আগামীতে বাণিজ্য হতে পারে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের প্রধান ক্ষেত্র

যৌথ বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারে বিরাজমান বাধাগুলো দ্রুত নিরসন করা হোক

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক জন্মলগ্ন থেকেই। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে দুই দেশের সম্পর্কের বয়সও এখন ৫০ বছর। দীর্ঘ সময়ে উভয় রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব-সম্প্রীতি উন্নীত হয়েছে নবতর পর্যায়ে। বেশ কয়েক বছর ধরে কূটনৈতিক চৌহদ্দি ছাড়িয়ে সেটিকে অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্কে রূপ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। এটা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম। সম্প্রতি সিপিডি আরআইএসের আয়োজনে একটা আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানেও আগামীতে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের প্রধান ক্ষেত্র বাণিজ্য হতে পারে বলে উঠে এসেছে। তবে তার জন্য সর্বাগ্রে দরকার অনিষ্পন্ন ইস্যুগুলো দ্রুত মীমাংসা এবং দুই দেশের আস্থার সম্পর্ক আরো দৃঢ় করা। আলোচনায় অংশগ্রহণকারী বক্তারাও যথার্থভাবে এর ওপর জোর দিয়েছেন। কাজেই বিষয়টি আমলে নিয়ে উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বিশেষ সক্রিয়তা জরুরি।

সময়ান্তরে দুই দেশের সম্পর্ক ভিন্ন উচ্চতায় উন্নীত হলেও এখনো কিছু টানাপড়েন বিদ্যমান। ভারতের চাওয়াগুলোর বেশির ভাগই পূরণ হলেও বাংলাদেশের কিছু অপ্রাপ্তি রয়ে গেছে। এর মধ্যে তিস্তার পানি ভাগাভাগি একটি। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পানির গুরুত্বপূর্ণ উৎস তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির অনিশ্চয়তা দূর হয়নি। এক দীর্ঘসূত্রতার পাকে পড়ে গেছে এটি। আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার অধিকার থাকলেও শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানি খুব একটা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এটা একটা অস্বস্তির ক্ষেত্র। একইভাবে বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এক ধরনের অসমতা বৈষম্য বিরাজমান। ভারতীয় পণ্যের বিশাল বাজার বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশী পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েও আবার অশুল্ক বাধার বেড়াজালে বন্দি দেশটিতে আমাদের রফতানি বাণিজ্য। ফলে  প্রত্যাশিত মাত্রায় কমেনি দুই দেশের বাণিজ্য ব্যবধান। ট্রানজিটের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোয় পণ্য পরিবহনে ট্রানজিট সুবিধা পেয়েছে ভারত। অথচ নেপালে পণ্য পরিবহনে শিলিগুড়ি করিডোর ব্যবহারের সুবিধা এখনো দেয়া হয়নি বাংলাদেশকে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হত্যা একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সত্ত্বেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে নিয়মিত বিরতিতে মারা যাচ্ছে মানুষ। এতে আস্থার সম্পর্কে সময়ে সময়ে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। যৌথ বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার পথে উল্লিখিত বিষয়গুলো অন্তরায় বৈকি।

বিশ্ববাজারে নিজস্ব অংশগ্রহণ বাড়ানোর পাশাপাশি অনেক দেশই আঞ্চলিক বাণিজ্য, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে জোর দিচ্ছে। এর কারণ হলো, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কোনো ধরনের উদ্বায়িতা সৃষ্টি হলে কিংবা সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হলেও যেন অর্থনৈতিক সক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব হয়। বিশেষ করে কভিড-পরবর্তী বিশ্বে এটা এক নতুন প্রপঞ্চ হিসেবে হাজির হয়েছে। এর বড় উদাহরণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড নিজেদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) তো করছেই, ক্ষেত্রবিশেষে বড় অর্থনীতির দেশ চীন, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা জাপানের মতো দেশের সঙ্গে আঞ্চলিকভাবে অধিক মাত্রায় সম্পৃক্ত হচ্ছে। উদ্যোগী হচ্ছে আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি (আরটিএ) প্রণয়নেও। ফলে দ্বিপক্ষীয় আঞ্চলিক উভয় বিবেচনায়ই দেশগুলো বাণিজ্যিক সুফল পাচ্ছে। যৌথ বাণিজ্যিক অংশগ্রহণ বাড়াতে বাংলাদেশ-ভারতের জন্য উল্লিখিত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা শিক্ষণীয়।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্ব কিছু ক্ষেত্রে আরো নিবিড় হয়েছে। বহুপ্রতীক্ষিত স্থলসীমা চুক্তির মাধ্যমে ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। বিদ্যুৎ আমদানি উৎপাদনে পারস্পরিক স্বার্থে উভয় দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা চলমান। বেশকিছু ক্রেডিট লাইন বাংলাদেশকে দিয়েছে ভারত; যদিও এর অর্থ ছাড়ে বেশ দীর্ঘসূত্রতা বিরাজমান। কিছুদিন ঢাকা-নিউ জলপাইগুড়ি  (শিলিগুড়ির কাছে) ট্রেন চালু করা হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন অংশীদারি প্রকল্পে সহযোগিতা করছে দেশটি। করোনা মহামারীতে বাংলাদেশের মানুষের জন্য উপহার হিসেবে ২০ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়েছে ভারত সরকার। দুই দেশের সম্পর্কের দিক থেকে এগুলো বিশেষ উৎসাহজনক। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের নিষ্পত্তি এবং সীমান্ত হত্যা বন্ধ না হওয়ায় বারবারই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আস্থায় কিছুটা চিড় ধরছে। কাজেই বিষয়গুলোর সমাধানে উভয় দেশ, বিশেষ করে ভারতকে আরো আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। নইলে যৌথ বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নেয়া খুব একটা সহজ হবে না।

উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে প্রথম দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনায় ভারতকে কাঠামোগত রূপান্তরে বিনিয়োগের প্রস্তাব করে বাংলাদেশ। তাতে ইতিবাচক প্রত্যয় ব্যক্ত করে দেশটি। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে আলোচনার সময়ও ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে পুনর্গঠন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। অথচ সেই উদ্যোগ আজও বাস্তবায়ন হয়নি।  ভারতীয়দের বাংলাদেশে বিনিয়োগের এখনই সময়। আমাদের সরকার দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের চেষ্টা করছে। বাস্তবায়ন করছে অনেক অর্থনৈতিক অঞ্চল। বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় সমর্থন দেয়া হচ্ছে। ভারতীয় উদ্যোক্তারা সহজেই এর সুযোগ নিতে পারেন। তাদের বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে দেশটির সরকারকেও উদ্যোগী হতে হবে। একইভাবে ভারতও বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টিসহ নানা সমর্থন দিতে পারে। যাতে দুই দেশই অর্থনৈতিকভাবে আরো এগিয়ে যেতে পারে, সমৃদ্ধ হতে পারে।

সন্দেহ নেই, আগের চেয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো বেগবান হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে লজিস্টিক সুবিধার ঘাটতি। বাণিজ্যের বেশির ভাগই সম্পন্ন হয় বেনাপোল পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে। ওই দুটি স্থলবন্দর অবকাঠামোগত অপ্রতুলতাসহ নানা সীমাবদ্ধতায় জর্জরিত। বাণিজ্য বাড়াতে এগুলো দূর করতে হবে। আবার যেভাবে সড়কপথে পণ্য পরিবহন হচ্ছে, সেভাবে হচ্ছে না রেল নৌপথে। দুটি পথকেও আরো কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে দুই দেশের সক্রিয়তা জরুরি। মনে রাখা চাই, বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব বৃদ্ধিতে শুধু দুই দেশই লাভবান হবে না, ইতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতেও। সর্বোপরি এর মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হবে বৃহত্তর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা। সুতরাং বিরাজমান বাধাগুলো নিরসনপূর্বক যৌথ বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারে সম্মিলিত প্রচেষ্টা নেয়া হবে, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন