সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি কমছে, বাংলাদেশে নয়

হাছান আদনান ও ইয়াহইয়া নকিব

দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত অগ্রসরমাণ দেশ শ্রীলংকা নজিরবিহীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছে। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল গত বছর। দ্বীপরাষ্ট্রটির মূল্যস্ফীতির হার ঠেকেছিল প্রায় ৬০ শতাংশে। রিজার্ভ সংকটে জ্বালানি তেলের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যটিও আমদানি করা সম্ভব হচ্ছিল না। আমদানি দায় আর বিদেশী ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় নিজেদের দেউলিয়াও ঘোষণা করেছিল দেশটির সরকার। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক সে পরিস্থিতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠছে শ্রীলংকা। মূল্যস্ফীতির হার কমতে কমতে গত জুনে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের মূল্যস্ফীতিও দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। জুনে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি কমেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয়ও। কিন্তু এক্ষেত্রে একেবারেই বিপরীত অবস্থান বাংলাদেশের। গত বছরের জুনে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর সেই হার ক্রমাগত বেড়েছে। চলতি বছরের জুনেও মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। 

কভিড-১৯ সৃষ্ট বৈশ্বিক দুর্যোগ আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামায় ২০২২ সালের শুরুতে তেতে ওঠে বিশ্বের পণ্যবাজার। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। অস্বাভাবিক হারে বাড়ে কয়লা, গ্যাসসহ অন্যান্য জ্বালানি পণ্যের দামও। একই সঙ্গে বাড়ে ভোজ্যতেল, গমসহ অতিপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম। এর সঙ্গে যুক্ত হয় অস্বাভাবিক পরিবহন ব্যয়। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সংকটে পড়ে বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কিন্তু গত ছয় মাসে প্রায় সব দেশেরই মূল্যস্ফীতির চিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও কমতে কমতে ব্যারেলপ্রতি ৭০ ডলারে নেমে এসেছে। ভোজ্যতেল, খাদ্যশস্য, সার, কৃষি খাতের কাঁচামাল, সার এবং ব্যবহারিক বা শিল্প ধাতুর মূল্যও টানা কয়েক মাস ধরে কমছে। কডিভ-পূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরেছে ভোগ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম কমলেও বিপরীত চিত্র দেশের বাজারে। বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যসহ সব পণ্যের দাম এখনো অস্থিতিশীল। ফলে নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতির হার।

দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে তা কমানো সম্ভব হচ্ছে না কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি অগভীর। ঢেউ বেশি ওঠে। তাই সামান্যতেই আমাদের অর্থনীতি কেঁপে ওঠে। তবে জুনে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি স্বস্তির।’ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত আছে জানিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘ইংল্যান্ডের মতো দেশে মূল্যস্ফীতি আমাদের কাছাকাছি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশে এখনো আগের অর্ডার করা পণ্যই আসছে। তাই বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রভাব এখনই দেখা যাচ্ছে না।’ 

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর অবশ্য মনে করেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘কোনো দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে যেসব উদ্যোগের মাধ্যমে সেটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়, বাংলাদেশে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে রাখা হয়। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়।’  

তিনি বলেন, ‘জ্বালানি তেলসহ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম কমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে তার কোনো প্রভাব নেই। যেসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে, সেগুলো আর কখনো কমবে বলে মনে হয় না। কারণ দেশের বাজার ব্যবস্থার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’ 

বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক উপাত্ত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য বলছে, চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে মূল্যস্ফীতি কমেছে। ২০২২ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। এর পর থেকে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার কমছে। গত ডিসেম্বরে সেই হার নেমে আসে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে। আর জুনে মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো নিয়ন্ত্রিত না হলেও মূল্যস্ফীতি কমছে যুক্তরাজ্যে। গত বছরের জুনে ইউরোপের শক্তিশালী অর্থনীতির দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। এরপর ডিসেম্বরে তা বেড়ে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়। কিন্তু চলতি বছরের জুনে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মূল্যস্ফীতিও কমছে দ্রুতগতিতে। গত বছরের জুনে দেশটিতে সেই হার ছিল ৭ শতাংশ। ডিসেম্বরে এ হার কমে ৫ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে আসে। আর জুনে এসে ভারতের মূল্যস্ফীতি ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমেছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) তথ্য বলছে, জুনে ভারতের মূল্যস্ফীতির হার ছিল গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২১ সালের এপ্রিলে চলতি বছরের জুনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেশি ছিল।

ভারত ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মূল্যস্ফীতিও নিম্নমুখী। এক্ষেত্রে কেবল ব্যতিক্রম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে পর্যুদস্ত পাকিস্তান। গত বছরের জুনে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আর চলতি বছরের জুনে এসে সেই হার ৩৭ দশমিক ৯৭ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন দাতা সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে পাকিস্তান সরকার।

বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রায় দুই বছর ধরে চাপে আছে বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। এক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। রেকর্ড আমদানি ও বিদেশী ঋণের দায় পরিশোধ করতে গিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় হতে শুরু করে। ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া রিজার্ভ এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। এ সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গত বছরের শুরুতেও দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা। বর্তমানে আন্তঃব্যাংক লেনদেনেই প্রতি ডলার ১০৯ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। সে হিসাবে এ সময়ে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। এটিও মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, সদ্য শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল এক যুগের সর্বোচ্চ, ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর পর থেকে সেই হার ধারাবাহিকভাবে কমে ২০২০-২১ অর্থবছরে সাড়ে ৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে তা আবার বাড়তে থাকে।

গতকাল প্রকাশ করা তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জুনে দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর আগে মে মাসে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। ওই মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। জুনে সেই হার কিছুটা কমলেও বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। জুনে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ হয়েছে, মে মাসে যা ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।

দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ এ ফেলো বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে আমদানি থেকে ভোক্তা এবং উৎপাদন স্তর থেকে ভোক্তা স্তরে বাজার ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। চাহিদা ও সরবরাহ, সরকারের নিজস্ব মজুদ এবং আমদানির মধ্যে সমন্বয় থাকলে হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি কিছুটা কমানো যেত।’  

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সঙ্গেও মূল্যস্ফীতি না কমার সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করছেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা আমদানির এলসি খুলতে পারছেন না। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোরও আমদানির সক্ষমতা কমে গেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগতভাবে ক্ষয় হচ্ছে। এর সঙ্গে মুদ্রা সরবরাহ ব্যবস্থারও সম্পর্ক আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন অর্থবছরের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দেয়া হয়েছে। তবে বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক না করলে এটা দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে না।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন