বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও জবাবদিহিতা প্রয়োজন

ধ্রুব শর্মা

জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের বিষয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে অবহিত করে। যেটি কার্যকর হবে আগামী বছর জুলাই থেকে। এই প্রত্যাহার মহামারী সামলানো নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমালোচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেয়া বক্তব্যের ফলাফল।

মে মাসের ১৮ তারিখ ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক . টেড্রোস অ্যাডহ্যানমকে লিখিতভাবে জানান যে বড় ধরনের উন্নতি না হলে যুক্তরাষ্ট্র সংস্থায় নিজেদের সদস্যপদ নিয়ে পুনর্বিবেচনা করবে এবং নিজেদের অর্থায়ন স্থগিত করবে। সেই ধারাবাহিকতায় ২৯ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানান তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে যাচ্ছেন।

এই প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান হতাশ মনোভাবের আরেকটি উদাহরণ। সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আইনে ধরনের পদক্ষেপের নিরর্থকতার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং সংস্থার কার্যকলাপেরও একটি বিকল্প পর্যালোচনা প্রয়োজন।

আইনি শাসন

আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বহুপক্ষীয় চুক্তি থেকে প্রত্যাহার পরিচালিত হতে পারে চুক্তির নিজস্ব পদ্ধতিতে কিংবা ভিয়েনা কনভেনশন অন দ্য অব ট্রিটিজ (ভিসিএলটি) অনুসারে অথবা প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনে। সংস্থাটির সংবিধান অনুসারে ধরনের প্রত্যাহারের কোনো স্পষ্ট বিধান নেই। ভিসিএলটির ৫৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে এক্সপ্রেস উইথড্রয়াল কিংবা ডিনানসিয়েশন প্রভিশন (যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধান) ছাড়া চুক্তি থেকে সরে আসা অনুমোদনযোগ্য নয়, যদি না চুক্তির পক্ষগুলো ধরনের প্রত্যাহারের অনুমতি দেয় অথবা চুক্তির প্রকৃতির মধ্যেই যদি তা অন্তর্ভুক্ত থাকে। পাশাপাশি ধরনের প্রত্যাহারের জন্য ১২ মাসের একটি নোটিস প্রদান করতে হয়। ৫৬ নম্বর অনুচ্ছেদের বিষয়বস্তু প্রকৃতিগতভাবেই প্রথাগত এবং তাই ভিসিএলটির অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের আবেদন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রত্যাহারের কোনো বিচারিক সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও ১৯৪৯ সালে কিছু রাষ্ট্র যেমন আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, বেলারুশিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদের প্রত্যাহার ঘোষণা করেছিল। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, তারা তখন সেটি করেছিল সংস্থাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের কারণে।

সংস্থার সংবিধানে প্রত্যাহারের ধারা নেই প্রসঙ্গে, মার্কিন কংগ্রেস ১৯৪৮ সালে সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সদস্যপদ অংশীদারিত্ব সম্পর্কিত একটি যৌথ ঘোষণা করে। ঘোষণাপত্রের নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সংস্থা থেকে নাম প্রত্যাহার করতে চাইলে এক বছরের নোটিস দিতে এবং সব অর্থনৈতিক লেনদেন মিটিয়ে ফেলতে হবে।

প্রত্যাহারের প্যারাডক্স

যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার প্রতিক্রিয়াশীল অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে, তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে গভীর সন্দেহের বাস্তবতা বোঝাও জরুরি। মহামারী শুরুর সময় সংস্থাটি ভাইরাসটির প্রকৃতি কিংবা তীব্রতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং পুরোপুরিভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। এমনকি তাইওয়ান বিপরীত প্রমাণ প্রদান করলেও শুরুতে মানুষ থেকে মানুষে ভাইরাস ছড়ানোর বিষয়টিও অস্বীকার করেছিল তারা। একই সময়ে ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অবহিত না করে চীন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ করেছিল। যা পুরোপুরিভাবে এড়িয়ে যায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সবশেষে সংস্থাটি কভিড-১৯ নিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করে ৩০ জানুয়ারি। যখন ভাইরাস সাত হাজারের বেশি মানুষকে আক্রান্ত করে ফেলেছিল।

এই আলোকে, সংস্থা থেকে প্রত্যাহার সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন নাও হতে পারে। যাই হোক, ধরনের প্রত্যাহার তাত্ক্ষণিক, পাশাপাশি এর দীর্ঘমেয়াদি পরিণতিও রয়েছে।

প্রথমত, একটি মহামারীকালে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থায় তহবিল ব্যাহত করা আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে হ্রাস করবে। দীর্ঘমেয়াদে প্রত্যাহার সংগঠনের কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত হস্তক্ষেপকে প্রতিরোধ করে এবং স্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থার সময় বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার সক্ষমতাকে হ্রাস করে।

বিকল্প প্রতিক্রিয়া

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে কভিড-১৯-এর অব্যবস্থাপনার যে অভিযোগ তার তদন্ত পুনর্গঠন দুটোই প্রয়োজন জবাবদিহিতার স্বার্থে। জাতীয় জবাবদিহিতা হতে পারে সংস্থার অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনার মাধ্যমে কিংবা দেশগুলো দ্বারা বাহ্যিক পর্যালোচনার মাধ্যমে।

১৪ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অস্থায়ীভাবে তহবিল স্থগিত করার পর সংস্থার মহাসচিব কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিক্রিয়া অভ্যন্তরীণভাবে পর্যালোচনার আশ্বাস দেন। ১৯ মে ৭৩তম ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে মহামারীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যকলাপের একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন ব্যাপক মূল্যায়ন করার সংকল্প ব্যক্ত করা হয়। যেখানে তাদের সময়সীমা এবং জাতিসংঘের অবদানের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। জুলাই মহামারী প্রস্তুতি প্রতিক্রিয়ার জন্য একটি স্বতন্ত্র প্যানেল স্থাপনের ঘোষণা দেন মহাসচিব। সব মিলিয়ে কভিড-১৯ মোকাবেলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অদক্ষতার পর্যালোচনা এবং জবাবদিহিতা প্রয়োজন। তবে সেটি প্রতিহিংসার রাজনীতির মাধ্যমে করা সম্ভব হবে না।

আউটলুক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন