কভিড-১৯

করোনায় দুর্নীতির মহামারী কী করা উচিত?

ড. এ. কে. এনামুল হক

চারদিকে দুর্নীতি। শত চেষ্টায়ও তা থেকে আমরা রেহাই পাচ্ছি না। গরিব জনগণকে চাল দিতে গিয়ে চোরের সংখ্যা দেখে সবার মতোই ভেবেছিলাম নেতারা দুর্নীতিগ্রস্তই হন। রাজনীতিবিদদের চরিত্রে দুর্নীতি লেখা রয়েছে। কিন্তু তা নয়, ভুল ভাঙল যখন প্রধানমন্ত্রী সভায় বললেন, এই মাস্কগুলো কারা সাপ্লাই করেছে খতিয়ে দেখা দরকার। রাজনীতিবিদরা ১০ কেজির বদলে নয় কেজি দিয়েছিলেন, এক কেজি হাতিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারি কর্মচারীরা? তবে সবকিছুর ব্যাখ্যা রয়েছে। আপনি কাউকে কটূক্তি করুন, দেখবেন তারও ব্যাখ্যা আছে। ডাকাতি করুন, তারও ব্যাখ্যা আছে। ভুলে যাবেন না, রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর কিংবা ভারতের ফুলন দেবী এসব চরিত্রের ব্যাখ্যা থেকেই তৈরি হয়েছিল।

তাই এবারো ব্যাখ্যার অভাব হলো না। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরটি জানাল, চালানটি ভুলে চলে এসেছে, ফেরত দিয়ে দেব। আর কোম্পানি ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। যারা মুখোশগুলো সাপ্লাই করেছিল, তাদের ব্যাখ্যা আরো সুন্দর! তাদের কোনো কর্মচারী নাকি ভুলে স্যাম্পলের জন্য তৈরি করা চালানটি দিয়ে ফেলেছে! অথচ আমার ধারণা ছিল স্যাম্পল বা নমুনা চালান তৈরি করা হয় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে, যাতে ক্রেতা আকৃষ্ট হন। জানতাম না যে নমুনা চালান খারাপ করে তৈরি করা হয়! তাও আবার ২০ হাজারটি! গল্পটি আপনাদের বিশ্বাস হয়? আমার হয় না।

এপ্রিলে তৃতীয় সপ্তাহে একটি সরকারি তথ্য দেখে আমি অবাক না হতাশ হব বুঝতে পারছিলাম না। টিভির স্ক্রলে দেখলাম তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি। সরকার দেশে এরই মধ্যে তিন কোটি চাল-ডালের প্যাকেট বিতরণ করেছে। বিরোধী দল ত্রাণ নিয়ে রাজনীতি করছে। সংবাদটি দেখে আমাদের খুশি হওয়ার কথা। কারণ বাংলাদেশে রয়েছে মোট চার কোটি পরিবার। তাই এক মাসে যদি তিন কোটি পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দেয়া হয়, তবে আমি আপনি ছাড়া সবারই একটি করে প্যাকেট পাওয়ার কথা (আপনাকেও অন্তর্ভুক্ত বললাম, কারণ যারা এই কলামটি পড়বেন, আমি মনে করি না আপনি এখনই লাইনে দাঁড়িয়ে প্যাকেট নিয়ে থাকবেন) আরেকটু ভেবে দেখুন। সরকারি প্রচেষ্টায় যদি এর মধ্যেই তিন কোটি পরিবারকে খাবার দেয়া হয়েই থাকে, তবে বিদ্যানন্দকে কেন আমরা সহায়তা দেব? তাদের কাজের দরকার রয়েছে কি? তথ্য সরবরাহকারী কতটা গাধা হলে এমন তথ্য আমাদের দেবে ধারণা করুন। আর তথ্যটি যদি সত্য হয়, তবে চুরির পরিমাণ কত বড় একবার ভেবে দেখুন। আমার পরিচিত কোনো গরিব পরিবার একটি প্যাকেট পায়নি। আপনার কি মনে হয় সরকারি ত্রাণদাতারা প্রতিটি পরিবারকে -১০ প্যাকেট করে ত্রাণ দিয়েছে? আমার মনে হয় না।

একবার গিয়েছিলাম সিলেটের কুলাউড়ায় গবেষণার কাজে। কথা বলতে গিয়ে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে ওষুধ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কারণ লোকজনের অভিযোগ ছিল যে তারা কখনো বিনে পয়সার ওষুধ দেখেনি। সবকিছুই কিনতে হয়। তাদের অভিযোগ ছিল, সব ওষুধই চুরি হয়। আমাদের জিজ্ঞাসার উত্তরে ডাক্তার মহোদয় জানালেন, দেখুন আমার বার্ষিক বাজেট এত টাকা, এই হাসপাতালটি প্রায় চার লাখ পরিবারের জন্য তৈরি। বার্ষিক বাজেটকে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে বছরে আমি প্রতিজনের জন্য পাই ১৬ টাকার ওষুধ। এখন বলুন কী করে আমি দেখাব কাকে বিনে পয়সায় দিই আর কাকে দিই না? যারা আপনার সঙ্গে কথা বললেন, তাদের কেউই বিনে পয়সার পাওয়ার উপযুক্ত নন, তাই সংগত কারণেই তারা পাননি। আমরা কেবল অতিগরিব রোগীকেই বিনে পয়সার ওষুধ দিই। সবাইকে নয়। যুক্তির কথা। বুঝলাম স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ কতটা কম, তা আমাদের ধারণায়ই নেই।

বলছিলাম দুর্নীতির কথা। কাহিনী শেষ হওয়ার নয়। আর মানবজাতিতে দুর্নীতি কখনই শেষ হবে না। মনে পড়ে গেল সেই গল্পের কথা। একবার এক রাজাকে তার প্রজারা জানাল যে রাজা আপনার এক কর্মচারী খুবই দুর্নীতিগ্রস্ত। তাতে রাজার বদনাম হচ্ছে। রাজা তা শুনে তাকে বদলি করে দিলেন। কিছুদিন পর সেখান থেকেও একই অভিযোগ। রাজা আবারো বদলি করলেন। কিন্তু অভিযোগ আসতেই থাকল। রাজা দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীর সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। ভাবলেন কী করা যায়? বললেন, কাল থেকে তোমার কোনো কাজ করতে হবে না। কেবল সমুদ্রের তীরে বসে ঢেউ গুনতে হবে। প্রতিদিন আমাকে জানাবে কতটি ঢেউ রাজ্যের তীরে আসে। রাজা ভাবলেন ব্যাটাকে চূড়ান্ত সাজা দেয়া হলো। এবার দেখা যাবে সে ঘুষ খায় কী করে? কিছুদিন পর জেলেরা এসে হাজির। হুজুর আমরা তো টাকা দিতে দিতে হয়রান। আর সম্ভব না। কেন? কারণ আমাদের নৌকা চালাতে দেয় না, তাতে নাকি আপনার ঢেউ গুনতে তার অসুবিধা হয়! বুঝতেই পারছেন। বদলি করে কোনো ফল হয় না। রাজনীতিকরা দুর্নীতি করলে কারাগারে যাবে আর সরকারি কর্মচারী দুর্নীতি করলে বদলি হবে, তা কখনই ন্যায়বিচারের পক্ষে যায় না।

আজকাল দুর্নীতি ধরাও কঠিন হয়েছে। পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের ভাষ্যে দুর্নীতির টাকা বিদেশে বেগমপাড়ায় পাঠাতে হয়। বহু সরকারি কর্মচারীর পরিবার এখন বিদেশী নাগরিক বা বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। আর তাদেরকে নিয়মিত মাসোহারা পাঠানো এখন ব্যবসায়ীদের দায়িত্ব। তাই অনেকের দুর্নীতি যেখানে চালের বস্তা উদ্ধারের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়, অনেকের দুর্নীতি যেখানে তোশকের ভেতর বা বালিশের ভেতর পাওয়া যায়, আধুনিক দুর্নীতির খোঁজ পেতে গেলে খোঁজ নিতে হবে স্ত্রী-সন্তানরা কোথায় থাকে।

দুর্নীতি বন্ধে আমাদের তোড়জোড় অব্যাহত থাকবে তা বলা বাহুল্য। তবে তার বাইরেও বেশকিছু পদক্ষেপ চালু করা উচিত। আগামীতে অত্যন্ত কঠিন অর্থনৈতিক অবস্থায় দুর্নীতি দূর করাই হবে সরকারের একটি প্রধান কাজ। এক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা জনগণ ক্ষমা করবে না।

আমাদের অনেকের ধারণা পাশ্চাত্য দেশগুলো দুর্নীতিমুক্ত। অথচ ঐতিহাসিকভাবে পাশ্চাত্য দেশগুলোই দুর্নীতিকে মদদ দিয়ে এসেছে। কী করে অন্য দেশের সম্পদ চুরি বা ডাকাতি বা মিথ্যার বেসাতি করে নিজ দেশে আনা যায়, তা করতে তারা এখনো পরিপক্ব। অবশ্য তাদের দুর্নীতির উদ্দেশ্য ভিন্ন। তারা চায় দুর্নীতি করে কী করে নিজ দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করা যায়। তাই দেখবেন এখনো পৃথিবীর সব দুর্নীতিবাজের আশ্রয়স্থল পাশ্চাত্য দেশগুলো। দেখবেন পাশ্চাত্য বিশ্ব নানা অজুহাতে আমাদের নতুন সব নিয়ম চালু করতে বলবে, যার জাঁতাকলে পড়ে আমাদের দেশ থেকে সহজেই অর্থ পাচার হয়ে যায়। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক চালু করেছে আর্থিক লেনদেন আইন। আইনে আপনাকে মাসে কবার ব্যাংকে টাকা আনতে যাবেন, কত টাকা ওঠাবেন, তাও অ্যাকাউন্ট খোলার সময় লিখে দিতে হবে। হাস্যকর এই নিয়ম কেবল আমাদের মতো দেশেই চালু করা সম্ভব। আমার টাকা ব্যাংকে জমা দিলে দেশের উপকার হয়। বিনিয়োগ হয়। যতদিন তা আমার পকেটে ছিল, আমি জবাবদিহি করিনি। এখন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার সময় আমাকেই সব বলতে হবে! মাসে কতবার আমি টাকা জমা দেব, কতবার ওঠাব, কাকে দেব, কে দেবেসব প্রশ্নের উত্তর আমাকে এখনই দিতে হবে। যেন আমি ভবিষ্যত্দ্রষ্টা! আমরা জানি যে সঞ্চয়ী আমানতে সপ্তাহে দুবারের বেশি টাকা ওঠানো যায় না। এর অতিরিক্ত নিয়ম কেন?

আরো আছে। একবারে পাঁচ লাখের বেশি ব্যাংকিং লেনদেন করলে তা আবার বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে নিয়মও চালু আছে। যে কারণেই এসব নিয়ম চালু হোক না কেন, তা কেবল সাধারণ গ্রাহককে বিপদে ফেলবে বা ব্যাংকে আসতে নিরুৎসাহিত করবে। যারা দুর্নীতিগ্রস্ত, তারা নিয়মটি জানে। তাই তারা লেনদেন করবে ক্যাশে বা নগদে। যেন ব্যাংকে তা দেখা না যায়। ব্যাংকের নিয়মকানুনের বেড়াজালে পরে বিপদ হতে পারে তা তারা জানে। তাই সেই টাকা তারা নামে-বেনামে বিদেশেই পাঠাবে। কোথায় যাবে? সেই সব পাশ্চাত্য দেশের ব্যাংকে, যারা নিয়মটি চালু করতে বলেছিল। কোটি কোটি টাকা যখন বিদেশী ব্যাংক গ্রহণ করে, তখন তাদের দেশে নিয়ম থাকে না কেন? এক হিসাবে বছরে অন্তত ৭০ হাজার কোটি টাকা এভাবে বিদেশে চলে যায়।

মোদ্দাকথা, পাশ্চাত্য দেশের কথায় ওঠাবসা থেকে কিছুটা বিরত থাকুন। নিজের দেশের স্বার্থে নিয়ম চালু করুন। করোনার কিট নিয়ে যখন কথা উঠেছিল তখন সিডিসির দোহাই দিয়ে ওষুধ কর্তৃপক্ষ বক্তব্য দিয়েছে। লজ্জার কথা। কে এই সিডিসি? কোন দেশের কর্তৃপক্ষ? আমরা কি এখনো বিদেশী দ্বারা শাসিত। নিজের নিয়ম কোথায়? সিডিসির নিয়মই যদি দেশের নিয়ম হয়, তবে আমাদের কর্তৃপক্ষের দরকার রয়েছে কি? আমরা আমাদের প্রয়োজনে আমাদের দেশের, আমাদের জনগণের পক্ষে নিয়ম চালু করব। কেন নিজেকে তুচ্ছজ্ঞান করছেন? স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশে ঔপনিবেশিক মানসিকতা কেন? দূর করুন এই মনোভাব। তবেই আমরা পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।

যা বলছিলাম। আমরা অন্যের দোহাই দিয়ে নিজেকে সুফি সাজাতে চাই। দুর্নীতি দূর করার একটি সহজ পদ্ধতি হলো, আমাদের সব লেনদেনের একটি লিখিত খাতা সংরক্ষণ করা। ক্যাশ বা নগদ লেনদেনে তা করা সম্ভব নয়। তাই লেনদেনে ক্যাশের ব্যবহার কী করে কমানো যায়, আর কী করে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন বাড়ানো যায়, সেই নিয়ম চালু করা উচিত বলে আমি মনে করি। আমাদের বর্তমান নিয়মগুলো লেনদেনকে ক্যাশে রাখার পক্ষে। আমরা চাইছি না যেন মানুষ ব্যাংকে আসুক। আমি ঠিক তার উল্টোটি চালু করার পরামর্শ দিচ্ছি। যেমন ধরুন সরকার যদি ক্যাশনির্ভর সব লেনদেন কমিয়ে দেয় বা বাংলাদেশ ব্যাংক যদি -মানি চালু করে, তবে সব লেনদেন হবে মোবাইল ব্যাংকে, বিকাশে, রকেটে বা -জাতীয় কোনো অ্যাপের মাধ্যমে। তখন কে কাকে কত টাকা দিল, তার একটি খাতা দেখা যাবে। কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ হলে বা কাউকে আপনি যদি ঘুষও দিতে চান (ক্যাশ না থাকলে), তখন ঠিকই জানা যাবে কে কীভাবে কোথায় টাকা পাঠাল। শুধু তাই নয়, ব্যবসায় কত টাকা আয় হলো, কত টাকা ব্যয় হলো, তাও থাকবে লিপিবদ্ধ। তখন দুর্নীতি করা কঠিন হবে। তবে অসম্ভব নয়। সাধারণ লোককে কিছু ভাবতে হবে না, কারণ তারা তাতে ভীত হবে না। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষে ব্যবসার ভ্যাট আদায় সহজ হবে। এমনকি দেখা যাবে ভ্যাট রেটও কমানো যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে দেশে দুর্নীতির মাধ্যমই হলো নগদ লেনদেন। করোনার এই সময় সরকারের কর আয় না বাড়ালে পরবর্তীতে অর্থনীতি দেউলিয়া হতে পারেএমন সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি দুর্নীতির চর্চা বন্ধ না করা গেলে জনরোষ বাড়বে। একই সঙ্গে নগদ নোট না থাকলে টাকা থেকে করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনাও থাকবে না। আপনি তো জানেন না, টাকা কত হাত বা কার হাত ঘুরে আপনার পকেটে ঢুকেছে! তাতে কি করোনার জীবাণু রয়েছে কিনা?

দেশের অধিকাংশ সরকারি কর্মচারী কিংবা রাজনীতিক যেখানে এখনো সৎ, সেখানে গুটিকয়েক দুর্নীতিগ্রস্তকে সহায়তা করার জন্য নগদ লেনদেনের নিয়ম চালু রাখার পক্ষে এখন আর কোনো যুক্তি নেই। নতুন নিয়মে ছোটখাটো দুর্নীতি প্রায় শূন্যে নেমে যাবে। আর তা সাধারণ জনগণকে ব্যাংক ব্যবস্থায় ফিরে আসতে সাহায্য করবে। তবে নিয়ম চালুর জন্য সরকারকে অর্থ ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, সপ্তাহেই চীন তার বেশ কয়েকটি বড় শহরে নগদ লেনদেনের বদলে -মানি চালু করেছে।

 

. . কে. এনামুল হক: অধ্যাপক অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন