সাইদা খানমের শেষ সাক্ষাৎকার

সদ্য প্রয়াত দেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানমকে নিয়ে ডকুফিকশন নির্মাণের উদ্দেশ্যে তার সান্নিধ্যে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন আলোকচিত্রী জান্নাতুল মাওয়া কথা বলেছেন। চিত্রধারণ করেছেন। ছবি তুলছেন। ২৪ জানুয়ারি ২০২০। গত শীতের কথা। সাইদা খানমের সঙ্গে সেসব কথোপকথন স্মৃতিকথাগুলো তুলে ধরেছেন তিনি

দৃশ্য

বাদল ঠিক অমলের মতো দইওয়ালার জন্য অপেক্ষা করে না , নিজের অসুস্থতার জন্য স্কুল যেতে পারে না তো কী হয়েছে ? বোনেরা স্কুলে চলে গেলে বাদল কাচারী পেরিয়ে ঠিক ইছামতীর পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে গা-ছমছম করা ব্রিটিশ সময়ের সেই পুরনো বাড়িটায় পৌঁছত। প্রায় সময় সেই বাড়ির বিশাল জানালায় উঁকি দিয়ে ভেতরে অশরীরী কিছু দেখার চেষ্টা করত। এখানে নাকি ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষকে নিয়ে এসে হত্যা করত! আবার কখনো মসজিদের পাশের পুকুরে বসে মাছদের খেলা দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামাত , ফিরতি পথে কচুর পাতায় ব্যাঙাচি নিয়ে এসে বয়ামে ছেড়ে দিত। কয়েক দিন পর সেগুলো ছোট ছোট ব্যাঙ হলে আবার ছেড়ে দিয়ে আসত। একবারতো দুষ্ট বন্ধুদের সঙ্গে সাঁতার না জানা বাদল নৌকায় ঘূর্ণির স্রোতের ভেতর ডুবতে বসেছিল, সে কথা মা আজও জানে না। (বাদলের ভাষায় আমার প্রথম জীবনটা খুব বাউণ্ডলে ছিল, জানো? )

দৃশ্য

যেদিকে যাওয়া নিষেধ ছিলপাঁচিল টপকে, সাপখোপের জঙ্গল পেরিয়ে, কাশফুল মাড়িয়ে ঠিক সেই দিক দিয়ে ক্লাসে ঢুকত বাদল। তাকে দেখে ছোটরাও দস্যিপনা করে ধরা খেত, সেজন্যে স্কুল শেষে উঁচু জায়গায় দাঁড় করিয়ে বাদলের বিচার হতো। একবার চার আনা জরিমানা করল। বাদল মার কাছ থেকে এনে দিয়ে সে যাত্রা রক্ষা পেল।

দৃশ্য

কবি খালা (মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা ) নাম দিয়েছিলেন বাদল খালা প্রায় সময় পাবনার বাড়িতে ক্যামেরাম্যান এনে হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধাতেন। নিজের ছবি তোলাতে ভালোবাসতেন, সেই সঙ্গে সারা বাড়ির লোকজনের সিঙ্গেল- গ্রুপ পোর্ট্রেট। সেই থেকে বাদলের প্রথম আকর্ষণ তৈরি হয় ক্যামেরায়। ভয়ও পেতেন ওই কালো কাপড়ে ঢাকা বক্স ক্যামেরাগুলো দেখে।

দৃশ্য

কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে শাড়ি পরা ঋজু ভঙ্গিতে একটি মেয়ে বক্স ক্যামেরা ঠিকঠাক করে দাঁড়িয়ে আছে, সামনে দুজন কাবুলিওয়ালার ছবি তুলছে মেয়েটি। যেন মিনি, তার বড়বেলায় কাবুলিওয়ালার দেখা পেল। রবিঠাকুরের কাবুলিওয়ালা বাদলের মনে দাগ কেটেছিল সেই কোন মেয়েবেলায়। ওটাই বাদলের তোলা প্রথম ছবি। ...তারপর বোন বিদেশ থেকে রলিকড এনে দিল। তারপর বেগম পত্রিকা থেকে সত্যজিতের অন্দরমহল ... কাহিনী সবার জানা।

দৃশ্য

চিত্রালী পত্রিকার অ্যাসাইনমেন্ট। তিনতলার স্টাডি রুমে সত্যজিৎ। নির্ধারিত সময়ে বাদল দরজায় দাঁড়ানো। পত্রিকার সম্পাদককে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ দিয়ে সাক্ষাৎকার নিতে এসেছে সত্যজিতের। ভেতরে কাজে নিমগ্ন রায়কে দেখে বাদলের মনে হলো আমার পক্ষে এত বড় মানুষের ইন্টারভিউ নেয়া সম্ভব না ফিরে আসার কথা ভাবার সময় মানিক বাবু টের পেলেন। বললেন কে? ভেতরে আসুন। বসুন। কী জানতে চান আমার সম্পর্কে? বাদল বুদ্ধি করে সত্যজিতের নতুন সিনেমার কথা শুরু করল। সত্যজিতের সঙ্গে কাজ শুরু করার পর বাদলের অন্যরকম জীবন শুরু হলো। তার ভাষায়, চোখ খুলে গেল যেখানে অন্য কারো যাওয়ার অধিকার ছিল না, সেখানে সাইদার যাতায়াত। এই সান্নিধ্য তাকে মানসিকভাবে আত্মপ্রত্যয়ী দৃঢ় করে তোলে এবং দুর্দান্ত কাজ করার অনুপ্রেরণা জোগায়।

রকম ফিকশনের মাঝে মাঝে সাইদা খানমের তোলা স্থির চিত্র। বাইস্কোপের মতো সাইদা খানমের সি্হর চিত্রগুলো একের পর এক ভেসে যাবে।...রূপলাল হাউজে বন্ধু থেকে সাঁওতাল মেয়ে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ থেকে কবি নজরুল, নীল আর্মস্ট্রং থেকে রানী এলিজাবেথ ... বন্দুক কাঁধে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্যারেড।

এরপর পর্দায় অমল কিশোরীর রিন্ রিন্ রিনা হাসি নিয়ে পর্দায় সাইদা খানম ওরফে বাদলের উপস্থিতি, সেই সঙ্গে আমাদের অনানুষ্ঠানিক কথোপকথন।

সাইদা খানমকে নিয়ে আমার ডকুফিকশন এভাবে শুরুর কথা ছিল।

কিন্তু ইছামতির ফ্লাশব্যাকের পরিবর্তে আমি ছুটে যাই বনানী গোরস্তানে। ১৮ আগস্ট ২০২০!!! অল্প অল্প বৃষ্টি তখন ঝরছে, যেমন করেই হোক শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হবে আপাকে। ছুটলাম মাকে নিয়ে, কভিড নিয়ে। অল্প অল্প বৃষ্টি তখনো জানান না দেয়ার ভান করে ঝরছে। আপাকে চারজন মানুষ সমাহিত করে মাটি ঠিকঠাক করছে। তৃতীয় লিঙ্গের জন জানতে চাইছিল বয়সে না করোনায়?

নিশাত জাহান রানা আপা একা দাঁড়িয়ে। তার হাতটা শক্ত করে নিজের মুঠোয় তুলে নিলাম। পাশে ঝন্টু। সব হারিয়ে নিঃস্ব যেন! দুই চোখ বেয়ে অবাধ্য জল...কেঁদেই চলছে। পাশের কবরের নয়নতারা গাছ থেকে কিছু নয়নতারা তুলে আপার গলার কাছে গেঁথে দিলাম। রানা আপা পরম যত্নে সাদা দোলনচাঁপা আপার বুকের পরে রেখে এলেন। কোটি কোটি মানুষের দেশে কী অনাড়ম্বর, সাজসজ্জাহীন নিঃসঙ্গ বিদায়!

পত্রিকার পাতা ভরে যাবে প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রীর প্রয়াণ সংবাদে। গল্প সবার জানা হয়ে গেছে এতদিনে যে সাইদ খানম আজ একটি প্রতিষ্ঠান। একদিন তিনি অনেক আলোকচিত্রীর গবেষণার বিষয় হবেন। পাঠ্যপুস্তকে তার সংগ্রামী বর্ণাঢ্য জীবনগাঁথা অনাগতদের পথ দেখাবে। আমাদের বঙ্গে যে সময় মেয়েরা দিনের আলোয় বাইরে বেরোতে সংকোচ করত, সেখানে সাইদা খানম দাপটের সঙ্গে আলো-ছায়ার জাদু দিয়ে মানুষের আত্মা বাক্সবন্দি করে বেড়াতেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, পূর্ব পাকিস্তানেরও প্রথম নারী আলোকচিত্রী তিনি। ইট, পাথর, কটূক্তি গায়ে মেখে, অন্ধকার সরিয়ে সাঁতরে সাঁতরে এতদূর এসে আমাদের পথটি করেছেন জলবৎ তরলং।

একটু দেরিতে আলোকচিত্রের মাঠে পৌঁছানোর কারণে ক্যামেরা হাতে ডাকসাইটে আলোকচিত্রী, প্রেস ফটোগ্রাফার সাইদা খানমকে ছুটতে দেখিনি কখনো। তাই তার কর্মময় জীবনের পুরোটাই আমার কাছে মিথ, শোনা গল্প। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝি কারিগরি দক্ষতা শুধু নয়, পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে স্পর্শকাতর শক্তিশালী যোগাযোগের মধ্যে দিয়েই তার ভেতরটা বাইরে এনে আলো দিয়ে আঁকা সম্ভব। ওই সময়ের বাস্তবতায় ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে কিশোরী সাইদা রথী-মহারথীদের কী করে সামলাতেন? আপাকে যত দেখতাম বিস্মিত হতাম!! যশ-খ্যাতি-পুরস্কার, ঈর্ষণীয় সেলেব্রেটি জীবন অনেকেরই থাকে। কিন্তু এসবের কিছুই একজন সাইদা খানমের মানুষিক শিক্ষা-উচ্চতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। একজন মানুষ কতটা সহজ-সরল-মানবিক গুণের অধিকারী হলে সর্বজনের গ্রহণযোগ্যতা পান, সবার শ্রদ্ধা কাড়েন, ভরসা হয়ে ওঠেন, তার দৃষ্টান্ত সাইদা আপা। মানুষের ভালোবাসা কেড়ে নেয়ার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন বাদল।

মানুষ যে তার স্বপ্নের চেয়ে বড়, মানুষ যে তার অবয়বের চেয়ে বড়, তা সাইদ আপা তার পরিবারের সংস্পর্শে না এলে অজানাই থেকে যেত।

হঠাৎ কবরের লাল মাটিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো মানুষের কি আসলেই শেষ হয়? বিচ্ছেদ হয়? মৃত্যু হয়? না, সে থেকে যায় তার কাজে, সম্পর্কে, ধারাবাহিকতায়, মানুষের হূদয়ে। সাইদা আপা কোথাও যাননি। এত সপ্রতিভ, উজ্জ্বল, প্রাঞ্জল উপস্থিতির দীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবন পৃথিবীতেই আছে আমাদের মাঝে, তার রেখে যাওয়া কাজে।

আপার জন্য নতুন করে কষ্টের কবর না খুঁড়ে বাসায় এসে জানুয়ারিতে তাকে নিয়ে যা ধারণ করি, সেই ফুটেজগুলো দেখতে থাকি। এইতো আমাদের ১৪/১৫ বছরের বাদল বসে আছে সাইদ খানম রূপে।

শেষ সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। শীত তখনো বিদায় নেয়নি। গলার কাছটি খালি ছিল বলে আমার মাফলারটা গলায় পরিয়ে দিলাম।

ক্যামেরা রোলিং ...

অমল কিশোরী বাদল বসে আছেন। কী সহজ কৌতূহলী দৃষ্টি, মৃদু অথচ স্পষ্ট সত্যকথনে জাদু বিস্তার করে চলছেন... জানো, আমার মা খুব ভালো মানুষ ছিলেন, খুব সাহসী মানুষ ছিলেন, আমি আমার মার কাছ থেকে সাহস পেয়েছি। আমাদের পরিবার খুব প্রগতিশীল ছিল। আমাদের বেড়ে ওঠার মা-খালা, বাবা, নানা বাড়ির প্রগতিশীল, উদার, পরিবেশ সহায়ক ছিল।

আমরা সাঁতার কাটতে কাটতে সবকিছুর ভেতর দিয়ে চলে এসেছি। প্রথম জীবনটা ঘুরে ঘুরে বাউণ্ডলে ছিল। বাবা সাব ইনস্পেক্টর ছিলেন, সে এক অন্যরকম জীবন ছিল। দুষ্টামির জন্য মা মার খেতাম। মা আমার খুব ভালো ছিল। খুব সাহসী ছিল... সেই সাহস আমি পেয়েছি।

আমার ভাই বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী আবদুল আহাদ... গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যেত আহাদ ভাইয়ের নতুন নতুন সুর শুনে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের. সাথে শান্তিনিকেতনে. পড়ার সময় থেকে বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা। আমার বোনরাও বিরাট মানুষ। বড় আপা আর্ট কলেজে পড়ত। দেয়ালজুড়ে সব আপার হাতে আঁকা ছবি, মেঝো আপা হোম ইকোনমিকস কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। আর এক ভাই ফরেস্টের বড় অফিসার ছিলেন।

আমার কবি খালা দারুণ প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। ছবিটা দেখো, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আর অতুল প্রসাদের সঙ্গে কবি খালা। খালা খুব স্মার্ট ছিল, না? শরত্চন্দ্রের সঙ্গে ছবি তোলা সে যে সে ব্যাপার না!

না না আমি কারো কাছে ফোটোগ্রাফি শিখিনি। নিজে নিজে শিখেছি (অহংকারের সঙ্গে ) সিনেমা দেখতে ভালোবাসতাম। মনোযোগ দিয়ে সিনেমার শট দেখে দেখে অনেক কিছু শিখেছি। আর পুরনো ম্যাগাজিনে ছবি দেখে দেখে। ছবি প্রিন্ট করাতে যেতাম পল্টনের জায়েদী স্টুডিওতে। জায়েদী সাহেব খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমাকে আলোকচিত্রের অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন।

 (বাকি অংশ আগামীকাল)

 জান্নাতুল মাওয়া: আলোকচিত্রী শিক্ষক, পাঠশালা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন