পর্যালোচনা

বৈষম্য বাড়ানো বাজার অর্থনীতি স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী

ড. মইনুল ইসলাম

মুজিব শতবর্ষ উদযাপনের শেষ পর্বে কলামটি লিখছি একটি কথা মনে করিয়ে দিতে: ক্রোনি ক্যাপিটালিজম (যাকে বাংলায় স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বলা যায়) বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বঙ্গবন্ধু একটি কথা বারবার বলতেন, পৃথিবীতে দুই দল মানুষ আছে, একদল শোষক, আরেকদল শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। কিন্তু বর্তমানে শোষকদেরই সৌভাগ্যের জোয়ার চলেছে বাংলাদেশে। কিছু ব্যক্তি দেশে অতি দ্রুত ধনকুবেরে পরিণত হচ্ছেন, যার পরিণামে বাংলাদেশ ধনকুবের সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশ্বে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের হতাশজনক স্থানটি দখল করেছে। অথচ বাংলাদেশ একটি গণপ্রজাতন্ত্র, যার চারটি রাষ্ট্রনীতির মধ্যে ২০১০ সাল থেকে আবার সমাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ পাঁচ বছরে অতিধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭ দশমিক শতাংশ হারে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা ২৫৫ জন। ধনকুবেরের এই দ্রুততম প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের জন্য একটি লজ্জাজনক অর্জন। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই এই বাংলাদেশ চাননি।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় যখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা রচনা করে ছয় দফাভিত্তিক পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামকে শোষিত জনগণের শোষণমুক্তির সংগ্রামে রূপান্তর করেছিল, তখন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু ওই নির্বাচনকে ছয় দফা ১১ দফার ওপর গণভোট হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন (১১ দফার তৃতীয় দফাটি হুবহু ছয় দফা) তখন থেকেই সমাজতন্ত্র বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। আর সেজন্যই মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি তাজউদ্দীনের বেতার ভাষণে ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তিনটি মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর তার ইচ্ছানুসারে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিধৃত রাষ্ট্রনীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে সংবিধানের অবৈধ পঞ্চম সংশোধনী পাস করে চতুর্থ রাষ্ট্রনীতি সমাজতন্ত্রকে অর্থনৈতিক সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্রে বিশেষণের আড়ালে পাঠিয়ে নির্বাসিত করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২০১০ সালের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে আবার সমাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের প্রায় ১০ বছরে প্রশ্ন করতে চাই, ২০২১ সালের বাংলাদেশে তো এখনো ক্রোনি ক্যাপিটালিজম মুক্ত বাজার অর্থনীতি দোর্দণ্ড প্রতাপই চলছে। সমাজতন্ত্র কোথায়? শোষিতের শোষণমুক্তির পথ তো ক্রোনি ক্যাপিটালিজম হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বলতে আমরা নিশ্চয়ই অধুনা বিলুপ্ত সোভিয়েত স্টাইলের স্টেটিজম প্রতিষ্ঠা চাইছি না। ওই প্রত্যাখ্যাত মডেলগুলোয় বিশ্বের কোনো দেশে আর ফেরত আনা যাবে না। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রের নানা সৃজনশীল প্রায়োগিক মডেল, যেগুলোকে একই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সামাজিক ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখায় চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করতে দেখছি, সেগুলো থেকে আমরা শিক্ষা নিচ্ছি না কেন? গণচীন ভিয়েতনাম কোন পথে এগোচ্ছে, তা দেখতে অসুবিধা কোথায়? বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে সোভিয়েত স্টাইলের সমাজতান্ত্রিক মডেল প্রয়োগের পদক্ষেপ নেননি। কিন্তু ইতিহাস তো সাক্ষ্য দিচ্ছে, তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল ছিলেন।

উন্নয়ন নীতিতে তিনি প্রথম অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন শিক্ষা খাতকে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে তার সরকারের প্রথম বাজেটে সরকারি ব্যয়ের ২১ দশমিক শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল শিক্ষা খাতের জন্য। ওই পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি জাতিকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন একটি জনবহুল দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি ধারণ করছে শিক্ষা। বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষার জন্য এত বেশি অনুপাতের বাজেট বরাদ্দ আর কখনই পাওয়া যায়নি (চলমান ২০২০-২১ বাজেটে শিক্ষা খাতের জন্য বাজেট বরাদ্দ ১২. শতাংশ, যা জিডিপির মাত্র .১৮ শতাংশ! দক্ষিণ এশিয়ায় এটাই সর্বনিম্ন আনুপাতিক বরাদ্দ। নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এক বছর ধরে বন্ধ থাকায় ২০২০-২১ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে সরকারি প্রকৃত ব্যয় বাজেট বরাদ্দের চেয়ে অনেক কম হবে) তিনি প্রাইমারি স্কুলগুলোকে জাতীয়করণ করেছিলেন, প্রাইমারি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৭() ধারায় সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করা হয়েছে, রাষ্ট্র সকল শিশুর জন্য একটি একক মানসম্পন্ন, গণমুখী, সর্বজনীন, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত চালু করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তার শাসনামলে একটি ক্যাডেট কলেজও প্রতিষ্ঠা করা হয়নি, বরং তার আমলে প্রণীত কুদরতে খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছিল দেশের ক্যাডেট কলেজ মাদ্রাসাগুলোকে পর্যায়ক্রমে শিক্ষার মূলধারার সঙ্গে সমন্বিত করা হবে। অথচ মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাডোলে শরিক হয়ে গত চার দশকে আমরা শিক্ষার বাজারীকরণ পণ্যকরণের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছি, প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমরা বাজারের হাতে সোপর্দ করে চলেছি। শিক্ষা আজ দেশে বাজারের পণ্যে পরিণত হয়েছে, যেখানে ধনাঢ্য মা-বাবার সন্তানদের জন্য প্রাথমিক লেভেল থেকে উচ্চতম শিক্ষার পর্যায়ে মহার্ঘ পণ্য হিসেবে উচ্চমানসম্পন্ন শিক্ষা বিক্রয়ের হাজার হাজার মুনাফামুখী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে নিম্নবিত্ত মা-বাবার সন্তানদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে মাদ্রাসাগুলোয়। বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। শিক্ষাজীবনের শুরুতেই শিশুকে ১১ ধরনের বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার জালে আটকে ফেলার এমন নৈরাজ্যকর বন্দোবস্তের নজির বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মা-বাবার বিত্তের নিক্তিতে নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে কে কিন্ডারগার্টেনে যাবে, কে সরকারি বা বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে সুযোগ পাবে, কার এনজিও স্কুলে ঠাঁই হবে, আর কাকে ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় পাঠিয়ে মা-বাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন? এর অন্য পিঠে দেশে ইংরেজি মাধ্যম কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা বৃদ্ধিকেও নাটকীয় বলা চলে। মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত মা-বাবারা তাদের সন্তানদের জন্য এখন আর বাংলা মাধ্যম প্রাইমারি স্কুলগুলোকে উপযুক্ত মানসম্পন্ন মনে করছেন না, কিন্ডারগার্টেনে পড়ানোটাই নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায়ও চারটি ধারার সমান্তরাল অবস্থান এখন আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছেইংরেজি মাধ্যমের নানা ধরনের মহার্ঘ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মূলধারার বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুল-কলেজ, বাংলা মাধ্যম বেসরকারি স্কুল-কলেজ এবং কয়েক ধরনের মাদ্রাসা। উচ্চশিক্ষার স্তরে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক।  এই বিভাজিত বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা এক দেশের মধ্যে চারটি পৃথক জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করে চলেছি।

নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ তখনকার মুক্ত বাজার অর্থনীতির ডামাডোলে শরিক হয়ে দলের রাজনৈতিক আদর্শ থেকে সমাজতন্ত্রকে বাদ দিয়ে মুক্ত বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠাকে বেছে নিয়েছিল। ওই সময় সারা বিশ্বে সেটিই ফ্যাশন ছিল। কিন্তু এখন যখন মুক্তবাজার অর্থনীতির মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাজার মৌলবাদী পুঁজিবাদের নগ্ন রূপ ফাঁস হয়ে গেছে, তখনো ওই পুঁজিবাদী পথকে আঁকড়ে থাকা কতখানি যৌক্তিক?

বাংলাদেশের অর্থনীতি যে গতিশীলতা অর্জন করেছে, তার প্রধান মাত্রাগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করলে বোঝা যাবে সাফল্য ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের কারণে নয়। প্রধান প্রধান সাফল্যের ক্ষেত্রগুলো দেখুন: . কৃষি খাতে চলমান বিপ্লব, . কোটি ২০ লাখ অভিবাসীর প্রেরিত বিপুল রেমিট্যান্সপ্রবাহ, . তৈরি পোশাক শিল্পের চমকপ্রদ বিকাশের কারণে ক্রমবর্ধমান রফতানি আয় অন্যান্য রফতানি পণ্যের বর্ধিত রফতানি আয়, . ক্ষুদ্রঋণের দ্রুত বিকাশ, . অর্থনীতিতে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার এবং . অর্থনীতিতে সঞ্চয় বিনিয়োগের সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি।

বাংলাদেশের চলমান কৃষিবিপ্লব আমাদের যা দিয়েছে: জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অত্যল্পতা এবং চাষযোগ্য জমির ক্রম-সংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ছিল মাত্র কোটি ১০ লাখ টন, ২০১৯ সালে তা সোয়া তিন গুণেরও বেশি বেড়ে কোটি ৬২ লাখ টন ছাড়িয়েছে। ধান, গম ভুট্টা মিলে ২০১৯ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল কোটি ১৩ লাখ টন। ৭০ লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে কোটি লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। হাঁস-মুরগি ডিম উৎপাদনে আমরা এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এমনকি গরু-ছাগল ফল উৎপাদনেও দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছি আমরা। আমাদের কৃষি ব্যবস্থা কি পুঁজিবাদী? সাফল্য তো প্রধানত কিষাণ নির্ভর উৎপাদন পদ্ধতি অবলম্বনেই অর্জিত হয়েছে, যেখানে সরকার কৃষিবান্ধব কৃষকবান্ধব নীতি গ্রহণের মাধ্যমে বিপ্লবকে বেগবান করে চলেছে।

বাংলাদেশের কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন। দেশে কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে জীবন-জীবিকার সন্ধানে মরিয়া হয়ে জায়গাজমি বিক্রয় করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে এসব অভিবাসীর ৯০-৯৫ শতাংশ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এই বিদেশ গমনের জন্য মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন তাদের সর্বস্ব দিয়ে হয়তো সহায়তা করেছেন। অতএব, নিয়মিতভাবে বিদেশে অর্জিত আয়ের ৫০-৭৫ শতাংশ এই অভিবাসীরা দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তাদের পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য। সেজন্যই প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যদিও কম দক্ষ শ্রমজীবী, তবুও পাঁচ দশক ধরে প্রতি বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েই চলেছে এবং ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারী সত্ত্বেও নিয়মানুগ মাধ্যমে বা প্রাতিষ্ঠানিক পথে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে (বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, হুন্ডির মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেশ বড়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর হয়তো এর পরিমাণ দাঁড়াত -১০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ২০২০ সালে হুন্ডি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় ওই বছর রেমিট্যান্স বেড়েছে ২৩ শতাংশেরও বেশি) রেমিট্যান্সপ্রবাহের জন্য ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের কৃতিত্ব কোথায়?

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশ মুক্ত বাজার অর্থনীতির অবদান নয়, মাল্টি ফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্ট জিএসপি নামের কোটা ব্যবস্থার সুফল নিয়েই সস্তা শ্রমের কারণে দেশে শিল্পটি বিকশিত হয়েছে। ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টরা এজন্য প্রধান কৃতিত্ব পাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। তবুও বলব, পুঁজিবাদের শ্রম শোষণের ক্ল্যাসিক নজির হলেও দেশের দ্রুত বিকাশমান পোশাক শিল্পে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর শ্রমিকদের বৃহদাংশই নারী। সমাজের দরিদ্র প্রান্তিক অবস্থানের এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতে কাজের ব্যবস্থা করাটা তাদের বঞ্চনা চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একটি তাত্পর্যপূর্ণ নিরোধক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বলতেই হবে, তৈরি পোশাক শিল্প খাত বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের একটি অত্যন্ত ইতিবাচক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে।

ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের সাফল্য গ্রামের ভূমিহীন নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেয়ার একটা অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের জীবন জীবিকাকে ক্ষুদ্রঋণ বেশ খানিকটা সহজ করে দিয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শুধু ক্ষুদ্রঋণকে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা কর্তৃক লালিত দারিদ্র্য সৃষ্টি পুনঃসৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলোকে কার্যকরভাবে মোকাবেলার যথার্থ প্রতিষেধক বিবেচনা করা সমীচীন নয়। কিন্তু দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেয়ার এই সফল উদ্ভাবনটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক দিক উন্মোচনের কৃতিত্ব দিতেই হবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বর্তমান সরকারের আরেকটি চমকপ্রদ সাফল্য। কিন্তু এর জন্য ক্রোনি ক্যাপিটালিজম কীভাবে কৃতিত্ব দাবি করবে?

বাংলাদেশের জাতীয় সঞ্চয় হার ৩১ শতাংশে পৌঁছে গেছে কিন্তু ব্যাংকের আমানতের ৫৮ ভাগ ক্ষুদ্র সঞ্চয়ীদের অবদান। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ব্যাংকে আমানত প্রবাহ অব্যাহত রাখছে। ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টরা বরং রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি হিসেবে ব্যাংকঋণ লুটপাট করছেন এবং ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন।

তাই সরকারের প্রতি আকুল আবেদন, ক্রোনি ক্যাপিটালিজমকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের রাজনীতি থেকে সরে আসুন। আয়বৈষম্য, শিক্ষায় বৈষম্য, স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য বৃদ্ধিকারী মুক্তবাজার অর্থনীতি আঁকড়ে থাকা স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।              

 

. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন