হয়। 

নীতিমালায় বলা হয়েছে, দেশে ডিজিটাল ব্যাংকের একটি প্রধান কার্যালয় থাকবে। এ কার্যালয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও সাপোর্ট স্টাফদের দপ্তর হিসেবে ব্যবহার হবে। পাশাপাশি সশরীরে বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে গ্রাহকের অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির কাজটি এ কেন্দ্রীয় দপ্তরে হবে। কিন্তু ডিজিটাল ব্যাংকগুলো প্রচলিত ব্যাংকের মতো সরাসরি কাউন্টারে গ্রাহকদের লেনদেনসেবা দিতে পারবে না। এ ব্যাংকের নিজস্ব কোনো শাখা, উপশাখা, এজেন্ট বা উইন্ডো থাকবে না। এমনকি নিজস্ব কোনো এটিএম, সিডিএম, সিআরএম বা স্পর্শযোগ্য ইনস্ট্রুমেন্ট থাকতে পারবে না। 

ডিজিটাল ব্যাংকে কেওয়াইসি পরিপালন করে গ্রাহক অনলাইনে হিসাব খুলবেন। হিসাব খোলার পর গ্রাহক ভিন্ন কোনো ব্যাংক বা এমএফএস এজেন্ট, এটিএম বুথ, সিডিএম, সিআরএম নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অনলাইনে অর্থ স্থানান্তর ও ব্যবহার করতে পারবেন। একই পদ্ধতিতে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা যাবে। লেনদেন সহজ করতে ডিজিটাল ব্যাংক ভার্চুয়াল কার্ড, কিউআর কোড বা অন্য কোনো অগ্রসরমাণ প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য চালু করতে পারবে। এ ব্যাংকের মাধ্যমে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, শিক্ষার্থীদের বেতন, সার্ভিস চার্জ, ট্রেজারি চালানসহ সরকারি বিভিন্ন ফি পরিশোধ করা যাবে। যদিও বর্তমানে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকেই এ ধরনের সেবা চালু রয়েছে। 

ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে আবেদন করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তফসিলি ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান (এমএফএস), মোবাইল অপারেটর, স্টার্টআপ কোম্পানি, গ্যাস পাম্প কোম্পানি, ওষুধ কোম্পানি, ঢেউ শিট উৎপাদনকারী কোম্পানিও রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। বিদেশী একাধিক প্রযুক্তি কোম্পানিও বিশেষ এ ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে আবেদন করেছে। 

ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে জোটবদ্ধ হয়ে আবেদন করেছে দেশের বেসরকারি খাতের ১০টি ব্যাংক। ‘ডিজি টেন পিএলসি’ নামে আবেদন করা ব্যাংকগুলো হলো সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলো ১২৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। 

বিদ্যমান অবকাঠামো দিয়েই তো এ ব্যাংকগুলো ডিজিটাল সেবা দিতে পারে, তাহলে নতুন করে ডিজিটাল ব্যাংক কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের কর্মীদের বড় অংশের মানসিকতা ডিজিটাল নয়। কিন্তু ডিজিটাল ব্যাংকে যেসব কর্মী নিয়োগ দেয়া হবে, তাদের লক্ষ্য, চিন্তাভাবনা সবকিছুই হবে ডিজিটাল। ডিজিটাল ব্যাংকের মাধ্যমে আমরা স্বল্প খরচে দেশের প্রান্তিক মানুষের কাছে সেবা পৌঁছাতে পারব। এজন্যই ১০টি ব্যাংক মিলে আমরা আবেদন করেছি। 

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মতো জোটবদ্ধ হয়ে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে আবেদন করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংক। এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ, উপায় ও নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য আবেদন করেছে। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) মোবাইল আর্থিক সেবাদানকারী কোম্পানি উপায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এনআরবিসি ও মেঘনা। আমার ব্যাংক নামে ডিজিটাল ব্যাংক পেতে আবেদন করেছেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী মসিউর রহমান। আবার মোবাইল ফোন অপারেটর বাংলালিংক ও তাদের মূল কোম্পানি ভিওন মিলেও ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের আবেদন জমা দিয়েছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌অনেকেই ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের ধান্ধা করছেন। এ কারণে বুঝে, না বুঝে বিশেষ ধরনের এ ব্যাংকের লাইসেন্সের আবেদন করেছে। তারা জানেও না ডিজিটাল ব্যাংক কী? এটি দিয়ে কী হবে? এমএফএস সেবার লাইসেন্স দেয়ার সময়ও ব্যাংকগুলো না বুঝে লাইসেন্স নিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দু-তিনটি ছাড়া সব ব্যাংকের বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রেও একই পরিণতি হয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন