পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় আক্রান্ত বাংলালিংকের উদ্যোক্তারা

মেহেদী হাসান রাহাত

নেদারল্যান্ডসভিত্তিক ভিওন লিমিটেডের শতভাগ মালিকানাধীন সাবসিডিয়ারি বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস লিমিটেড। ভিওন লিমিটেড এর মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠান লেটারওয়ানের রাশিয়ান অলিগার্ক উদ্যোক্তা তাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নিষেধাজ্ঞার জেরে এরই মধ্যে ভিওন লেটারওয়ানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই অলিগার্ক পদত্যাগ করেছেন। নিষেধাজ্ঞার প্রভাব নিয়ে উত্কণ্ঠায় রয়েছেন ভিওনের ঋণদাতা, অংশীদার শেয়ারহোল্ডাররাও।

বারমুডায় নিবন্ধিত ভিওন লিমিটেড বর্তমানে রাশিয়া, ইউক্রেন, পাকিস্তান, কাজাখস্তান আলজেরিয়া, উজবেকিস্তান, বাংলাদেশ, কিরগিজস্তান জর্জিয়ায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সংখ্যা ২২ কোটিরও বেশি। ভিওনের প্রধান কার্যালয় নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে। কোম্পানিটি বর্তমানে আমস্টারডাম, নাসডাক, মস্কো সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। কোম্পানির ৪৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে লুক্সেমবার্গে নিবন্ধিত লেটারওয়ান টি ভিআইপি হোল্ডিংস এসএআরএলের কাছে। লেটারওয়ানের সহপ্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে রয়েছেন রুশ অলিগার্ক মিখাইল ফ্রিডম্যান, পিটার অ্যাভেন, জার্মান কেহান, অ্যালেক্সি কুজমিশেভ আন্দ্রেই কসোগভ। এর মধ্যে লেটারওয়ানের ৩৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ শেয়ার মিখাইল ফ্রিডম্যানের কাছে এবং ১২ দশমিক ১৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে পিটার অ্যাভেনের কাছে। ফ্রিডম্যান অ্যাভেন দুজনই রাশিয়ান অলিগার্ক। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের জেরে ফ্রিডম্যান, অ্যাভেন, কেহান কুজমিশেভের ওপর ব্যক্তি পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইইউ।

ফ্রিডম্যান অ্যাভেনের ওপর যুক্তরাজ্যেরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যদিও দেশটিতে দুই রুশ অলিগার্কের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে। ফ্রিডম্যান অ্যাভেনের মালিকানায় থাকা রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক আলফা ব্যাংকের ওপরও যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে লেটারওয়ানে চার অলিগার্কের শেয়ার জব্দ হতে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা এড়াতে লেটারওয়ান ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা কোম্পানি থেকে লভ্যাংশ কিংবা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা পাবে না। পাশাপাশি ফ্রিডম্যান ভিওন লেটারওয়ানের পর্ষদ থেকে এবং অ্যাভেন লেটারওয়ানের পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।

ফ্রিডম্যান অ্যাভেনের ওপর ইইউ যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে ভিওনের শেয়ারহোল্ডার অংশীদারদের মধ্যে কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বছরের মার্চে ভিওনের প্রধান নির্বাহী কেহান তেরজিওগলু তাদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি পাঠান। চিঠির ভাষ্য অনুসারে, ভিওনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা ইইউর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি কাউন্সিল অব ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার পর মিখাইল ফ্রিডম্যান ভিওনের পর্ষদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। পিটার অ্যাভেনও লেটারওয়ানের পর্ষদের পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।

চিঠিতে আরো বলা হয়, ভিওনে লেটারওয়ানের মালিকানাধীন শেয়ারের পরিমাণ ৫০ শতাংশের কম। আবার লেটারওয়ানেও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত দুই অলিগার্ক ফ্রিডম্যান অ্যাভেনের শেয়ারধারণের পরিমাণ ৫০ শতাংশের নিচে। এমনকি লেটারওয়ানে বিদ্যমান স্বার্থের বাইরে ভিওনের শেয়ারে ফ্রিডম্যান অ্যাভেনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ভোটাধিকার নেই। ফলে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নেই।

তবে বিভিন্ন সূত্রের তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্লেষকদের ধারণা, লেটারওয়ানে ফ্রিডম্যান, অ্যাভেন কেহানের শেয়ার সংখ্যা সম্মিলিতভাবে ৫০ শতাংশেরও বেশি। ডাচ ফাউন্ডেশন স্ট্রিচটিংয়ের সঙ্গে লেটারওয়ানের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ভিওনের দশমিক ৩১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে স্ট্রিচটিংয়ের কাছে। করপোরেট কাঠামো অনুযায়ী স্ট্রিচটিংকে শেয়ারহোল্ডার বা অংশীদারবিহীন অনাথ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। লেটারওয়ানের সঙ্গে স্ট্রিচটিংয়ের সম্পৃক্ততার কারণে ভিওনে লেটারওয়ানের আর্থিক সুবিধার কার্যকর অংশীদারত্ব দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশে। তাছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত যতই দিন গড়াচ্ছে, এটি ততই জটিল হয়ে পড়ছে। রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্কের তিক্ততাও দিন দিন বাড়ছে। এতে সামনের দিনগুলোয় নিষেধাজ্ঞার পরিধি আরো বিস্তৃত হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমও আরো অনেক বেশি নজরদারির মধ্যে পড়বে।

মিখাইল ফ্রিডম্যান পিটার অ্যাভেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর পরই ভিওনের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে শুরু করেছে সিটি গ্রুপ, আইএনজি জেপি মরগানের মতো বিনিয়োগ ব্যাংকগুলো। তাছাড়া ভিওনের লেনদেনের বড় অংশই হয় ডলার রুবলের মাধ্যমে। ইউরোপ-আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার পাল্টা হিসেবে রাশিয়াও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এতে ভিওনের পক্ষে রাশিয়ায় থাকা তাদের সম্পদ অন্যদের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

দেশের প্রথম সারির বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনের সম্পর্ক আছে বাংলালিংকের। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বিদেশী ব্যাংকও রয়েছে। বাংলালিংকের বিভিন্ন ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয় এমন একটি ব্যাংক মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড। বেসরকারি খাতের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার ছয় মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে। সময়ে বাংলালিংকের এলসি খুলতে গিয়ে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়িনি।

দেশে আন্তর্জাতিক কিংবা ইউরোপ-আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা কোম্পানির সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেনের বিষয়টি তদারক করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটির প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, ধরনের নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর লেনদেনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি মানদণ্ড ঠিক করে দিয়েছে। দেশের কোনো ব্যাংক সে মানদণ্ড লঙ্ঘন করলে বিএফআইইউ সে ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। বাংলালিংকের সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি আমার জানা নেই।

দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) খাতের কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স প্রদান, সেবার মান নিশ্চিত, খাতটির উন্নয়নসহ সার্বিক বিষয় দেখভাল করে। বাংলালিংকের মূল প্রতিষ্ঠান ভিওন এবং এর সবচেয়ে বেশি শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বণিক বার্তাকে বলেন, ধরনের কোনো তথ্য বা বিষয় আমাদের জানা নেই।

৩১ ডিসেম্বর ২০২১ শেষে বাংলালিংকের কাছ থেকে ভিওনের ৫৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার পরিচালন আয় এসেছে, যা আগের বছর ছিল ৫৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ভিওনের সাবসিডিয়ারিগুলোর মধ্যে  পরিচালন আয়ের দিক দিয়ে বাংলালিংকের অবস্থান চতুর্থ। ২০২০ সালের এপ্রিলে বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস ৩০ কোটি ডলারের সিন্ডিকেট ঋণের ম্যাচুরিটি আরো দুই বছরের জন্য বাড়িয়েছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ভিওন লিমিটেডের শতভাগ সাবসিডিয়ারি ভিওন ডিজিটাল আমস্টারডাম বিভি প্রকৃত ঋণদাতার কাছ থেকে বাংলালিংকের ঋণ অধিগ্রহণ করে নেয়। সম্পৃক্ত পক্ষ হিসেবে লভ্যাংশ ছাড়াও বাংলালিংক এবং ভিওনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লেনদেন হয় কিংবা হওয়ার সুযোগ রয়েছে। অবস্থায় ভিওন লেটারওয়ান-সংশ্লিষ্ট রাশিয়ান অলিগার্করা ইউরোপ-আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় পড়ায় বাংলালিংকের লেনদেনও বৈশ্বিক নজরদারিতে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

যতদিন পর্যন্ত বাংলালিংকের কার্যক্রমে কোনো ধরনের সমস্যা না হচ্ছে, ততদিন বিষয়ে উদ্বেগের কিছু নেই বলে মনে করছেন ডাক টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলালিংক দেশের আইন মেনে ব্যবসা করবে, ততদিন আমাদের উদ্বেগের কিছু নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকালে বাংলালিংক তো ডিফল্ট করেনি। ফলে এক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ারও কিছু নেই। যদি কখনো সংকট দৃশ্যমান হয়, তখন সেটি দেখা যাবে।

বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলালিংকের করপোরেট কমিউনিকেশন বিভাগ থেকে বলা হয়, এটি ভিওনের বিষয়। বিষয়ে ভিওনই সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন