নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের সুরক্ষায় কাজ করছে ইডকল

নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ অবকাঠামো খাতে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড বা ইডকলের বিনিয়োগ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু করে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এ খাতের নানা দিক নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন ইডকলের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলমগীর মোরসেদ

নবায়নযোগ্য খাতে আগামীতে ইডকলের বড় বিনিয়োগ পরিকল্পনা কী? 

১৯৯৭ সালে ইডকলের যাত্রা শুরু। ইডকলের কার্যক্রম নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগ, এ খাতের পরামর্শ ও এনার্জি দক্ষতা তৈরি করা। ২৬ বছর ধরে ইডকল সেই কাজ করছে। ক্লাইমেট ফাইন্যান্সের প্রধান লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য খাত থেকে ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সক্ষমতা এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। ইডকল সেই লক্ষ্য অর্জনে ফ্রন্টলাইনে কাজ করছে। আগামী তিন-পাঁচ বছরের মধ্যে কীভাবে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের অংশগ্রহণ বাড়ানো যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছে। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, একটি প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। এ ধরনের কাজে লক্ষ্যপূরণ করতে হলে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করা দরকার, সেখানে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে। 

সরকার পাঁচ বা আট বছর মেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা করছে। ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করছে। এসব জায়গায় বেসরকারি খাতকে বড় করে হাইলাইট করা হয়েছে। আমাদের এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে সরকারের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও শিল্পগুলোর বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। সেটা নিয়েই আমরা কাজ করছি। 

আমরা মূলত যেটা করি, সেটি হলো একটা নির্দিষ্ট প্রজেক্টে, যেখানে জলবায়ুর সরাসরি প্রভাব রয়েছে, তা মোকাবেলার জন্য যে ধরনের অবকাঠামো প্রয়োজন সেখানে শুরুতেই উৎসাহ দিই। সেটিকে দাঁড় করানো এবং অর্থনৈতিকভাবে সেটি কীভাবে উপযোগী করে তোলা যায় সেই ট্রানজিশনে আমরা সহায়তা করি। একটা প্রজেক্ট যখন কমার্শিয়ালি ভায়াবল হয়ে যাবে, তখন আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসি। এই ট্রানজিশন ফাইন্যান্সটাকে আমরা সাপোর্ট করি। 

নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে রুফটপ সোলার এখন কমার্শিয়ালি ভায়াবল। এ খাতে বেসরকারি খাত সুবিধা পাচ্ছে, উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। ইডকলে রুফটপের রেসপন্সটা কী পাচ্ছেন? 

রুফটপ সোলার তিন বছর আগে আমরা শুরু করি। এটা নিয়ে অনেক ধরনের মতামত, পারসেপশন ছিল। এমনকি গত বছর পর্যন্ত এটির বিষয়ে পজিটিভ রেসপন্স ছিল না। কিন্তু ট্যারিফ চেঞ্জ হওয়ার পর এখন এটি লাভজনক বিনিয়োগ হয়ে গেছে। গত তিন-চার বছরে আমরা যে কাজটা করছি তা হলো রুফটপ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, রুফটপের টেকনোলজি, ক্লাইমেট চেঞ্জের ইমপ্যাক্টটা কী, টেকনিক্যাল ইকোসিস্টেমটা তৈরি করা এবং প্রকৌশলী তৈরি করা; সেই জায়গায় আমরা কাজ করছি। আজকে ইকোসিস্টেমটা দাঁড়িয়েছে। মজার বিষয় হলো বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণকারী যারা রয়েছে, অপারেটর হোক, বিনিয়োগকারী কিংবা কমার্শিয়াল ব্যাংক তারাও কিন্তু সোলার রুফটপের বিজনেস মডেল গ্রহণ করেছে। আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানির বড় উৎস সোলার দাঁড়িয়ে গেছে। এখানে যে বিনিয়োগ সেটি কিন্তু এখন তৈরি হয়েছে। আমি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এবং কিছুটা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে ইডকল এক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। না হলে সম্ভবত আমরা এ পর্যায়ে আসতে পারতাম না। 

নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে এখন পর্যন্ত সৌরবিদ্যুতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। বায়ু ও জলবিদ্যুৎসহ অন্যান্য খাতেও বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন। সৌরবিদ্যুতের বাইরে এ খাতগুলোতে আপনাদের বিনিয়োগ পরিকল্পনা কী? 

বাংলাদেশে বায়ুবিদ্যুতের যে সম্ভাবনা তা এখনো গবেষণা পর্যায়ে আছে। এটা নিয়ে মিশ্র মতামত দেখছি আমরা। এটি আদৌ কার্যকর হবে কিনা সে বিষয়ে এখনো তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। আমরা যদি আশা পাই যে বায়ুবিদ্যুতের একটি বড় সম্ভাবনা আছে, যদি ভায়াবল প্রজেক্ট পাওয়া যায় তাহলে আমরাও সেখানে বিনিয়োগ করব। তবে এখনো সেই স্টেজে আমরা আসিনি। সোলারের বাইরে অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের জন্য আমরা এখনো সেভাবে প্রস্তুত না। 

২০১০ সালে সরকার বিদ্যুৎ খাতে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করে। এ পরিকল্পনায় ২০২১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ সক্ষমতার ১০ শতাংশ এ খাত থেকে আসার কথা ছিল। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রা এখনো অর্জন হয়নি। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব ছিল কি? 

বিনিয়োগের অভাব তো অবশ্যই ছিল। এ খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন ছিল। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তখনই আসবে যখন এটির মধ্যে প্রণোদনা থাকবে। এসব প্রতিষ্ঠান মূলত লাভের উদ্দেশ্যেই বিনিয়োগ করবে। তবে বর্তমানে এ খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসছে। বিনিয়োগের যে ইতিবাচক প্রবণতা তৈরি হয়েছে তাতে ১০ শতাংশ না হলেও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সক্ষমতার লক্ষ্যমাত্রা কাছাকাছি চলে আসবে। 

নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সচেতনতা তৈরিতে কী কাজ করছে ইডকল? 

বুয়েটসহ প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় টপিক। এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে এবং এটির প্রতি আগ্রহও বাড়ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আরেকটি বড় দিক হলো দৃষ্টিভঙ্গি। বৈশ্বিকভাবে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটায় রুফটপ সোলার ব্যবহারকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়েছে। ইডকল সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচুর কাজ করে। একটি সোলার রুফটপ স্থাপন করলে এখন প্রতি কিলোওয়াটে ২ থেকে ৩ টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। অর্থাৎ এ খাতে যে অর্থনৈতিক মূল্য ও সুবিধা আছে সে বিষয়টিও আমরা ব্যবহারকারীদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের গার্মেন্টস খাতে এখন সোলার রুফটপের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি এবং সবাই এটি গ্রহণ করছে। 

নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ইডকল এখন কস্ট ইফেক্টিভ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। যেখানে খরচ কম হয় সেই জায়গাগুলোয় ক্লিন এনার্জির প্রসার বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আপনি যদি ইরিগেশন সাইটে যান, সেখানে যে ডিজেলচালিত পাম্প রয়েছে সেখানে আমরা সোলার পাম্প চালু করেছি। ডিজেলচালিত পাম্পের চেয়ে সোলারচালিত পাম্পগুলো অনেক বেশি বেনিফিশিয়ারি (লাভজনক)। 

ইডকলের জন্মলগ্ন থেকে প্রতিষ্ঠানটি অবকাঠামোতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে। শুরুতেই মেঘনাঘাটে ৪৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিনিয়োগ ছিল। আজকে দুই দশক পরও ইডকল কি এখনো অবকাঠামোতে বেশি বিনিয়োগ করছে? নাকি প্রযুক্তিগত জায়গায়ও বিনিয়োগ করছে? 

আমাদের পোর্টফোলিওটা অনেকটাই ব্যালান্সড। আমরা শুরু করি ১৯৯৭ সালে। তখন বিদ্যুৎ খাতটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিনিয়োগটাও ঠিক ওই সেক্টরেই হয়েছে। কিন্তু ওভারটাইম ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সংজ্ঞাটা অনেক বড়। পাওয়ার সেক্টরে অনেক হার্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে। হাইওয়ে, ব্রিজ, সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন হচ্ছে। সেখানেও আমাদের অনেক বিনিয়োগ রয়েছে। আমরা সম্প্রতি একটি রোড প্রজেক্টে বিনিয়োগ করেছি। সাড়ে ১৩ কিলোমিটারের রামপুরা থেকে ডেমরা এক্সপ্রেসওয়েতে বিনিয়োগ করেছি। আমাদের একটা কমিটমেন্ট হলো পিপি প্রজেক্টে সাপোর্ট দেয়া। আমরা সামাজিক উন্নয়নমূলক অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করছি। যেমন হাসপাতালে আমরা বিনিয়োগ করছি। 

আমরা ইনফ্রাস্ট্রাকচার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং এ খাতের জ্বালানি দক্ষতা নিয়ে কাজ করছি। কনস্ট্রাকশনে যেসব গ্রিন বিল্ডিং রয়েছে, গ্রিন কম্পোনেন্ট এনার্জি এফিশিয়েন্সি যেখানে সাপোর্ট দেয় সেখানে আমরা বিনিয়োগ করছি। 

বেসরকারি খাত এগিয়ে আসার জন্য এবং এ খাতে বড় আকারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইডকলের দিক থেকে কোনো পরামর্শ আছে কি? 

এ খাতে ব্যাংকিং বিনিয়োগের প্যারামিটার রয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্র যেন টেকসই হয় সেজন্য গ্রিন ফাইন্যান্সকে আরো প্রমোট করা যায়। সেখানে আমার মনে হয়, সেই প্যারামিটারগুলোর মোডিফিকেশন দরকার। দ্বিতীয়ত, আমাদের যে ইনসেনটিভগুলো রয়েছে সেগুলো আমাদের পলিসিতে আরো বাড়ানো দরকার। সেটা নিয়ে পলিসিমেকাররাও ভাবছেন। সেটা অনেকভাবেই দেয়া যেতে পারে। সবসময় যে ট্যাক্স ইনসেনটিভ দিতে হবে এমনটি নয়। এর বাইরে অন্য ধরনের ইনসেনটিভ দেয়া যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। দিন শেষে একটি বিষয় আমরা স্বীকার করি যে জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব এটা মোকাবেলা করা এবং খাপ খাওয়ানো ছাড়া এখন তো আর কোনো পথ নেই। বিষয়টি যদি আমরা এখন উপলব্ধি করি, তাহলে এটিকে সামনে রেখে আমাদের বিনিয়োগগুলোকেও সেভাবে এগিয়ে নিতে হবে। 

নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি, এ খাতের গবেষণা আমাদের দেশে এখনো পর্যাপ্ত নয়। যে কারণে মাইগ্রেট করে এ ধরনের প্রযুক্তি আমাদের দেশে আসছে, অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে এ খাতের দক্ষতা ও গবেষণা বাড়াতে বেসরকারি খাত কী করতে পারে? 

নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বেসরকারি খাত গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে পারে। আমাদের দেশে বেসরকারি খাত ব্যাপকভাবে আরএনডিতে বিনিয়োগ করে। বিভিন্ন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়কে এ খাতে অন্তর্ভুক্ত করে পার্টনারশিপের মাধ্যমে কাজ করা যেতে পারে। কারণ আমরা যেসব টেকনোলজি দেশে নিয়ে এসেছি, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সেই ধরনের প্রযুক্তি শতভাগ কাজ করবে কিনা বা করছে কিনা সেটি গবেষণা হওয়া দরকার। আমাদের দেশে এবং ইউরোপের সূর্যের রেডিয়েশনের মাত্রা কিন্তু এক নয়। ফলে আমাদের দেশের জন্য কোন টেকনোলজি ফলপ্রসূ হবে, সেটার একটা কাস্টমাইজেশনের ব্যাপার রয়েছে। সেখানে আমাদের দেশের যারা গবেষক রয়েছেন, তাদের যদি সাপোর্ট দেয়া যায়, সেখানে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বেশ জোরালোভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। যেটা বাইরের দেশে কিন্তু অনেক বেশি ও কমন। উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু বিভিন্ন ধরনের করপোরেট প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন