লোপাটের পরিকল্পনা থেকে অপেশাদারদের নিয়োগ দেয়া হয়

রেস্টুরেন্ট কর্মচারী থেকে ব্যাংকের উচ্চপদে

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদেশে রেস্টুরেন্টকর্মী ছিলেন আব্দুল গফুর তালুকদার। ব্যাংকে চাকরির অতীত কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তার। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সও পেরিয়েছিলেন অনেক আগেই। তার পরও বেসিক ব্যাংকের তত্কালীন কর্তাব্যক্তিদের সুপারিশে ৫২ বছর বয়সে ব্যাংকটিতে সহকারী মহাব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। প্রথমে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হলেও পরে স্থায়ী করা হয় তার চাকরি। কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই বছর দুয়েক আগে অবসরেও চলে গেছেন কর্মকর্তা।

নিয়োগ নীতিমালা অনুসরণ না করে বেসিক ব্যাংকে সহকারী অফিসার পদে নিয়োগ পান ৪৮ বছর বয়সী মিনহাজ উদ্দিন আহম্মেদ, যদিও ব্যাংকিং পেশায় কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তার। একইভাবে ৪৭ বছর বয়সে ব্যাংকটিতে নিয়োগ পান সৈয়দা আফিয়া ইসলাম। শিক্ষাজীবনে এসএসসি এইচএসসিতে তৃতীয় বিভাগধারী কর্মীরও ছিল না ব্যাংকে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা। এখনো তিনি কর্মরত ব্যাংকটির শান্তিনগর শাখায়। অনিয়ম ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা যেসব শাখায় ঘটেছে, তার মধ্যে অন্যতম শান্তিনগর শাখা।

সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে নির্ধারিত বয়সসীমা অতিক্রম করা অন্তত ৫৩ জন বয়স্ক ব্যক্তি বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বিভিন্ন সময়। অপেশাদার এসব ব্যক্তিকে নিয়োগের মধ্য দিয়ে ব্যাংকের সম্পদ বৃদ্ধির পরিবর্তে দায় বৃদ্ধি করেছে নিয়োগ কমিটি।

বেসিক ব্যাংকে জনবল নিয়োগে অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের নিরীক্ষা প্রতিবেদেনেও। নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল।

কেবল বয়স্ক ব্যক্তিদের নিয়োগ নয়, অভিজ্ঞতা দেখানোর ক্ষেত্রেও কারচুপির ঘটনা ঘটেছে অনেক কর্মীর ক্ষেত্রে। অন্য ব্যাংকের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে উপব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ দেয়া হয় এসএম ইয়াসির আরাফাতকে। কোনো কৃতিত্বপূর্ণ কাজ না করেও চাকরির এক বছর তিন মাস বয়সে এক্সিলারেট প্রমোশন পান কর্মকর্তা। অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতে অনভিজ্ঞ চাকরির বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পরও দুই ধাপ ওপরের উপব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ পান শিহাব চৌধুরী। বাছাই পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ পান তিনি।

বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর থেকে ২০১৩ সালে বেসিক ব্যাংকের নিয়োগ-পদোন্নতি নিয়ে নিরীক্ষা করা হয়। নিরীক্ষাকালে ২০১৩ সালের আগের বছর পরের বছরের নিয়োগ-পদোন্নতির তথ্য খতিয়ে দেখা হয়। এতে দেখা যায়, ২০১১-১৪ সাল পর্যন্ত নিয়মের বাইরে গিয়ে হাজার ১৭৩ জনকে নিয়োগ দেয় ব্যাংকটি। এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে ৫৭ জন কর্মকর্তার পদোন্নতির ব্যবস্থাও করেন ব্যাংকের তত্কালীন চেয়ারম্যান। সেসব নিয়োগের অধিকাংশ এখনো বেসিক ব্যাংকে কর্মরত।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল নিয়োগই কেবল নয়, জীবনবৃত্তান্তের সঙ্গে চিরকুট লিখে পদ-পদবিও নির্ধারণ করে দিতেন বেসিক ব্যাংকের সে সময়ের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু। চেয়ারম্যানের নিয়মবহির্ভূত নির্দেশনা বাস্তবায়ন করত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ। জালিয়াতির মাধ্যমে বেসিক ব্যাংকের অর্থ লুটপাট করতেই রকম বয়স্ক অযোগ্য ব্যাংকিং খাতে অনভিজ্ঞদের নিয়োগ দিতেন তত্কালীন চেয়ারম্যান। আর ব্যাংকিং বিধি নিয়ম না জানার ফলে তাদের দিয়ে সহজেই নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ ছাড় করিয়ে নিতে পেরেছেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি ২০১০ সালের এক সার্কুলারে বলা আছে, প্রধান নির্বাহীর নিচে পরবর্তী দুই স্তর ছাড়া সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ পদোন্নতির ক্ষমতা প্রধান নির্বাহীর ওপর ন্যস্ত থাকবে। পর্ষদের অনুমোদিত মানবসম্পদ নীতি জনবল মঞ্জুরির ভিত্তিতে চাকরিবিধি মোতাবেক প্রধান নির্বাহী এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেবেন। পর্ষদ বা পর্ষদের কোনো কমিটির চেয়ারম্যান কিংবা পরিচালক এতে সংশ্লিষ্ট হবেন না বা হস্তক্ষেপ করবেন না। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি লঙ্ঘন করে ২০১০ সালের ২৯ জুলাই অনুষ্ঠিত বেসিক ব্যাংকের ২৭৪তম পর্ষদ সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে উপমহাব্যবস্থাপক পদে (প্রধান নির্বাহীর তিন ধাপ অধস্তন পদ) জনবল নিয়োগ বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা এককভাবে পর্ষদ চেয়ারম্যানের ওপর ন্যস্ত করা হয়।

২০১১ সালের জুলাইয়ে ১৪৬ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হলেও এজন্য পর্ষদ থেকে অনুমতি নেয়া হয় ২০১২ সালের জানুয়ারিতে। একইভাবে আরো ৩৬০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয় ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে। এজন্য অনুমোদন নেয়া হয় ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে, যা ব্যাংকিং আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এসব নিয়োগের জন্য কোনো নিয়োগ কমিটিও গঠন করা হয়নি। কিছু নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিটি গঠন করা হলেও তা কাগজেই সীমাবদ্ধ ছিল।

বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে ব্যাংকের গুলশান শাখায়। নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের সাময়িক বরখাস্তকৃত সহকারী মহাব্যবস্থাপক ওয়ালিউল্লাহকে উপমহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ দিয়ে ব্যাংকের গুলশান শাখায় ইনচার্জ হিসেবে পদায়ন করা হয়।

বেসিক ব্যাংকের ডিজিএম পদে কোনো ধরনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ পান মোহাম্মদ আলী। ২০১০ সালের ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ২৬৮তম বোর্ডসভার সিদ্ধান্তে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি ২০১১-এর জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত শান্তিনগর শাখায় শাখাপ্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার সময়ে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে সীমার অতিরিক্ত ঋণ দেয়া হয়।

জনবল নিয়োগ পদোন্নতির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১১ সালের এক আদেশে বলা হয়েছে, সরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া নিয়োগ বা পদোন্নতি কমিটির মাধ্যমে কোনো কার্যক্রম গ্রহণযোগ্য নয়। নিয়োগ পদোন্নতি কমিটিতে আবশ্যিকভাবে ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু বেসিক ব্যাংকে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করা হয়েছে। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকে নিয়োগের শর্তাবলি পরিপালন করা হয়নি। এর ফলে ব্যাংকটি থেকে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে সাড় হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়। ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিভিন্ন সময়ে ৬০টিরও বেশি মামলা করে। সেসব মামলার তদন্ত এখনো চলমান।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন