বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না পদ্মা সেতুতে টোল আদায় প্রাক্কলন

শামীম রাহমান

প্রাক্কলন অনুযায়ী পদ্মা সেতুতে ২০২২ সালে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার গাড়ি চলার কথা। আর এসব গাড়ি থেকে টোল বাবদ সাড়ে কোটি টাকা আদায় হবেএমনই ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) হিসাব বলছে, সেতু চালু হলে আগামী বছর দিনে পারাপার হবে দুই হাজারের মতো গাড়ি, যেগুলো থেকে টোল আদায় হবে সর্বোচ্চ ২৯ লাখ টাকা।

পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে। নির্মাণ ব্যয়ের ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে (বিবিএ) ঋণ হিসেবে দিচ্ছে সরকারের অর্থ বিভাগ। ঋণচুক্তি অনুযায়ী, সেতুর আয় থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে অর্থ বিভাগকে সুদসহ পুরো টাকা শোধ করতে হবে বিবিএকে। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে টোল আদায়ের প্রাক্কলন না মেলায় নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিবিএ বলছে, বর্তমান বাস্তবতায় টোল আদায়ের টাকা পরিশোধের উপযোগী হতেই তাদের সাত-আট বছর লেগে যেতে পারে।

পদ্মা সেতুর ডিটেইলড ডিজাইন প্রতিবেদনের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২২ সালে সেতু দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। এর মধ্যে ট্রাক পারাপার হবে ১০ হাজার ২৪৪টি। বাস হালকা যানবাহন পারাপার হবে যথাক্রমে হাজার ২৩৮ হাজার ৪৭২টি। এসব যানবাহন থেকে প্রতিদিন কোটি ৪৫ লাখ টাকা টোল আদায় হওয়ার কথা। হিসাবে প্রতি মাসে ১৩৩ কোটি ৬৬ লাখ প্রতি বছর হাজার ৬০৩ কোটি টাকা টোল আদায় হবে। বর্তমানে ফেরি পারাপার হতে যত টাকা টোল দিতে হয়, পদ্মা সেতুর জন্য তার চেয়ে দেড় গুণ বেশি ধরে প্রাক্কলন করা হয়েছে। একই হারে টোল আদায়ের প্রস্তাব করেছে বিবিএও।

অন্যদিকে ২০২২ সালে পদ্মা সেতুতে কী পরিমাণ গাড়ি চলাচল করবে টোল আদায় হতে পারে, তার একটি প্রাক্কলন করা হয়েছে বিআইডব্লিউটিসির হিসাবের ভিত্তিতে। মাওয়া-জাজিরা রুটে বর্তমানে কী পরিমাণ যানবাহন ফেরিতে পারাপার হয়, তার ভিত্তিতে প্রাক্কলন তৈরি করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, আগামী বছর সেতু দিয়ে প্রতিদিন ৩৮৭টি ট্রাক, ৮৩টি বাস হাজার ২৮৭টি হালকা যানবাহন পারাপার হওয়ার কথা। এসব যানবাহন থেকে টোল আদায় হওয়ার কথা প্রতিদিন ২৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। হিসাবে প্রতি মাসে কোটি ৬৫ লাখ প্রতি বছর ১০৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা টোল আদায় হওয়ার কথা।

পদ্মা সেতুতে টোল আদায়ের প্রাক্কলনে বিস্তর ব্যবধানের কারণ সম্পর্কে বিবিএর একজন ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী বণিক বার্তাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সেতু চালুর পর যত সময় গড়িয়েছে, তত বেড়েছে পারাপার হওয়া যানবাহনের সংখ্যা টোল আদায়ের পরিমাণ। ডিটেইলড ডিজাইন প্রতিবেদনে যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা সেতু চালু হওয়ার কয়েক বছর পরের হিসাব। এটি কোনোভাবেই সেতু চালুর প্রথম বছর নয়। প্রাক্কলনের সঙ্গে বাস্তবের অমিল থাকার এটা একটা বড় কারণ।

বিআইডব্লিউটিসির হিসাব দিয়ে যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা শুধুই মাওয়া-জাজিরা রুটের তথ্য নিয়ে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক যানবাহন পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো বিকল্প পথ ব্যবহার করছে। পদ্মা সেতু চালুর পর কিন্তু এসব যানবাহন পদ্মা সেতু দিয়েই চলবে। ফলে ২০২২ সালের যে প্রাক্কলনটির কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে যানবাহন টোল আদায়ের পরিমাণ তার চেয়েও কিছুটা বেশি হবে। তবে তা কখনই ডিটেইলড ডিজাইনের প্রাক্কলন অনুযায়ী হবে না।

প্রাক্কলন অনুযায়ী টোল আদায় না হলে ঝুঁকিতে পড়বে অর্থ বিভাগের সঙ্গে করা বিবিএর ঋণচুক্তি। বিবিএ বলছে, অর্থ বিভাগের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী যানবাহন চলাচল শুরুর প্রথম বছরেই ৫৯৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে কোনো কোনো বছর হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতে হবে। তাছাড়া সেতু রক্ষণাবেক্ষণ পরিচালনা ব্যয়, নদীশাসন কাজ, ভ্যাট ট্যাক্স পরিশোধসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যয়ও টোল থেকে হওয়া আয় থেকে নির্বাহ করতে হবে। কিন্তু বর্তমান ট্রাফিকের তথ্য অনুযায়ী, সাত-আট বছরেও টোল থেকে বার্ষিক কিস্তির টাকা ওঠানো সম্ভব হবে না।

তবে সেতু বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক মনে করছেন, সেতু চালু হলে সমস্যাটি দ্রুতই কেটে যাবে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমানে ফেরিতে কী পরিমাণ গাড়ি পারাপার হয়, তার ভিত্তিতে টোল আদায়ের নতুন প্রাক্কলনটি করা হয়েছে। জটিলতার কারণে বর্তমানে অনেক গাড়িই একবারের বেশি ফেরি পারাপার হয় না। কিন্তু সেতু চালু হলে দেখা যাবে, অধিকাংশ গাড়ি দুই-তিনবার পর্যন্ত যাতায়াত করছে। তখন স্বভাবতই সেতুর ট্রাফিক বেড়ে যাবে।

অর্থ বিভাগের ঋণ পরিশোধেও কোনো সমস্যা হবে না উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, আমাদের রাজস্ব আয়ের আরো একাধিক খাত রয়েছে, যেখান থেকে সাময়িকভাবে ঋণের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন