কাপ্তাই হ্রদ দখল করে জেলা পরিষদের অভিজাত ক্লাব নির্মাণ!

প্রান্ত রনি, রাঙ্গামাটি

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম জলাধার কাপ্তাই হ্রদ বেদখল করে অভিজাত ক্লাবের স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের বিরুদ্ধে। হ্রদের ওপর নির্মাণাধীন এই ভবন নির্মাণে মানা হচ্ছে না কোন নিয়ম। এমনকি জেলা প্রশাসন নির্মাণ কাজ বন্ধে নির্দেশনা দিলে তাতেও কর্ণপাত করা হয়নি। সরকারি নিয়ম-নীতি অমান্য করে হ্রদের ওপরেই এই স্থাপনা নির্মিত হলে ওই এলাকায় বেশ কিছু জটিলতা সৃষ্টি হবে। 

স্থানীয়রা বলছেন, এই দখলের কারণে একদিকে সৌন্দর্য্য হারাচ্ছে কাপ্তাই হ্রদ। ঝুঁকিতে পড়বে জেলা শহরের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ তবলছড়ি নৌযান ঘাট, আরো সংকুচিত হবে নৌ-চলাচলের পথও। অন্যদিকে কাপ্তাই হ্রদ বেদখলে আরো উৎসাহিত হয়ে উঠবে হ্রদ খেকোরা।

রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ফ্রেন্ডস ক্লাব নামের এই অভিজাত ক্লাবটির স্থাপনা নির্মাণ কাজ শুরু হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে ‘ফ্রেন্ডস ক্লাব কাম কমিউনিটি সেন্টার’ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ৫ কোটি টাকা দরপত্র আহ্বান হয়। দরপত্রে অংশগ্রহণ করে কাজের কার্যাদেশ পায় মেসার্স এসএস ট্রেডার্স নামের স্থানীয় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে ক্লাবটির ভিত নির্মাণে ২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। নির্মাণকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ২৫ লাখ বিলবাবদ অর্থ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে আরো বরাদ্দের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জোর তদবির চলছে। সাততলা বিশিষ্ট এই স্থাপনার প্রতি তলার প্রতিটি ফ্লোর হবে সাড়ে ৪ হাজার স্কয়ার ফুট।

সোমবার দুপুরে সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, জেলা শহরের তবলছড়ি টেক্সটাইল মার্কেটের পিছনে অবস্থিত ক্লাবটির নিজস্ব জায়গা ফেলে সম্পূর্ণ কাপ্তাই হ্রদের ওপর সাততলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ভবনের বেশির ভাগ ভিত নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কাজ বন্ধের নির্দেশনা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্দেশনা অমান্য করে দ্রুতলয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য জেলাগুলোর সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর সরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পার্বত্য জেলা পরিষদ। তবে হ্রদ দখল করে অভিজাত ক্লাবের স্থাপনা নির্মাণে প্রশাসনেরও বাধা মানছে না এই সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। খোদ হ্রদ দখল করে জেলা পরিষদের স্থাপনা নির্মাণে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করাকে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ বলছেন স্থানীয়রা। এর আগে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে জেলা পরিষদেরই অর্থায়নে কাপ্তাই হ্রদ দখল করে জেলা শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পর্যটন মোটেল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। পরে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন। এদিকে পৌরসভা এলাকাতে যেকোনো স্থাপনা নির্মাণে পৌর কর্তৃপক্ষের অনুমতির বিষয়টির বাধ্যবাধকতা থাকলেও এ স্থাপনা নির্মাণে পৌরসভাকে অবহিত করা হয়নি বলে জানিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। 

পার্বত্য শহর রাঙ্গামাটির সবচেয়ে ‘বনেদী’ আর ‘অভিজাত’ ক্লাব হিসেবে পরিচিত ফ্রেন্ডস ক্লাবের হ্রদ দখল করে স্থাপনা নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে ক্লাব সভাপতি চিংকিউ রোয়াজার মুঠোফোনে একাধিবার যোগাযোগ করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। চিংকিউ রোয়াজা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য।

তবে নির্মাণকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসএস ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী মো. জসিম উদ্দিন বণিকবার্তাকে বলেন, আমি জেলা পরিষদের ঠিকাদার। জেলা পরিষদ যেখানে বলেছে আমরা সেখানেই কাজ করছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিয়ম অনুযায়ী জায়গার মালিক জেলা পরিষদ। পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন কত কিছুই তো হয় বুঝেন। আর এ ক্লাবের বিষয়টাতো একটু অন্যরকম। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ সবাই উপস্থিত থেকে কাজটা করেছেন। প্রথমে কাজটি ১ কোটি টাকা বরাদ্দের ছিল, যা এখন ৩ কোটি টাকা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেড় কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। 

রাঙ্গামাটির নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয় ও পরিবেশকর্মী মো. বখতেয়ার উদ্দিন বলেন, কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকাতে শুরু করলেই দখলের মহোৎসব শুরু হয়। এখন সেই মহোৎসবে যোগ দিয়েছে প্রভাবশালী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে নদী, খাল সব দখলমুক্ত করার কথা বলছেন, সেখানে কি করে কাপ্তাই হ্রদ দখল করে সরকারি অর্থায়নে কিভাবে ক্লাব নির্মাণ করে জেলা পরিষদ। বিষয়টি আমাদের খুব ভাবায়। সরকারি টাকায় অবৈধভাবে প্রভাব দেখিয়ে এভাবে নির্মাণ কাজ চালানো মূলত সরকারকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার সামিল। এ বিষয়ে অতিদ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে।

রাঙ্গামাটি পৌরসভার স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর পুলক দে বলেন, রাঙ্গামাটিতে ক্রমান্বয়ে কাপ্তাই হ্রদ দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বাড়ছে। এতদিন জেলা শহরের তবলছড়ি এলাকায় হ্রদের অংশটা ভালোই ছিল। কিন্তু ফ্রেন্ডস ক্লাব যেভাবে হ্রদ দখল করে ভবন তৈরি করছে, এতে করে সুযোগ সন্ধানীরা আরো অনুপ্রাণিত হচ্ছে। তখন জনপ্রতিনিধি হয়েও আমাদের আর কিছু বলার থাকবে না। কারণ তখন তারা সবাই ফ্রেন্ডস ক্লাবের উদাহরণ দিবে। শহুরে এলাকায় কিভাবে প্রশাসনের ‘নাকের ডগায়’ কিভাবে এমন স্থাপনা গড়ে উঠছে এই সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী বিরল বড়ুয়া বণিকবার্তাকে জানান, আমি দায়িত্ব নেয়ার আগে এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। বরাদ্দ আনুযায়ী আমাদেরকে ক্লাব নির্মাণের যে জায়গা দেখিয়ে দেয়া হয়েছে, সে স্থানেই নির্মাণ কাজ চলছে। সেটি খাস কিংবা বন্দোবস্তি জায়গা কিনা সে বিষয়টি আমরা দেখেনি। এখন ঊর্ধ্বতনরা যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা সেভাবেই পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।

সরকারি নির্দেশ মোতাবেক কাপ্তাই হ্রদের পানির রুলকার্ড অনুসারে ১২০ এমএসএলের নিচে ঘরবাড়ি কিংবা যেকোনো স্থাপনা নির্মাণের বিধান নেই। পানির রুলকার্ডের নিচে যেকোনো স্থাপনা সম্পূর্ণ বেআইনি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ বলেন, আমরা আমাদের কাজ করেছি। নিখিল কুমার চাকমা ও চিংকিউ রোয়াজা আমার কাছে এসেছেন (দুজনই সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও একজন ক্লাব সভাপতি আরেকজন সদস্য)। তাদেরকে কাপ্তাই হ্রদ থেকে খুঁটি সরিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। তারা কথা দিয়েছেন, হ্রদ থেকে খুঁটি সরিয়ে ফেলবেন। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে হ্রদের ওপর সরকারি অর্থায়নে কিভাবে ক্লাব নির্মাণ করা হচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তার উত্তর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানই ভালো দিতে পারবে।

হ্রদ দখল করে সরকারি অর্থায়নে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি স্বীকার করেই রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা বলেন, দেখুন পুরো রাঙ্গামাটি শহরেই দখল চলছে। পাবলিক হেলথ (জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল এলাকা), রিজার্ভ বাজারে হ্রদের অনেক অংশ দখল হয়ে গেছে। আর ফ্রেন্ডস ক্লাবটিও হ্রদের ওপরেই হচ্ছে সেটি ঠিক আছে। আমরা এখানে শুধু অর্থায়ন করছি, ফ্রেন্ডস ক্লাব কর্তৃডক্ষ যে স্থান দেখিয়ে দিয়েছে জেলা পরিষদের প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা সেখানেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বৃষ কেতু মনে করেন, হ্রদ দখল করে ক্লাবের স্থাপনা নির্মিত হলে ভবনের সামনের পাহাড়সহ আশপাশের পাহাড় ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে ভবনের পেছনের দিকের একটা একটা করে খুটি সরিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। আমরা খুটি সরিয়ে নিব।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি কমিটি রয়েছে। হ্রদ সংক্রান্ত বিষয়াদি জেলা প্রশাসক মহোদয়ই দেখেন। হ্রদের কতটুকু অংশে কিংবা রুলকার্ড হিসেবে কতটুকুতে স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে এসব। এর পরেও জেলা প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে আমাদের জানালে আমরা তখন হস্তক্ষেপ করব।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, রাঙ্গামাটির ক্লাবটি নির্মাণের ব্যাপারে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করা হয়েছে বলে বারবার তদ্বির করা হচ্ছে। হ্রদের পাড়ে এটি নির্মিত হচ্ছে বলে জানতাম, কিন্তু হ্রদের মাঝখানে থেকে নির্মিত হচ্ছে এমনটা জানতামই না। রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এটির ভালো জবাব দিতে পারবেন। তবে বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব।

প্রসঙ্গত, ১৯৬০ সালে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে নির্মিত হয় দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বাঁধের কারণেই তলিয়ে যায় পুরাতন রাঙ্গামাটি শহরসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। সৃষ্টি হয় প্রায় ১ হাজার ৭২২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের কাপ্তাই হ্রদের। তৈরি হয় রাঙ্গামাটির সাত উপজেলার সঙ্গে নৌ-পথে যোগাযোগ। এরমধ্যে বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলায় নৌপথ ছাড়া যোগাযোগের বিকল্প পথ নেই। শুধু তাই নয়, শহর ও দূর পাহাড়ের হ্রদবর্তী মানুষের পানীয় ও ব্যবহার্য পানির প্রধান উৎসও এই কাপ্তাই হ্রদ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন