শিগগিরই কমছে না যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অর্থনৈতিক ব্যবধান

বণিক বার্তা ডেস্ক

ছবি: রয়টার্স

প্রত্যাশার তুলনায় ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে ইউরোপের নীতিনির্ধারকদের উদ্বেগ বাড়ছে। একসময় বৈশ্বিক বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকা পালন করা ইউরোপ সে অবস্থান হারিয়েছে বেশ আগেই। সর্বশেষ কভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ব্যবধান আরো বেড়েছে। শিগগিরই এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা নেই বলে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

ইউরোপের সমস্যা নিয়ে সেখানকার নেতারা যে অবহিত, তা স্পষ্ট হয় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর সাম্প্রতিক মন্তব্যে। এপ্রিলে একাধিক বিষয়কে হুমকি উল্লেখ করে ইউরোপকে সতর্ক করে দেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক পতন, ক্রমবর্ধমান উদারনীতিবাদ ও পূর্ব সীমান্তের যুদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি প্রাক-মহামারী স্তরের তুলনায় মার্চে শেষ হওয়া প্রান্তিকে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ের ইউরোজোনের প্রবৃদ্ধি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক, প্রায় ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া যুক্তরাজ্যে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ।

মুদ্রানীতি প্রয়োগেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। ইউরোপের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি শক্তিশালী ধারায় ফেরার পূর্বাভাস রয়েছে। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের তুলনায় এ বছর সুদহার কমাবে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। এছাড়া জ্বালানি খাতে ইউরোপের খরচ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি। আবার স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গ্রিন এনার্জি ও সেমিকন্ডাক্টর প্রকল্পে ওয়াশিংটন আকর্ষণীয় ভর্তুকি দিচ্ছে। এ কারণে ইউরোপের কোম্পানি সেখানে কার্যক্রম স্থানান্তরে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইসিবির সাবেক প্রধান মারিও দ্রাঘিকে সম্প্রতি ব্লকের উৎপাদন খাতে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর উপায় নিয়ে কাজ করতে বলেছে ইইউ। ধারণা করা হচ্ছে, ইইউ অঞ্চলে পুঁজিবাজারের গভীর সংহতকরণ এবং প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অধিকতর কেন্দ্রীভূত বিনিয়োগের সুপারিশ করবেন তিনি। তবে সম্প্রতি সতর্ক করে মারিও দ্রাঘি বলেন, ‘পরিকল্পিত ও সমন্বিত কর্মকাণ্ড ছাড়া শিল্প স্থানান্তর বন্ধ হবে না।’

১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে ইউরোপের অর্থনীতি উচ্চ প্রবৃদ্ধি উপভোগ করছিল। স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর ইইউর বাজার আরো বাড়ে। কিন্তু বর্তমানে ২৭টি দেশের সম্মিলিত অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হার মেনেছে। এর পেছনে রয়েছে ধারাবাহিক বিপর্যয়, যার অন্যতম এক দশক আগে ইউরোজোন সৃষ্ট ঋণ সংকট। এরপর আসে কভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।

আইএমএফের তথ্যানুসারে, ক্রয় ক্ষমতার (পিপিপি) হিসেবে গড় মাথাপিছু আয় যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশের নিচে নেমে এসেছে ইউরোপে। এমনকি ইইউর সব প্রধান উন্নত অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে গেছে। ব্যবধানটি চলতি দশকের বাকি অংশে আরো বাড়বে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। কারণ হিসেবে দুর্বল চাহিদা, বিনিয়োগের অভাব ও শ্রম সংকটকে দায়ী করা হচ্ছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে মজুরি বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির চক্করে হারানো ক্রয়ক্ষমতা ফিরে পাচ্ছেন ক্রেতারা। কিন্তু বিপরীতে ইউরোপে পুনরুদ্ধার হচ্ছে ধীরগতিতে। এ পেছনের ভোক্তাদের উদ্বেগও কাজ করছে। জার্মান বীমা কোম্পানি অ্যালিয়ানজ ট্রেডের অর্থনীতিবিদ আনা বোটার মতে, সম্পদের সুষম ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে ইউরোপে। তিনি বলেন, ‘যদি জনকল্যাণ বা পেনশন ব্যবস্থা থেকে বেশি পাওয়ার আশা না করেন, তবে আপনি আরো বেশি সঞ্চয় করতে খরচ কমাবেন। এর সঙ্গে যদি যুদ্ধজনিত অনিশ্চয়তা যোগ হয়, তবে আরো হতাশা দেখবেন সামনে।’

বর্তমানে ইউরোজোনের মানুষ যা আয় করে তার ১৪ শতাংশের বেশি সঞ্চয় করছে, যা গড় হিসাবে একটি রেকর্ড। কিন্তু মার্কিন ভোক্তারা আয়ের ৫ শতাংশেরও কম সঞ্চয় করেন। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইউরোপে অনিশ্চয়তা বাড়ছে, যা অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি ব্যবসাবান্ধব ও বহুমুখী উদ্যোগের উপযোগী। এ কারণে প্রযুক্তি খাতে এ অঞ্চলে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। ইসিবির নির্বাহী ইসাবেল শ্নাবেল জানান, ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ইউরোজোন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ উৎপাদনশীলতা হারিয়েছে। এর পেছনে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকাকে উল্লেখ করেন তিনি। বিশেষ করে ক্লাউড কম্পিউটিং ও সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন খাতের দুর্বলতা প্রযুক্তি খাত প্রভাবিত করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপের উৎপাদনশীলতার ব্যবধান দীর্ঘস্থায়ী ও জীবনযাত্রার মানও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদ জেসন ফারম্যান. যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের উৎপাদনশীলতার ব্যবধান গত চার বছরের হিসাবে পরিমাপ করলে যুক্তরাষ্ট্রে মৃদু হতাশাজনক ও ইউরোপ ভীষণভাবে হতাশাজনক।

ইউরোপের অর্থনীতিতে অতিরিক্ত বোঝা হিসেবে যুক্ত হয়েছে বয়স্ক জনসংখ্যা ও কম জন্মহার। বেবি বুমার প্রজন্মের অবসরের পর শ্রম সংকট এরই মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে অর্থনীতিকে। বর্তমানে ইইউতে তিনজন কর্মজীবী ব্যক্তির বিপরীতে রয়েছেন একজন ৬৫ বছর বা বেশি বয়সী। ২০৫০ সালের মধ্যে এ অনুপাত হবে দুজনের বিপরীতে একজন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে চারজন কর্মক্ষমের বিপরীতে রয়েছেন একজন ৬৪ বছর বা বেশি বয়সী। ২০৫০ সালে এ অনুপাত হতে পারে তিনজনের বিপরীতে একজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন