মুডি’স রেটিংয়ে অবনমন

বিদেশী ঋণের সুদ ও এলসি কমিশন বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা

হাছান আদনান

আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দেয়ার পরদিনই এর বিরূপ প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে গতকালই আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে ঋণসীমা বা ক্রেডিট লাইন স্থগিত করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) আবুধাবি ইসলামিক ব্যাংক (এডিআইবি)। বাংলাদেশের অন্তত ২০টি ব্যাংকের সঙ্গে ইউএইর বৃহৎ এ ব্যাংকটির ক্রেডিট লাইন রয়েছে। আবুধাবি ইসলামিক ব্যাংকের মতো বিশ্বের অন্য বৃহৎ ব্যাংকগুলোও বাংলাদেশে নিজেদের ঋণসীমা পুনর্বিবেচনার কথা জানাচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এ-সংক্রান্ত চিঠি প্রাপ্তির আশঙ্কা করছেন দেশের ব্যাংক নির্বাহীরা।

বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পাদন ও দেশের ব্যবসায়ীদের বিদেশী মুদ্রায় ঋণ দেয়ার জন্য বিদেশী ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণসীমা নেয়া হয়। এ ঋণসীমা ব্যবহার করেই আমদানি-রফতানি ঋণপত্রের (এলসি) নিশ্চয়তা দেয় দেশের ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি এর আওতায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি তহবিল এনে দেশের ব্যবসায়ীদের বিদেশী মুদ্রায়ও ঋণ দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের কান্ট্রি রেটিং অবনমনের পর এবার সাতটি বেসরকারি ব্যাংকেরও রেটিং অবনমন করে দিয়েছে মুডি’স। রেটিং অবনমন হওয়া ব্যাংকগুলো হলো ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড, এনসিসি ব্যাংক লিমিটেড ও প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড। এ তালিকায় মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নামও রয়েছে। বৈদেশিক ও স্থানীয় মুদ্রায় ‘দীর্ঘমেয়াদি ডিপোজিট’ ও ‘ইস্যুয়ার রেটিং’য়ের ক্ষেত্রে এ অবনমন করা হয়েছে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে মুডি’স জানিয়েছে। দেশের কেবল এ আটটি ব্যাংকই মার্কিন ঋণমান প্রতিষ্ঠানটিকে দিয়ে রেটিং করিয়েছিল। মুডি’সের পক্ষ থেকে গত ডিসেম্বরে এসব ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি রেটিং পুনর্মূল্যায়নের ঘোষণা দেয়া হয়। 

ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে দেশের ব্যাংকগুলো অনেক আগে থেকেই আমদানির এলসি দায় পরিশোধের চাপে আছে। এ অবস্থায় বিদেশী ব্যাংকগুলো ঋণসীমা স্থগিত বা প্রত্যাহার করলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। মুডি’স কর্তৃক দেশের ঋণমান কমিয়ে দেয়ার প্রভাবে এলসি কমিশন ও ফি বেড়ে যাবে। বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের সুদহারও বাড়বে। এতদিন সুদহার ও কমিশন কমানোর জন্য যে দরকষাকষির সুযোগ ছিল, সেটিও কমে যাবে। এখন বিদেশী ব্যাংকগুলো এলসি ও বিদেশী ঋণের মেয়াদ বাড়াতে চাইবে না। দেশের অন্তত পাঁচটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বণিক বার্তাকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

প্রায় একই কথা বলছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) এ শীর্ষ নির্বাহী বলেন, ‘দেশের রেটিং অবনমনের ক্ষতির দিক নানামুখী। দেশের ঋণমান ভালো হলে এলসির কমিশন ও ফি কম হয়। পাশাপাশি স্বল্প সুদে বিদেশী ঋণও আনা যায়। এক্ষেত্রে বিদেশী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি করার সুযোগ থাকে। কিন্তু এখন দেশের ঋণমান অবনমন করে দেয়ায় এসব সুযোগ সীমিত হয়ে আসবে। এলসি কমিশন ও ফি বেড়ে যাবে। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমরা ঋণ এনে দেশের ব্যবসায়ীদের দিয়েছি, সেগুলোর নবায়ন করা কঠিন হবে। নবায়নের সময় সুদহারও বাড়িয়ে দিতে পারে।’ 

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ডলার সংকটের কারণে চাপে আছে বাংলাদেশ। এ পরিস্থিতিতে বিদেশী ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে দেয়া স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রত্যাহারের চাপ বাড়ায়। আবার ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়নের কারণেও অনেক ব্যবসায়ী তড়িঘড়ি করে বিদেশী ঋণ পরিশোধ করে দেয়। এ কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ হ্রাস পায় ৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন (৩৬৭ কোটি) ডলার। ২০২২ সালের জুন শেষে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের মার্চ শেষে স্বল্পমেয়াদি এ বিদেশী ঋণের পরিমাণ ১৪ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। দেশের ঋণমান কমিয়ে দেয়ায় এখন এসব বিদেশী ঋণ নবায়ন করা আরো কঠিন হয়ে যাবে।

দেশের বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি সবচেয়ে বেশি বিদেশী ঋণ এসেছে সিঙ্গাপুর থেকে। দেশটির বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ এসেছে ৩১২ কোটি ৫২ লাখ ডলার। দ্বিতীয় স্থানে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাম। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিরও ২৩২ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের ঋণ দেশের বেসরকারি খাতে রয়েছে। বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণের উৎস অন্য দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্য থেকে ১০০ কোটি ২৯ লাখ, হংকং থেকে ৯২ কোটি ৫৬ লাখ, চীন থেকে ৮২ কোটি ৩৮ লাখ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬৯ কোটি ৯৪ লাখ, ভারত থেকে ৬৫ কোটি ৬০ লাখ ও জার্মানি থেকে ৫৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার ঋণ এসেছে। বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের উৎস অন্য দেশগুলো হলো মরিশাস, জাপান, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ওমান, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান। সব মিলিয়ে চলতি বছরের মার্চ শেষে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪০৮ কোটি ডলার। তবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মিলিয়ে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার।

মুডি’স বাংলাদেশের ঋণমান অবনমন করার একদিন পরই বুধবার আবুধাবি ইসলামিক ব্যাংকের (এডিআইবি) কাছ থেকে ঋণসীমা স্থগিতের চিঠি পাঠানো হয়। দেশের তিনটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী এ চিঠি পেয়েছেন বলে বণিক বার্তাকে নিশ্চিত করেছেন। এর মধ্যে একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, ‘এডিআইবির সঙ্গে আমাদের ব্যাংকের ৩ কোটি ডলারের ঋণসীমা রয়েছে। দেশের অন্তত ২০টি ব্যাংকের সঙ্গে এডিআইবি ব্যবসা করে। সে হিসাবে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে দেয়া আমিরাতের ব্যাংকটির ঋণ প্রায় ৫০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের ঋণমান অবনমনের বিষয়টি উল্লেখ করেই ঋণসীমা স্থগিতের বিষয়টি জানানো হয়েছে। এখন বিশ্বের অন্য বৃহৎ ব্যাংকগুলোও একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে দেশের গোটা বৈদেশিক বাণিজ্যই হুমকির মুখে পড়বে।’

মুডি’স যেসব ব্যাংকের রেটিং অবনমন করেছে তার অন্যতম ব্র্যাক ব্যাংক। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের রেটিং খারাপ হওয়ার প্রভাবেই ব্র্যাক ব্যাংকের রেটিংয়ে অবনমন হয়েছে। কারণ একটি দেশের রেটিংয়ের চেয়ে ওই দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের রেটিং ভালো হতে পারে না। এমনিতেই বিশ্ববাজারে এখন সুদের হার চড়া। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সুদের হার বাড়াতে বাড়াতে ৫-৬ শতাংশে উন্নীত করেছে। এ কারণে বিদেশী ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপ-আমেরিকায় বিনিয়োগে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। মুডি’স দেশের ঋণমান অবনমন করায় বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিদেশী ঋণ আনার শর্ত আরো কঠিন হয়ে যাবে।’

চলতি অর্থবছরে রেকর্ড এলসি নিষ্পত্তির চাপে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৫ থেকে বেড়ে ১১৪ টাকা পর্যন্ত ওঠে। আর খুচরা বাজারে তা উঠে যায় ১২০ টাকা পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে ডলারের বিনিময় হার বর্তমানে কিছুটা কমে এসেছে। ব্যাংক খাতে গতকাল প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় হার ছিল ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। তবে কার্ব মার্কেট বা খুচরা বাজারে এখনো প্রতি ডলার ১১২-১১৪ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।

আমদানি দায়ের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য অব্যাহতভাবে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভ থেকে গত অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। আর চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে প্রায় সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েই চলছে। ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়নে উন্নীত হওয়া রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

বৈদেশিক মুদ্রার এ সংকটের মধ্যেই মঙ্গলবার বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ-তে নামিয়ে দিয়েছে মুডি’স। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে চলমান সংকটের মধ্যে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। এ কারণে মুডি’স বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে।

তবে মুডি’স ঋণমান কমালেও দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় কোনো ক্ষতি দেখছেন না আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক মো. সিদ্দিকুর রহমান। বণিক বার্তাকে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় আসছে, সেটি দিয়ে আমদানি দায় মেটানো সম্ভব হচ্ছে। এ কারণে মুডি’সের ঋণমান অবনমন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় কোনো ক্ষতি করবে বলে মনে করছি না। কডিভ-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির ধারায় ছিল। আমদানি কমিয়ে দেশীয় পণ্যের উৎপাদন ও ভোগ বাড়ানো সম্ভব হলে দেশের অর্থনীতি আরো সুসংহত হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন