সিল্করুট

রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা

এসএম রশিদ


ইতিহাসবিদ আহমদ হাসান দানী লিখেছেন, শীতলক্ষ্যা নদীর বাম তীরে অবস্থান নিয়েছিলেন মুসা খানের সেনারা, আর অন্য তীরে ইসলাম খান চিশতির বাহিনী। লড়াইয়ের হাজারো যোদ্ধার রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল নদীর পানি। বাংলার বারোভূঁইয়ার অন্যতম ঈসা খানের পুত্র মুসার প্রতাপ শেষ হতে চলল। তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন। তার শক্তিশালী কেন্দ্রগুলো একে একে মোগলদের দখলে চলে যাচ্ছে। তিনি পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তার রাজধানী সোনারগাঁ ছেড়ে চলে গেলেন মেঘনার দ্বীপ ইব্রাহিমপুরে। দানী জানাচ্ছেন, দ্বীপটি যুগে আর শনাক্ত করা যায়নি। সোনারগাঁর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাজি শামসুদ্দিন বাগদাদী ইসলাম খানের কাছে শহর হস্তান্তর করেন। এটি ১৬১১ সালের এপ্রিলের ঘটনা।

মোগলদের এসব তত্পরতার কেন্দ্র তখন ঢাকা। আগে শহর ছিল মোগলদের একটি থানা। ইসলাম খানের আগমনের মাধ্যমে ঢাকা মোগলদের সামরিক কর্মকাণ্ডের সদর দপ্তর হয়ে ওঠে। আর রাজমহল থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বদলির মাধ্যমে মোগলদের সুবা বাংলার রাজধানী হয়ে ওঠে ঢাকা। এসবই দানী তার বইয়ে লিখেছেন।

এরপর আলোচনা, তর্কবিতর্ক কেন্দ্রীভূত হয় ঢাকার রাজধানী মর্যাদা পাওয়ার সাল-তারিখ নিয়ে। . এসএন ভট্টাচার্যের মতে, ইসলাম খান কর্তৃক ঢাকাকে রাজধানী করার সময়কাল ১৬১২ সালের এপ্রিল। তার যুক্তি রকম১৬১২ সালে কাছাড়ের রাজা আত্মসমর্পণ করলে বাংলায় ইসলাম খানের বিজয়াভিযান মোটামুটি পূর্ণতা পায়। সিলেট কাছাড়সহ পুরো বাংলা মোগল শাসনের অধীন আসে। এবার তিনি শাসনকাঠামোকে পূর্ণতা দিতে ঢাকাকে বাংলার রাজধানী ঘোষণা করলেন। আগের দুই বছরের বাংলা অভিযান রাজমহল থেকে পরিচালিত হয়েছে। ঢাকাকে রাজধানী করে ইসলাম খান এর নাম দেন জাহাঙ্গীরনগর। কিন্তু ভট্টাচার্যের এমন সিদ্ধান্তের সঙ্গে দানী একমত হতে পারেননি। কারণ বাহারীস্তানে এমন কোনো আনুষ্ঠানিকতার কথা উল্লেখ নেই। অন্যদিকে মির্জা নাথান ইসলাম খান ঢাকায় প্রথম প্রবেশের পর থেকেই শহরকে জাহাঙ্গীরনগর নামে সম্বোধন করেছেন। দানীর মতে, তাই ঢাকার রাজধানী হওয়ার সাল ১৬১২ মেনে নেয়ার কোনো কারণ নেই। আর ১৬১২ সালে ইসলাম খানের বাংলা অভিযানও সমাপ্ত হয়নি, যেমনটা ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন। বরং ১৬১৩ সালে ইসলাম খান কামরুপ জয় করতে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন। দানীর মত—‘নতুন রাজধানী (ঢাকা) প্রতিষ্ঠার একমাত্র যে তারিখটি গ্রহণ করা যেতে পারে সেটি হলো ইসলাম খানের ঢাকা প্রবেশের মুহূর্ত, অর্থাৎ ১৬০৮ সালের জুলাই মাসের শেষভাগ।

. আবদুল করিম অবশ্য তার বিশ্লেষণে এসএন ভট্টাচার্য এবং আহমদ হাসান দানীকে খণ্ডন করে ঢাকার রাজধানী হওয়ার তারিখটি নির্ধারণ করেছেন ১৬১০। তিনি বিভিন্ন উৎসের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ইসলাম খান ঢাকায় প্রবেশ করেছিলেন ১৬১০ সালে—‘ইসলাম খান দিউয়ান, বখশি, অ্যাডমিরাল সংস্থাপন বিভাগের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে গৌড় হয়ে পূর্ব বাংলার দিকে অগ্রসর হন। উত্তরবঙ্গের ঘোড়াঘাটের কাছে ১৬০৯ সালের বর্ষাকাল কাটিয়ে তিনি পরবর্তী বছর বর্ষার প্রাক্কালে অর্থাৎ ১৬১০ সালের জুলাইয়ের দিকে ঢাকা পৌঁছেন। বিষয়ে উপসংহার টেনে করিম লিখেছেন, ‘ কথা বলা যায়, ঢাকায় ইসলাম খানের প্রবেশের পর অথবা এখানে তার বাসস্থান স্থাপনের পর ঢাকাকে বাংলার রাজধানী করা হয়। একই সময়ে এর নাম পরিবর্তন করে জাহাঙ্গীরনগর নামকরণ করা হয়। যেহেতু সুবাদার এবং বখশি দিউয়ানের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা সমগ্র সংস্থাপন দপ্তরসহ যুগপত্ভাবে ঢাকায় প্রবেশ করেছিল, তাই একই সময়ে সমগ্র সরকারি সংস্থাপনা স্থানান্তরিত হয়ে যায়। পরবর্তীকালে দু-একটা অধস্তন বিভাগ স্থানান্তর অথবা স্থাপন রাজধানী স্থানান্তরের ক্ষেত্রে কোনো মুখ্য ব্যাপার নয়। এতে তথ্যের কোনো হেরফের হয় না। ১৬১০ সালে বাংলার রাজধানীতে পরিণত হওয়ার পর ঢাকার মর্যাদা পরবর্তী এক শতাব্দী পর্যন্ত অক্ষুণ্ন থাকে।

কাবেদুল ইসলাম তার সাম্প্রতিক গ্রন্থ রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা: সুবাদার ইসলাম খান চিশতিতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র এবং ঐতিহাসিক লেখকদের মতামত বিশ্লেষণ করে ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণার সময়কাল হিসেবে ১৬০৮ সালকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে সিদ্ধান্ত টেনেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সুবাদার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তির প্রায় প্রথম পর্ব থেকেই, অন্যকথায় ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে ঢাকায় এসে ইসলাম খানকে বুড়িগঙ্গার নদীর তীরে কৌশলগতভাবে সুরক্ষিত মজবুত ঘাঁটি তৈরি করে বিভিন্ন যুদ্ধ-পরিকল্পনা নানামুখী অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছিল। কাজেই বলা চলে, ইসলাম খান কর্তৃক রাজমহল থেকে বাংলার তখনকার রাজধানী আনুষ্ঠানিকভাবে সরিয়ে এনে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দেরই কোনো এক শুভক্ষণে।তবে কাবেদুল ইসলাম তার আলোচনার শেষে উল্লেখ করেছেন, এমনটাও হতে পারে ১৬০৮ সালে ইসলাম খান ঢাকায় ঘাঁটি গেড়ে অভিযান শুরু করেছিলেন এবং ১৬১০- ঢাকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সুবে বাংলার রাজধানী ঘোষণা করেন। তার কথায়, ‘ফলত সুবাদার ইসলাম খান কর্তৃক আকবরনগর বা রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর তথা ঢাকাকে মোগল বাংলার রাজধানীরূপে ঘোষণা ১৬০৮ বা ১৬১০ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে সংঘটিত হলেও সে কালটিকে কোনো অবস্থাতেই ১৬১২ খ্রিস্টাব্দ গণ্য করার সুযোগ নেই বলে আমরা মনে করি।

ইসলাম খানের ঢাকা আগমনের মুহূর্তটি কেমন ছিল। এর একটি চিত্র এফবি ব্রাডলি বার্ট উল্লেখ করেছেন—‘১৬০৮ সালে ইসলাম খান...রাজমহল পরিত্যাগ করে পূর্ব বাংলার পথে যাত্রা করলেন।...রাজধানী করার পক্ষে অনুকূল একটি স্থানের সন্ধানে পুনরায় যাত্রা করলেন এবং ধলেশ্বরী বুড়িগঙ্গার ভাটির দিকে চলতে শুরু করলেন। এখন যেখানে ঢাকা নগরী অবস্থিত ঠিক তার বিপরীত দিকে এসে তিনি থেমে গেলেন। তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন স্থানটি দেখে। তিনি বুঝতে পারলেন সামরিক দিক দিয়ে এটি হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তাছাড়া দূরবিস্তৃত উচ্চভূমি থাকায় এখানে যথেষ্ট সুবিধা পাওয়া যাবে। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই এখানে রাজধানী স্থাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

ঢাকা নগরের বিকাশ, যশ, মর্যাদা বৃদ্ধির পেছনে এর রাজধানীর মর্যাদা পাওয়ার ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। কথা অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। আবদুল করিম তার মোগল রাজধানী ঢাকা গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ঢাকা গৌরব প্রাধান্য অর্জন করে ১৬১০ সালে, ইসলাম খান চিশতি কর্তৃক এখানে বাংলার রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পর। ঢাকায় রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এবং প্রায় এক শতাব্দী পর্যন্ত ঢাকা রাজধানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকায় ঢাকা অনিবার্যভাবে বিকাশ লাভ করেছিল।

বাহারীস্তান--গায়বীতে বর্ণিত আছে—‘ইহতিমাম খান, তার পুত্র মির্জা নাথানসহ এক শুভ মুহূর্তে জাহাঙ্গীরনগর (ঢাকা) প্রবেশ করেন। ইসলাম খান ইহতিমাম খানের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য এবং নৌবহর পরিদর্শন করার উদ্দেশ্যে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তাকে অভ্যর্থনা করতে আসেন। তাদের সাক্ষাতের পর ইসলাম খান ইহতিমাম খান একটি হাতির হাওদায় চড়েন এবং মির্জা নাথানকে তার হাতির হাওদায় উঠতে বলেন। পরে তারা ঢাকা দুর্গাভিমুখে রওনা হন। তার আবাসস্থলে পৌঁছে ইসলাম খান পিতা পুত্রের প্রতি অমায়িক আতিথেয়তা প্রদর্শন করেন। গোলাবের আতর ছিটানোর পর তিনি ইহতিমাম খান মির্জা নাথানকে ডেমরা খালের মোহনার দুই পাশে অবস্থিত বেগ মুরাদ খান দুর্গ দুটির দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেন। এখানে দোলাই নদী দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে একটি খিদিরপুরের দিকে, অন্যটি ডেমরার দিকে চলে গেছে। অতঃপর ইসলাম খান তার নিজ বাসস্থানে ফিরে আসেন। ইহতিমাম খান উপরোক্ত স্থানে পৌঁছে এক তীরের দুর্গের ভার নিজে রেখে অন্যটির ভার মির্জা নাথানকে দেন।

ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের পর ইসলাম খান বেঁচে ছিলেন মোটামুটি তিন বছর। অন্যদিকে সময়কালেও তাকে বিভিন্ন সামরিক অভিযানে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। তার পরও তার আমলেই ঢাকা নগরের সম্প্রসারণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। আবদুল করিম লিখেছেন, ‘ইসলাম খানের সময় ঢাকা শহর পশ্চিমে চকবাজার থেকে পূর্বে সদরঘাট পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল এবং পরবর্তীকালে মোগলদের আগমনের ফলে পশ্চিমার্ধে বসতি স্থাপিত হয়। আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার এই, শহরটির বিস্তার নদীতীরেই হয় এবং দেশের অভ্যন্তরে উত্তর দিকে শহরের বিস্তার ঘটেছিল কিনা জানা যায় না। সম্ভবত চকবাজার থেকে উত্তর দিকে এবং পশ্চিম দিকে শহরের তখন সবেমাত্র পত্তন হয়েছিল।বাহারীস্তানের বিবরণ বিশ্লেষণ করে করিমের মতামতঢাকায় ইসলাম খানের বাসভবন ছিল পুরান ঢাকার পূর্ব সীমান্তের কোনো স্থানে।

ইসলাম খান ঢাকায় একটি দুর্গ নির্মাণ করিয়েছিলেন, যার অবস্থান ছিল পুরান ঢাকার এক সময়কার কারাগার চত্বরে। অবশ্য দুর্গটি অনেক আগেই কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে।

ঢাকায় ইসলাম খানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল মালিটোলা-তাঁতিবাজারের কোণে বুড়িগঙ্গা নদী দোলাইখালের মধ্যে একটি সংযোগখাল খনন। আবদুল করিমের মূল্যায়ন—‘ঘটনাক্রমে খননকৃত নতুন খাল দ্বারা মির্জা নাথানের বর্ণিত নতুন ঢাকা পুরান ঢাকা বিভক্ত হয়েছে।...নিঃসন্দেহে কৌশলগত কারণেই খালটি খনন করা হয়েছিল ইসলাম খানের নতুন শহরকে রক্ষা করতে।এন কে ভট্টশালীর মতে, চাঁদনীঘাট থেকে লক্ষ্যা নদীতে দ্রুত সেনা নৌযান প্রেরণের সুবিধার জন্য খাল খনন করা হয়েছিল।

ঢাকায় আজ ইসলাম খানের নাম টিকে আছে কেবল ইসলামপুর রোড আর ইসলাম খানকা মসজিদ নামের একটি মসজিদের সঙ্গে। অনেকের ধারণা, মসজিদ তিনি স্বয়ং নির্মাণ করিয়েছিলেন। কিন্তু আবদুল করিমের প্রশ্ন—‘যদি সত্যিই ইসলাম খান মসজিদটি নির্মাণ করে থাকেন, তাহলে কেন ইসলাম খান মসজিদটি তার বাসভবন থেকে এত দূরে নির্মাণ করেছিলেন?’ তাই বলা হয়, সড়কের নামকরণ এবং মসজিদ ইসলাম খানের পরবর্তী সময়ে কেউ নির্মাণ করে তার নামে নামাঙ্কিত করেছিলেন। থেকে ঢাকার ইতিহাসে ইসলাম খানের ভূমিকার একটি নিদর্শন পাওয়া যায়।

 

এসএম রশিদ: লেখক