বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে হিমালয়

সাইফ বাপ্পী

শীতকাল এলেই গোটা লাদাখ অঞ্চলে নেমে আসে সুনসান নীরবতা। তাপমাত্রা নেমে আসে মাইনাস থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। ভারি তুষারপাতের কারণে স্থানীয় অধিবাসীদের জন্যও ঘর থেকে বের হওয়াটা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। রাস্তাঘাটও হয়ে পড়ে পুরোপুরি অবরুদ্ধ। তবে এবার শীত পুরোপুরি নেমে আসার আগেই থমথমে হয়ে উঠেছে লাদাখের পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি। আসন্ন সংঘাতের আশঙ্কা জেঁকে বসেছে স্থানটিতে। এশীয় দুই সুপারপাওয়ার চীন ভারত এখন ব্যস্ত লাদাখের শান্তিভঙ্গের সামরিক প্রস্তুতিতে। লাদাখের পাহাড়ি রাস্তায় মাঝেমধ্যে নিস্তব্ধতা ভেঙে সেনাবাহী কনভয় বা মাথার ওপর দিয়ে টহলদাতা যুদ্ধবিমান ছুটে গেলেও তাতে গুমোট ভাব কাটার বদলে বেড়ে যায়।

বিশ্বব্যাপী চলমান আঞ্চলিক সংঘাতগুলোর কয়েকটি এরই মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। আঞ্চলিক উত্তেজনা পরিণত হয়েছে সুপার পাওয়ারগুলোর ছায়াযুদ্ধে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিরিয়া লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ বা তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন নাগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার যুদ্ধের কথা। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীন ভারত মুহূর্তে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে গুরুত্বের দিক থেকে তা অন্য সব আঞ্চলিক বিরোধকে ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ দুটির মধ্যকার বিরোধে জড়িয়ে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের চিরবৈরী দেশ পাকিস্তানও। এক্ষেত্রে দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতিতেই ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন চলে আসার আশঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে তা অঞ্চলের কয়েকশ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকায় প্রভাব ফেলারও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

হিমালয়ের কোলে লাদাখে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নিতেই কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ (চতুর্পক্ষীয় নিরাপত্তা সংলাপ) বা কোয়াডের সম্মেলনে অংশ নিয়েছে ভারত। সম্মেলনে অংশ নেয়া অন্য তিন দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র মুহূর্তে চীনের প্রতি সবচেয়ে বেশি বৈরী মনোভাবাপন্ন দেশগুলোর একটি। অন্য দুই দেশ অস্ট্রেলিয়া জাপানেরও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছে না।

টোকিওতে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে চীনের প্রতি সরাসরি বিষোদগার করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। চীনের বিপক্ষে কোয়াড সম্মেলনে অংশ নেয়া দেশ চারটির মিত্রতাকে আরো শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া বা জাপানের পক্ষ থেকে সম্মেলনে সরাসরি চীনের কথা উল্লেখ করে কোনো বক্তব্যই দেয়া হয়নি।

কোয়াডের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৭ সালে, জাপানের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের প্রস্তাবের ভিত্তিতে। এরপর বহু বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক মিত্রজোটে রূপ নেয়নি কোয়াড। যদিও এরই মধ্যে কোয়াডকে চীনবিরোধী জোট হিসেবেই উল্লেখ করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। একই অভিযোগ চীনেরও। শুরু থেকেই কোয়াডকে নিজের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে এসেছে চীন। দেশটির বক্তব্য হলো ন্যাটোর এশীয় সংস্করণ হিসেবে কোয়াডকে দাঁড় করাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র, যা চীনের আঞ্চলিক স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করার এক প্রত্যক্ষ প্রয়াস।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক জোট গড়ে তোলা নিয়ে কোনোকালেই কোনো আগ্রহ দেখায়নি ভারত। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি ভিন্ন। চীনের সঙ্গে চলমান উত্তেজনা ভারতে নরেন্দ্র মোদির সরকারকে একধরনের উভয় সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। চীন আর ভারতের সামর্থ্যের ব্যবধান অনেকটা আকাশ-পাতাল। চীনের অর্থনীতির আকার ভারতের অর্থনীতির পাঁচ গুণ। সামরিক ব্যয়ও চার গুণ বেশি। অন্যদিকে চীন যেখানে মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে অনেকটাই পুনরুদ্ধার করে ফেলেছে, সেখানে বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে কভিড-১৯ চলাকালে সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স ছিল ভারতের। একসময়ে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে পরিচিতি থাকলেও মোদি সরকারের অধীনে কয়েক বছর ধরে মারাত্মক শ্লথতার মধ্যে ছিল ভারতীয় অর্থনীতি।

প্রকৃতপক্ষে মোদি সরকারের অধীনেই কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতি। কর্মহীনতা এখন সর্বকালের মধ্যে সর্বোচ্চে। সংকুচিত হচ্ছে শিল্পোৎপাদন। মুহূর্তে সংঘাত শুরু হলে তাতে যদি চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের দীর্ঘদিনের শত্রু পাকিস্তানও জড়িয়ে পড়ে, দুই ফ্রন্টে লড়াই চালানোর মতো সামরিক সক্ষমতা তৈরির সামর্থ্য এখন নয়াদিল্লির নেই।

অর্থনীতি সামরিক সক্ষমতার ব্যবধান সত্ত্বেও শক্তিশালী চীনের মোকাবেলা থেকে বেরিয়ে আসা মোদি সরকারের জন্য কঠিন, যদিও তার তূণীর পর্যাপ্ত তীরও অবশিষ্ট নেই এখন। চীনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত নিয়ে তার সরকারের অবস্থানেই তা পরিষ্কার। পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার সামান্যতম আঁচেও আগ্রাসী বক্তব্য দিতে খুব একটা সময় নেন না মোদি। কিন্তু চীনের সঙ্গে সংঘাত নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে  শব্দচয়নে বেশ সংযত ভাব বজায় রাখতে দেখা গিয়েছে তাকে। আদতে জনসমক্ষে নিয়ে খুব কমই কথা বলেছেন তিনি। নরেন্দ্র মোদি বরাবরই নিজেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের রক্ষক শক্তিশালী নেতা হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছেন। কিন্তু তিনি এও বুঝতে পারছেন, নয়াদিল্লির বাস্তবতা মুহূর্তে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়ার প্রতিকূলে।

চীন ভারতের জ্যেষ্ঠ সামরিক নেতাদের মধ্যকার এক সাম্প্রতিক বৈঠক শেষে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এতে উভয় পক্ষই সীমান্তে নতুন করে সৈন্য সমাবেশ না করার পাশাপাশি পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলার মতো কোনো পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার করে। বিবৃতির আরেকটি বক্তব্য ছিল, উভয় পক্ষই এখন সেখানকার পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের পরিবর্তন আনার প্রয়াস থেকে বিরত থাকবে। শর্তে সম্মতি দেয়ার মাধ্যমে ভারত সরকার স্বীকার করে নিয়েছে, চীনা সৈন্যদের তাদের সম্প্রতি দখল করে নেয়া ভূমি থেকে সরিয়ে নেয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরির ইচ্ছা মুহূর্তে নয়াদিল্লির নেই। এছাড়া চীনা সেনাবাহিনীকে সীমান্তে নতুন ওয়াচটাওয়ার-আউটপোস্টসহ নতুন স্থাপনা তৈরি থেকেও বিরত রাখার কোনো প্রয়াস নেয়া হবে না।

প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে শক্তির ভারসাম্য আনতে ভারতের মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ভরসা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। বর্তমানে নয়াদিল্লি ওয়াশিংটনের মধ্যকার সম্পর্ক অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ভালো। প্রকৃতপক্ষে চীনের সঙ্গে বিরোধই ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।

বৈরী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের শত্রুতা একসময় কেন্দ্রীভূত ছিল পাকিস্তানের দিকে। বর্তমানে তা এসে নিবদ্ধ হয়েছে চীনের ওপর। বিষয়টি মার্কিন কূটনীতিকদের জন্য বেশ সন্তোষের কারণ হয়ে উঠেছে। তারা মনে করছেন, চীনের প্রতি বৈরিতার দিক থেকে উভয় দেশের সাধারণ অবস্থান ভারতকে একটি কৌশলগত অংশীদারিত্বের দিকে ঠেলে দেবে। এর ফলে অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কোয়াড সংলাপে মাইক পম্পেওর চীনবিরোধী বক্তব্যের মূল বার্তা হতে পারে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পাবে ভারত। যদিও ভারত যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কখনই মিত্রতার অঙ্গীকার নিয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়নি। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিন জোটনিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখা ভারতের মধ্যেও এক ধরনের ঔদাসীন্য কাজ করেছে।

তবে হিমালয় অঞ্চলের সংকট পরিস্থিতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারত এখন একে অন্যের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতাকে আরো জোরদার করতে চাইছে। গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র ক্রয়ের পরিমাণ বাড়িয়েছে ভারত। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ভারত হাজার কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র কিনতে যাচ্ছে। অথচ ২০০৮ সালে দুই দেশের অস্ত্র বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল শূন্যের কাছাকাছি।

ভারত বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল অ্যাটোমিকসের কাছ থেকে ৩০টি এমকিউ-৯বি স্কাইগার্ডিয়ান ড্রোন ক্রয়ের প্রকল্পকে ফাস্ট-ট্র্যাকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাচ্ছে। ড্রোন ক্রয়ের চুক্তিমূল্য ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি বলে খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ড্রোনগুলো চীনের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করা হলে সেখানে ভারতের নজরদারির সক্ষমতা বাড়বে।

সেপ্টেম্বরে মালদ্বীপের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সই হয়। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল থেকে কয়েকশ মাইল দূরের ক্ষুদ্র দেশটিকে ব্যবহার করে চীনের আঞ্চলিক সম্প্রসারণ ঠেকাতে চাইছে ওয়াশিংটন। ভারত এতদিন নিজ সীমান্তের এত কাছাকাছি বিদেশী সামরিক শক্তির উপস্থিতির বিপক্ষ অবস্থানে থাকলেও এখন চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে দেশটি।

ফরেন অ্যাফেয়ার্স, ইকোনমিক টাইমস, বিবিসি অন্যান্য বিদেশী গণমাধ্যম অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন