সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, যা দ্রুত মোকাবেলা করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিও পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। এসব নিশ্চিত করতে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা জরুরি। তবে কোনো একটি নির্দিষ্ট উপায়ের ব্যবহার স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট নয়। বিনিময় হারের নমনীয় ব্যবস্থাপনা, ঋণের প্রবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং কর ও ব্যয় ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা—এ সবকিছুর সংমিশ্রণে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।
রাজধানীর লেকশোর হোটেলে গতকাল সকালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলন শুরু হয়। এর উদ্বোধনী অধিবেশনে ‘ম্যাক্রোইকোনমিক ম্যানেজমেন্ট ইন পোস্ট কভিড আনসার্টেইন গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ। সেখানে তিনি সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও স্থিতিশীলতার বিষয়ে কথা বলেন।
উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বিশেষ অতিথি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সূচনা বক্তব্য রাখেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।
ড. সাদিক আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ মুদ্রার বিনিময় হারে নমনীয়তা এনে সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলেও এ হারে নিম্নগামী প্রবণতা শুরু হলে রাজনৈতিক চাপের কারণে সরকার নমনীয়তার জায়গা থেকে দ্রুত সরে আসে। এ সরে আসার ফলে সরকারের বিশাল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এবং রিজার্ভও ব্যাপক কমেছে। সরকার এক্সচেঞ্জ রেটে নমনীয় থাকলেও স্থানীয় বাজারের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করতে না পারায় সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। দ্রুত ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়া ও ক্রমবর্ধমান রাজস্ব ঘাটতির কারণে মুদ্রার বিনিময় হার অবমূল্যায়িত হয়েছে। ডলারের একটি মাত্র রেট নির্ধারণ করে এবং বাজারের ওপর ভিত্তি করে বিনিময় হার ঠিক করে পলিসি প্যাকেজ নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যালান্স অব পেমেন্টে স্থিরতা আনার জন্য পলিসি নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া রফতানির প্রসার ও রেমিট্যান্স আহরণ বাড়িয়ে বিনিয়োগ ও জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করতে হবে। এগুলোর জন্য সমন্বিত চাহিদা ব্যবস্থাপনা নীতি নির্ধারণ করতে হবে, যাতে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ও স্থানীয় বাজারের মধ্যে কোনো চাপ তৈরি না হয়।
চাহিদা ব্যবস্থাপনায় ত্রুটিযুক্ত পলিসি রয়েছে, যেখানে এখনো নয়-ছয় সুদের হার সংশোধন করা হয়নি—এমন মন্তব্য করে ড. সাদিক বলেন, যার কারণে বাজারে সুদের হার বৃদ্ধিতে মুদ্রানীতি কার্যকর হচ্ছে না, বাজারে ঋণের চাহিদা কমানোর জন্য এ পলিসির সংশোধন দরকার। যদিও মূল্যস্ফীতি দ্রুত বাড়ছে এবং ৯ শতাংশের বেশি হয়ে যাচ্ছে, তার পরও লেন্ডিং ক্যাপ ৯ শতাংশই থাকছে। নয়-ছয় সুদহারের পলিসি সরিয়ে ফেলা দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মুদ্রানীতিতে রাজস্ব ঘাটতি কমাতে সরকার পর্যাপ্ত পরামর্শের মাধ্যমে কর সংস্কার করতে সক্ষম হচ্ছে না বলে মনে করেন ড. সাদিক। তিনি বলেন, রাজস্ব ঘাটতি ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে এবং চাহিদার চাপ তৈরি হচ্ছে। কর সংস্কারে বড় ঝুঁকি রয়েছে, এর জন্য কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বড় সংস্কার দরকার, যা শুধু বাজেটের সময় কিছু অনানুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নিয়ে সমাধান করা সম্ভব না। কর রাজস্ব বাড়াতে করনীতি ও কর আদায়ের মতো বড় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার।
ড. সাদিক আহমেদ আরো বলেন, কর সংস্কার কমিশনের কথা বলেছি, যা ভারতেও হয়েছে। এটাকে বলা হয় ইনডিপেনডেন্ট এক্সপার্ট গ্রুপ। এ কমিশনের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন এবং কর বিষয়ে বৈশ্বিক মানের বিশেষজ্ঞ হবেন। কমিশনের সদস্যরা করের কোনো জায়গায় সংস্কার আনতে সেসব বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদের কাছে প্রতিবেদন দেবেন ও মন্ত্রিপরিষদ তার ওপর ভিত্তি করে পলিসি নির্ধারণ করবে। ইন্টারেস্ট রেট, এক্সচেঞ্জ রেটের ফ্লেক্সিবিলিটি দরকার। এক্সচেঞ্জ রেট চার-পাঁচটা না রেখে, বাজার অনুযায়ী দাম বাড়া বা কমার সুযোগ করে দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের ট্যাক্স-জিডিপির হারে ১০-১২ বছর ধরে কোনো উন্নতি হচ্ছে না। প্রত্যেক বছর বাড়ানোর কথা বলা হয় কিন্তু বাড়ে না, তার অর্থ এখানে কাঠামোগত সমস্যা আছে। এসব সমস্যা খুঁজে বের করে কীভাবে আধুনিকায়ন করা যায় তা নিয়ে কাজ করবে কমিশন। এছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে কী ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করছে, কর আইনকে কীভাবে আরো সহজ করা যায় সেসব নিয়ে বিশেষজ্ঞ দল কাজ করবে ও তারা বিভিন্ন সুপারিশ দেবে। করনীতি ও কর আদায় পৃথক করতে হবে। আমরা গত পাঁচ-সাত বছর ধরে এ দাবি জানাচ্ছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, দেশের গবেষণার মান নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শঙ্কিত নন, তবে তিনি আরো উল্লসিত হতে চান। পশ্চিমারা সব আবিষ্কার করতে পারে আমরা কেন দু-একটা আবিষ্কার করতে পারি না। আমরা অর্থনীতির কোনো ম্যারপাঁচে বিশ্বাসী না। আমরা চাই শেষ ফলাফল যাতে পজিটিভ হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে সুচিন্তিত নীতি আসতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় নীতি নির্ধারণ ও নীতি নির্ধারকদের আরো শাণিত করতে বিআইডিএসের এ ধরনের পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট না। কারণ সংকটের সময় তাদেরই মূল ভূমিকা রাখা দরকার। ট্যাক্স-জিডিপি রেশিওতে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। এখন রাজস্বের জন্য আলাদা কমিশন করা হবে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। কারণ আলাদা কমিশন করার অনেক সমস্যা আছে, আর একবার কমিশন করলে তা আর ভাঙা যায় না। তবে কর আদায় ও করনীতি আলাদা করা দরকার।’
সুদহার নয়-ছয় থেকে নয়-বারো করার পরামর্শ দেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী আমাদের রেমিট্যান্স গত বছরের চেয়ে বেড়েছে। অর্থনীতির প্রধান কয়েকটি সেক্টর যেমন আমদানি, রফতানি, এফডিআই ও প্রাইভেট সেক্টরের লোনসহ সব ক্ষেত্রেই আমাদের গত বছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রধান সূচকগুলোতে প্রবৃদ্ধিও ভালো ও মূল্যস্ফীতিও কমছে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমবে না, এ বছরও ৭ শতাংশের বেশি থাকবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘করোনা-পরবর্তী সময়ে আমাদের মূল্য অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আমাদের মুদ্রাস্ফীতিটা মানি সাপ্লাইয়ের জন্য হয়নি। আমরা নেট ফুড ইমপোর্টিং দেশ। গমের চাহিদার ৯০ শতাংশ আমরা আমদানি করি, জ্বালানি ও ভোজ্য তেল সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। এগুলোর সরবরাহের ঘাটতি ও ডলারের মূল্য ওঠানামার কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে।’
তিন দিনব্যাপী বিআইডিএসের বার্ষিক সম্মেলনে ১৩টি একাডেমিক পেপার, পাঁচটি বুক ডিসকাশন ও ১২টি কি-নোট স্পিচ দেশ ও দেশের বাইরে থেকে উপস্থাপন করা হবে। সম্মেলনের বিভিন্ন সেশনে অংশ নিচ্ছেন দেশ-বিদেশের অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা।