তারল্য নিয়ে ভুল পথে হাঁটছে কি ব্যাংক

হাছান আদনান

নতুন বিনিয়োগ থেকে হাত গুটিয়ে রেখেছে ব্যাংক। প্রণোদনার অর্থ বিতরণের পরও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার প্রায় অর্ধেকে। ব্যাংক খাত থেকে ঘোষণা অনুযায়ী ঋণ নিচ্ছে না সরকারও। পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতে তৈরি হয়েছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ অলস তারল্যের স্তূপ। গত ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের পরিমাণ ছিল লাখ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। ব্যাংকের অলস তারল্যের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আবর্তনের পরিবর্তে পুঞ্জীভূত অর্থ ব্যাংক খাতে বড় বিপদের পূর্বাভাস বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অলস তারল্যের জোয়ারকে সংকট হিসেবেই দেখছেন ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরাও। তার পরও ব্যাংকারদের বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ নেই কেন, তার উত্তর পাওয়া যায়নি। সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে না পারলে দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ ছিল ব্যাংকগুলোর কাছে। কিন্তু সে পথেও হাঁটছে না দেশের কোনো ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলোকে বিশেষ তহবিল গঠনের নির্দেশ দিলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তৈরি হচ্ছে না নতুন কর্মসংস্থান। অন্যদিকে নভেল করোনাভাইরাসসহ বৈশ্বিক নানা সংকটের কারণে গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাত সংকুচিত হয়েছে। কর্মসংস্থানও হারিয়েছেন অনেকেই। এখন সরকারও ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বিপরীতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ রেমিট্যান্সের উচ্চপ্রবৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোয় অলস অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। সংগৃহীত আমানত বিনিয়োগ করতে না পারলে ব্যাংকগুলোর জন্য তা বিপদ ডেকে আনবে।

অতিরিক্ত তারল্য ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর . মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সরকার স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ নিয়ে ব্যয় নির্বাহ করছে। কারণে ব্যাংক থেকে অর্থের জোগান দেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। এটি সরকারের দিক থেকে ভালো। তবে বেসরকারি খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। এজন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ নীতিপ্রণয়ন বাস্তবায়ন দরকার।

ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় মাঝারিদের সমস্যা না হলেও কুটির, ক্ষুদ্র ছোট উদ্যোক্তারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। . ফরাসউদ্দিনের ভাষ্য, ঋণের পাশাপাশি সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ প্রাপ্তি থেকেও ছোটরা বঞ্চিত হচ্ছে। অবস্থায় সিএসএমই খাতের ঋণের জন্য কাঠামোগত সংস্কার দরকার। এসএমইদের ঋণ দিতে পিকেএসএফ, এসএমই ফাউন্ডেশন বিসিককে কাজে লাগাতে হবে।

মুহূর্তে তারল্যের জোয়ার বইলেও এক বছর আগে তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছিল দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক। নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ (এসএলআর) সংরক্ষণেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলো। তারল্যের সংস্থান করতে বেশি সুদে অন্য ব্যাংকের আমানত বাগিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। আর এখন এর ঠিক উল্টো চিত্র ব্যাংকগুলোতে। বেশির ভাগ ব্যাংক আমানতের সুদহার কমিয়ে শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে। আবার কোনো কোনো ব্যাংক - শতাংশ সুদে বড় গ্রাহকদের ঋণও দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল লাখ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৮ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা ছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৮৩ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। আর ২২ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য জমা হয় বিদেশী ব্যাংকগুলোর হাতে। চলতি বছরের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ আরো বেড়েছে।

অতিরিক্ত তারল্য নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বলে জানান দি সিটি ব্যাংক লিমিটেডের শীর্ষ নির্বাহী মাসরুর আরেফিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, নতুন বিনিয়োগের জন্য আমাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু দেশে মুহূর্তে বড় কোনো শিল্প উদ্যোগ নেই বললেই চলে। ভালো ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। অন্যদিকে যারা ঋণ নিতে চাচ্ছেন, তাদের অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে ঋণ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতির কারণেই দেশের ব্যাংক খাতে অলস তারল্যের পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। এটি ব্যাংক খাতের জন্য কোনো ভালো সংবাদ নয়।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা ব্যাংকার জানান, সিটি ব্যাংকে মুহূর্তে হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। বড় গ্রাহকদের - শতাংশ সুদেও ঋণ দেয়া হচ্ছে। তার পরও অতিরিক্ত তারল্য বিনিয়োগের কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ঘাটতি বাজেট পূরণের জন্য ব্যাংক খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোট টাকা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০) দেখা যাচ্ছে, সরকার ব্যাংক খাত থেকে নিট ঋণ নিয়েছে মাত্র ৫৯৫ কোটি টাকা। যদিও ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথমার্ধে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৪৪ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল।

ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত তারল্যের অর্থ বিনিয়োগ করত সরকারি বিল-বন্ড বা কলমানি বাজারে। কিন্তু বর্তমানে ট্রেজারি বিলের সুদহার নেমে এসেছে শতাংশের নিচে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ইল্ডরেট ছিল মাত্র ৪৫ পয়সা। যদিও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৯১ দিন মেয়াদি বিলের ইল্ডরেট শতাংশের বেশি ছিল। ট্রেজারি বিলের মতোই সুদহারে পতন হয়েছে বন্ডে। বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদহার শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে চাহিদা না থাকায় কলমানি বাজারের সুদহারও নেমেছে শতাংশে। অবস্থায় সরকারি-বেসরকারি বেশির ভাগ ব্যাংকেরই ট্রেজারি ব্যবস্থাপনায় স্থবিরতা নেমে এসেছে।

অতিরিক্ত তারল্য বিনিয়োগ করতে না পারলে দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দেবে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, করোনাকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বহুমুখী উদ্যোগ, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য বাড়ছে। কিন্তু অতিরিক্ত তারল্য বিনিয়োগ করার মতো কোনো রূপরেখাও মুহূর্তে আমাদের সামনে নেই। সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যাদেশের বিপরীতে ঋণ ছাড়া বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ নেই। ধরনের পরিস্থিতিতে বাজারের তারল্য কমানোর ভালো উপায় হলো সিআরআর বাড়িয়ে দেয়া। কিন্তু সেটি করলে উল্টো ফলও হতে পারে।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমানতের সুদহার কমানোর মাধ্যমে আমরা ক্ষতি পোষানোর চেষ্টা করছি। আমানতকারীরা মুহূর্তে নামমাত্র সুদ পাচ্ছেন। ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে জমি কেনায় লাগাতে পারে। পাশাপাশি গ্রাহকরা মাল্টিপারপাস বা কোঅপারেটিভ প্রতিষ্ঠান কিংবা অস্থিতিশীল পুুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে সর্বস্ব হারানোর ঝুঁকি নিতে পারে।

তারল্যের সংকটের সময় দেশের মুদ্রাবাজারের ত্রাতা হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগ আমানতের জন্য সোনালী, জনতা, অগ্রণী রূপালী ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল ছিল। উচ্চসুদে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে আমানত ধার দিয়ে ভালো মুনাফা পেয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সে চিত্রও পাল্টে গেছে। এখন উদ্বৃত্ত তারল্য খাটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

আমানতে উচ্চপ্রবৃদ্ধির কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের এডি রেশিও নেমে এসেছে ৫৪ শতাংশে। অবস্থায় বিনিয়োগ বাড়ানোর নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংকটি। প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামস-উল-ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে আমরা অগ্রণী রিভেট লোন স্কিম নামে একটি প্রডাক্ট চালু করেছি। প্রডাক্টের আওতায় দেশের যেকোনো ব্যাংকের ভালো গ্রাহকদের আমরা শতাংশ সুদে ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে চাই। ছয় মাসের জন্য দেয়া ঋণের অনুমোদন বিতরণ প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কম্পিউটার কেনার জন্য আমরা প্রযুক্তি সহায়তা নামে একটি প্রডাক্ট চালু করেছি। প্রডাক্টের আওতায় শতাংশ সুদে ছাত্রদের ঋণ দেয়া হচ্ছে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। তবে এখন পর্যন্ত যে সাড়া পাওয়া গেছে তা সন্তোষজনক নয়।

প্রসঙ্গত, বিদায়ী অর্থবছরের শুরু থেকেই তারল্য সংকট ছিল দেশের ব্যাংক খাতে। আর অর্থবছরটি শেষ হয়েছে মহামারীসৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয় দিয়ে। পুরো অর্থবছরে ব্যাংক খাতে নগদ অর্থের সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। পরিসংখ্যান বলছে, বিদায়ী অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্যের জোগান দিয়েছে লাখ ৫৪ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। রেপো, স্পেশাল রেপো অ্যাসুরেড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) হিসেবে অর্থ দেয়া হয়। দেশের ইতিহাসে অতীতে কখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরিমাণ অর্থের জোগান দিতে হয়নি। পাশাপাশি প্রণোদনা হিসেবেও প্রায় লাখ কোটি টাকার অর্থ জোগান দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোগান দেয়া অর্থও মুদ্রাবাজারে রেকর্ড অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টির পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন