আলোকপাত

টাকার সংকট! আলো-আঁধারের স্ফুরণ

ড. এ কে এনামুল হক

দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন। কেউ বলছেন টাকা দেশে নেই। সব চলে গেছে। আবার কেউ বলেন দেশ অনেক ভালো আছে। উন্নয়নের দৃষ্টান্ত। খোদ মার্কিন কংগ্রেস তার স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্লেষণবিহীন এসব আলোচনা বা সমালোচনা কেবল মুখরোচক। আমরা সবাই জানি, প্রদীপের নিচেই অন্ধকার অর্থাৎ সব মুদ্রারই দুই পিঠ। একটি আঁধার, অন্যটি আলোকিত। অতএব এ ধরনের স্বীকৃতি তারই বহিঃপ্রকাশ। সবাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজের দিকটাই দেখেন। আমার আজকের আলোচনা এ আলো-আঁধারে কিছুটা স্ফুরণ কাটা। 

কিছুদিন আগে চলছিল একটি সাক্ষাৎকার। আমিও সেই বোর্ডে ছিলাম। এক বন্ধুবর চাকরিপ্রার্থীকে প্রশ্নটি করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে পত্রপত্রিকা বা ফেসবুক জাতীয় পোর্টালে অনেকে লিখে যে দেশের ব্যাংক খালি, টাকা দেশে নেই। ব্যাংকে টাকার অভাব। এ নিয়ে আপনার মতামত কী? বিব্রতকর অবস্থা চাকরিপ্রার্থীর কী বলতে কী হয়! সে বুঝতে পারছে না উত্তর দেবে কি দেবে না। ইতস্তত-বিব্রত চেহারা। বুঝিনি স্যার। আবার প্রশ্নটি করুন। বুঝলেন না, অনেকে বলছেন দেশ থেকে টাকা প্লেনে করে চলে গেছে, তাই ব্যাংক খালি। আপনি কী মনে করেন? বেচারা! উত্তর দিতে চাচ্ছে না। কিন্তু প্রশ্নকর্তা নাছোড়বান্দা। উত্তর চাই। জি স্যার। মানে কী? টাকা হয়তোবা চলে গেছে তাই ব্যাংক ফাঁকা। আপনিও কি তা মনে করেন? হুম! হতে পারে। বলুন কীভাবে তা সম্ভব? টাকা দেশের বাইরে নিয়ে কী করবে? অন্য কোন দেশে বাংলাদেশের টাকা চলে? না। তাহলে? তাই তো লোকে বলে স্যার। না, তা নয় আমার প্রশ্ন—আপনার কি মনে হয়? যদি সত্য মনে করেন যে টাকা বিদেশে চলে গেছে তবে টাকা কেন যাবে? স্যার ডলার করে নিয়ে গেছে। তাহলে ব্যাংকে টাকা নেই কেন? টাকা তো বিদেশে যায়নি! জি স্যার। এখানেই থামি। বুঝতেই পারছেন যে টাকার বিদেশ ভ্রমণ ধোপে টেকে না। ধরুন আপনি বিদেশ পাড়ি দেবেন। দেশকে ভালো লাগে না কিংবা দেশে থাকতে ভয় পাচ্ছেন। কখন কে ধরে নিয়ে যায় কিংবা কখন সরকার বদল হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কী করবেন? তার আগে মনে পড়ে গেল আরেকটি সাক্ষাৎকারের ঘটনা। সেখানে চাকরিপ্রার্থীর জীবনবৃত্তান্ত সামনে। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যে নাকি খোদ মার্কিন সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন চাকরি করতেন তিনি চাকরি চাচ্ছেন। লোকে দেশ ছাড়ছে! আর ইনি কিনা সেখান থেকে দেশে ফেরত এসেছেন। লোভনীয় চাকরি ছেড়ে। উপস্থিত অনেকেরই ভ্রু কুঁচকালো। প্রশ্নোত্তরের একপর্যায়ে জানা গেল, সহায়-সম্পত্তির কারণে দেশে এসেছেন। অর্থাৎ দেশের সহায়-সম্পত্তি এতই বেশি যে খোদ মার্কিন সরকারের উচ্চপদস্থ পদ ছেড়ে সম্পত্তির দেখভাল করতে দেশে এসেছেন। দেশে থাকতে ভালো লাগে। পুত্র-কন্যা কিংবা স্ত্রী কোথায় থাকেন? ওরা আসেনি। হুম! কী করবেন এ সম্পত্তি নিয়ে? ধীরে ধীরে ছেড়ে দিচ্ছি। বুঝতেই পারলাম তিনিও সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা পাবেন। টাকা কীভাবে নেবেন বিদেশে? অবশ্যই ডলার করে বিদেশ নিয়ে যাবেন। একটু ভাবুন,–‘‌ক’ তার সম্পত্তি ‘‌খ’-এর কাছে বিক্রি করল। ‘‌খ’ সম্পত্তির দাম টাকায় ‘‌ক’-কে দিয়ে দিল। ‘‌ক’ সেই টাকা ‘‌গ’-কে দিয়ে ডলার কিনল কিংবা ‘‌গ’ টাকা নিয়ে তার ছেলের মাধ্যমে ডলার তার মার্কিন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা দিল। টাকা কিন্তু দেশ ছাড়েনি। অতএব স্পষ্ট বোঝা গেল যে যারা টাকা বিদেশ ভ্রমণে গেছে বলে মনে করেন তাদের ধারণা ভ্রান্ত। টাকা বিদেশে যায় না। কারণ টাকা দেশের বাইরে অচল। তাহলে টাকা ব্যাংকে নেই কেন? 

উল্লিখিত উদাহরণটি আবার দেখুন। টাকা ছিল ‘‌খ’-এর কাছে। সে টাকা দিল ‘‌ক’-কে। কারণ সম্পত্তি কিনেছে সে। ‘‌ক’ টাকাটা দিল ‘‌গ’-কে। ডলার কেনা বা পাঠানোর জন্য। তাহলে ‘‌খ’-এর টাকা এখন ‘‌গ’-এর কাছে আছে। টাকা কিন্তু দেশেই আছে। অতএব ব্যাংক খালি কেন? ভাবছেন কেন দেখতে পাচ্ছেন না, ‘‌খ’-এর অ্যাকাউন্ট তো খালি। টাকার বান্ডিল এখন ‘‌গ’-এর হাতে। হুম! মানলাম। কিন্তু ‘‌গ’ টাকা কোথায় রাখল। এতগুলো টাকা সে তো পকেটে বা বালিশের তলায় রাখবে না? তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখার কথা। না, তা হবে না। কারণ ‘‌গ’-এর ‘ব্যবসা’ হুন্ডির লেনদেন, তাই সে এ টাকা ব্যাংকে রাখতে যাবে না। 

ভেবে দেখুন অবস্থাটা কেমন হলো। ‘‌ক’ তার সম্পত্তি বিক্রি করল, ‘‌খ’ তা ভোগ করল, ‘‌গ’-এর হাতে টাকা রয়েছে কিন্তু ব্যাংকে টাকা নেই। দেশ হাহাকার করছে। আর দোষ ঢাকার জন্য নানা অজুহাত খুঁজছে সরকার। চক্রাকারে ঘুরছে সবাই। এবার সরকার ব্যাখ্যা করল ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে, ইউরোপে মন্দা এসেছে। পৃথিবীতে হাহাকার আসছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। তাই টাকার অভাব দেখা দিয়েছে! অথচ দেখুন এসব কোনো কিছুর সঙ্গেই টাকার কোনো সংস্পর্শ নেই। সব ডলারে হচ্ছে। তাহলে টাকার অভাব কেন হবে ব্যাংকে? কেউ কিছু স্পষ্ট করছেন না কিন্তু সবাই নিজ নিজ ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন। সবাই আবার কেন যেন সবই বুঝে ফেলছেন এবং ব্যাখ্যার প্রশংসা হচ্ছে। 

সাক্ষাৎ গ্রহণ শেষে প্রশ্নটাই কেন যেন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অর্থনীতিতে টাকার ব্যবহার আমরা জানি। টাকার চাহিদা রয়েছে। টাকার জোগানদার রয়েছে। অতএব টাকার অভাব কী কারণে হতে পারে? কয়েকটি ব্যাখ্যা দিই। 

এক. টাকার চাহিদা বাড়ছে। লোকে ব্যাংক থেকে সঞ্চয় তুলে খেয়ে ফেলছে। অতএব টাকা ব্যাংকে থাকছে না। উহু! এত সহজ নয়, টাকা তো তাহলে পণ্যবিক্রেতাদের পকেটে। তাহলে তার অ্যাকাউন্ট খালি কেন। আহা! বুঝলেন না। তার খরচ বেড়েছে। তাই তিনি খরচ করে ফেলেছেন। সত্যি। কিন্তু টাকা তো কেউ খেয়ে ফেলেনি। যে-ই পাক না কেন, শেষ পর্যন্ত টাকার আশ্রয়স্থল তো ব্যাংক। সেখানে ব্যাংকে হাহাকার কেন? 

দুই. টাকার জোগানদাতা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপায়। সে কি টাকা কম ছাপিয়েছে? তবে কি অর্থনীতির গতি এতটাই বেড়েছে যে টাকার চাহিদার মাত্রার সঙ্গে জোগান প্রতিযোগিতায় পারছে না। তাই টাকার হাহাকার হচ্ছে। তবে কি বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিদা ও জোগানের সমতা তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে? হতে পারে। কিন্তু কেন হলো? কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার চাহিদা বৃদ্ধির পরিমাপ করে নানাভাবে। এর একটি হলো কল মানি রেট। ব্যাংক থেকে ব্যাংকের স্বল্প সময়ের ঋণ বেড়ে গেলে বুঝতে হবে নগদ টাকার চাহিদা বাড়ছে। ফলে সুদের হার বেড়ে যায়। এ সুদের হার বেড়ে যাওয়া একটি অশনিসংকেত। প্রথমত, কোনো ব্যাংক তার টাকার হিসাবে গড়বড় করে ফেলেছে। তার দেনা বেড়ে গেছে, ফলে আমানতকারীর চাহিদা অনুযায়ী টাকার সংকুলান করতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, টাকার জোগান বাড়াতে হবে। এক ঢিলে দুই পাখি ধরা যায়। এ নিয়ে কোনো কোনো সময় অনেক সরকার বিব্রত হয়েছে। তাই কোনো একসময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা দিল—এখন থেকে কল মানি মার্কেটের সুদও স্থির থাকবে। সীমার বাইরে যেতে পারবে না কোনো সুদের হার। পাখি হাতছাড়া হয়ে গেল। হয়তোবা এ রকম একটি কঠোর নিয়মের এটি সরল সমাধান। এখন বোঝা যায় না কোন ব্যাংক বিপদে রয়েছে। কারণ সুদের হার নিয়ন্ত্রণে থাকলে ব্যাংক লুট করা সহজ হয়। কারো দোষ কারো ওপর বর্তায় না। টাকা লুট হয়ে গেলেও স্বল্প সুদে তা পূরণ করা যায়।

তিন. উহু! এত সহজ নয়। কেবল কয়েকটি ব্যাংক বা তাদের মালিকের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের দায় এত বড় নয় যে দেশের অনেকগুলো ব্যাংকে হাহাকার দেখা দিতে পারে। অতএব আরো কারণ থাকতে হবে। এক সহকর্মী বললেন টাকা বালিশের নিচে। অর্থাৎ টাকা ব্যাংকে ফেরত আসছে না। দেশেই রয়েছে। কিন্তু এত টাকা বালিশের নিচে? বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু ফেলাও যাচ্ছে না। কেন লোকে টাকা বালিশের নিচে রাখছে? হতে পারে তাদের টাকার আয়ের উৎস সঠিক নয়? অনেকে রীতিমতো আন্দোলনও করছেন। কালো টাকা ব্যাংকে রাখা যাবে না। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে মনে হবে, ব্যাংক তো নয়, এ যেন আয়কর বা দুদকের অফিস! কথায় বলে না, নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। ব্যাংক তা-ই করছে। মোষ তাড়াচ্ছে আয়কর ও দুদকের। অবশেষে নিজেই হয়েছে ঘরছাড়া ছন্নছাড়া। সেই যে ‘‌গ’ তার ছেলেকে দিয়ে ‘‌ক’-এর মার্কিন অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিয়েছিলেন সেখানেও কি এত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল? তাহলে তো হাজার হাজার কোটি টাকার সমান ডলার প্রতি বছর পাচারই হতো না! 

চার. টাকা ব্যাংকের বাইরে থেকে যাওয়া কালো টাকার চেয়েও ভয়ংকর—এ ধারণা অনেকের নেই। একটি উদাহরণ দিই—ঢাকায় ৪০ লাখ লোক নিম্ন আয়ের। তাদের অনেকেই টাকা ব্যাংকে রাখতে চায় না। একসময় আমার একটি ছাত্র তার গবেষণায় দেখাল যে বস্তিবাসীর সবাই প্রতিদিন ১০ টাকা করে সঞ্চয় করে। তাতে একটি এক হাজার লোকের বস্তিতে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা জমা হয়। মাসে তা হয় ৩ লাখ টাকা। বছরে হয় ৩৬ লাখ টাকা। ঢাকায় রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার বস্তি। অর্থাৎ সবাই মিলে তারা সঞ্চয় করে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর কোনো টাকাই কিন্তু ব্যাংকে থাকে না। কারণ ব্যাংকের ফরম পূরণ করতে গেলে যেসব প্রশ্ন থাকে তার কোনোটিই কোনো সমিতি পূরণ করতে পারবে না। ফলে টাকা বাইরেই থেকে যায়। প্রশ্ন করতে পারেন যে যেসব সমিতি এত টাকা জমা রাখে তারা কী করে এ টাকা দিয়ে? কারণ শেষ পর্যন্ত কিন্তু সমিতি আমানতকারীকে সুদসহ টাকা ফেরত দেয়। বলবেন না যে সব সমিতিই হায় হায় সমিতি। তবে এসব সমিতি এ টাকা নিয়ে কী করে তা গবেষণায় আসেনি। আমরা কল্পনা করতে পারি মাত্র। তাদের সম্মিলিত টাকার পরিমাণ খোদ ঢাকা পুলিশের বার্ষিক বরাদ্দের বেশি। ফলে শেষ পর্যন্ত দেখবেন পুলিশ সমিতির অঘোষিত ‘ব্যবসা’ ধরার জন্য আরো অর্থ ব্যয় করেও অনেক ক্ষেত্রে অসফল হয়। হবেই বা না কেন? এত টাকা? ১৯৯২ সালে ব্রিটিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখতে পেল যে অনেক মুসলিম নাগরিক সুদের কারণে ব্যাংকে টাকা রাখতে চায় না। তারা মনে করল যে এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। কারণ তাতে ২-৫ শতাংশ অর্থনীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় থাকবে না। ব্যর্থতার দায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারের ওপর পড়বে। তাই তারা সুদবিহীন ব্যাংক প্রথমে ও পরে শরিয়াহ ব্যাংকিং চালু করল। বুঝতে চেষ্টা করুন। টাকা ব্যাংকে না থাকলে অর্থনীতি ক্রমে অন্ধকার গহ্বরে পতিত হবে। তাতে দেশের ক্ষতি অনেক বেশি হবে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত কী করে অর্থনীতিকে চোরাগলি থেকে বের করা যাবে সে বিষয়ে নজর দেয়া। তাহলে সরকারকে করদাতাদের অর্থ দিয়ে ব্যাংক রক্ষা করতে হবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন কিংবা আয়কর বিভাগের কাজ তাদেরই করতে দিন। ব্যাংকের কাজ সে যেন সবসময় টাকার শেষ আশ্রয়স্থল হয়, সেই সম্পর্কে নিয়মনীতি চালু করা। তাহলেই ‘‌গ’ তার টাকা ব্যাংকেই রাখত। আর ‘‌গ’-এর বেআইনি কার্যকলাপ ধরার দায় রইবে পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন কিংবা আয়কর বিভাগের হাতে। তাদের ব্যাংকের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করতে দিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছি। আশা করি ভাববেন। 

ড. এ কে এনামুল হক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ও পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন