বিশ্লেষণ

দেশে অতিধনী ও অতিদরিদ্রের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে

আবু তাহের খান

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বসাম্প্রতিক প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২’-এর তথ্য জানাচ্ছে যে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দেশে অতিধনী ও অতিদরিদ্র উভয় শ্রেণীর মানুষের সংখ্যাই উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে (সমকাল, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। তাছাড়া এ সময়ে গ্রাম ও শহরের মধ্যেও আয়বৈষম্য বেড়েছে, যেখানে ব্যাপক হারে কমেছে গ্রামীণ মানুষের আয়। অবশ্য ধনী ও দরিদ্র এবং গ্রাম ও শহরের মধ্যকার আয়বৈষম্য বৃদ্ধির এ ধারা গত দেড় দশকের এ-সংক্রান্ত ধারা ও প্রবণতা থেকে ভিন্ন কিছু নয়। আর রাষ্ট্রের যেসব নীতি ও সিদ্ধান্তের কারণে এসব ঘটছে, সেসব নীতি ও সিদ্ধান্ত যেহেতু একই কাঠামো ও আঙ্গিকে অপরিবর্তনীয় ধারায় অব্যাহত আছে, সেহেতু ধারণা করা যায় যে নিকট ভবিষ্যতেও বৈষম্যের এ ক্রমবর্ধমানতা একই বা তার চেয়েও অধিক গতিতে চলতে থাকবে। আর কবে নাগাদ তা থামবে, সেটি বস্তুত নির্ভর করছে বিদ্যমান নীতিকাঠামোয় রাষ্ট্র কবে নাগাদ নিম্নবিত্ত-সাধারণ মানুষের পক্ষে তার সিদ্ধান্তগুলো পুনর্বিন্যাস করতে উদ্যোগী হবে, তার ওপর।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কী সেসব নীতি ও সিদ্ধান্ত এবং কী সেসব রাষ্ট্রীয় চর্চা ও রাষ্ট্র সমর্থিত কর্মকাণ্ড, যেগুলোর কারণে দেশে পাল্লা দিয়ে অতিধনী ও অতিদরিদ্র উভয়ের সংখ্যাই ক্রমাগত হারে ও দ্রুতলয়ে বাড়ছে? এ তালিকায় একেবারে প্রথমেই রয়েছে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সহযোগিতা, সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের অভ্যন্তরীণ বস্তুগত সম্পদ, যথা খাসজমি, নদীনালা, খাল-বিল, পাহাড়, বনভূমি, চর, সাগর-মোহনা, পুকুর-ডোবা, পরিত্যক্ত শিল্প-কারখানা, বাড়িঘর ও স্থাপনা, ‘শত্রুসম্পত্তি’, বিরাষ্ট্রীয়করণকৃত শিল্প ইত্যাদি অবাধে দখল করে নেয়া। হিসাব করলে দেখা যাবে, এ জাতীয় দখলদারত্বের আওতায় গত ৫২ বছরে যে পরিমাণ ভূসম্পত্তি বিভিন্ন পর্যায়ের অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে, তার পরিমাণ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মোট আয়তনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বা তার চেয়েও বেশি হতে পারে। আর এসব ভূসম্পত্তির অবৈধ দখলদাররাই বস্তুত এখন দেশের শীর্ষ বিত্তবানদের তালিকার একেবারে প্রথম সারিতে রয়েছে। এদের মধ্যে বিশাল বিশাল আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার সুবাদে সাধারণ মানুষ যাদের ভূমিদস্যু হিসেবে চেনে, এ দেশে প্রকৃত ভূমিদস্যুদের তালিকা তার চেয়েও অনেক বড়, যার কিছুটা ওপরে উল্লেখ করা হলো। আর দস্যুতার এ প্রক্রিয়ায় সাধারণ বিত্তের মানুষও যে ক্রমান্বয়ে বিত্তহীন হয়ে পড়ছে, সেটিই বস্তুত দেশে অতিদরিদ্রের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ।

সম্পদের মালিকানা ও দখলদারত্বের মেরুকরণের ধারায় এর পরই রয়েছে শ্রম শোষণ। এ দেশের বিত্তবানদের একটি বড় অংশ বস্তুত এ শ্রম শোষণের মাধ্যমেই নিজেদের বিত্তবৈভবের জায়গাটিকে এতটা স্ফীত ও একচেটিয়া করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। চা বাগান, তৈরি পোশাক শিল্প, নির্মাণ শিল্প, পরিবহন, জাহাজ ভাঙা শিল্প, সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ, তথ্যপ্রযুক্তি, জনশক্তি রফতানি ইত্যাদি হেন কোনো খাত নেই যেখানে শ্রম শোষণের এ থাবা প্রকট থেকে অমানবিক হয়ে ওঠেনি (এমনকি আদিবাসী অধ্যুষিত কৃষিপ্রধান এলাকায় কৃষি খাতেও এ শোষণের বিস্তার প্রায় সমভাবে ক্রিয়াশীল)। আর এ শ্রম শোষণ প্রক্রিয়ায় অর্জিত একচেটিয়া মুনাফার ওপর ভিতি করে এ দেশে একটি নতুন বিত্তবান শ্রেণীই শুধু গড়ে ওঠেনি, সে বিত্ত এ দেশে একটি অমানবিক নিষ্ঠুর সমাজও তৈরি করেছে, যা পশ্চিমের পুঁজিবাদী সমাজ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুনাফার দাপট ও বিস্তার পশ্চিমের পুঁজিবাদী সমাজেও কমবেশি রয়েছে এবং বৈষম্য সেখানেও অনুপস্থিত নয়। কিন্তু পুঁজি ও মুনাফার এরূপ নিষ্ঠুর ও অমানবিক চেহারা পশ্চিমের দেশে একেবারেই অকল্পনীয়। এর একটি বড় কারণ এই যে রাষ্ট্র সেখানে পুঁজিমালিকদের মাধ্যমে জনগণের মানসম্মত জীবনযাপনের ন্যূনতম প্রয়োজন ও চাহিদাটুকু পরিপূরণের পরই কেবল পুঁজির অবশিষ্ট বিকাশকে উৎসাহিত করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্র সম্পূর্ণ একচোখা, যে চোখে সে শুধু বিত্তবান পুঁজিপতির স্বার্থই দেখতে পায়। তার দৃষ্টিহীন অন্য চোখ সাধারণ জনগণের কষ্টকে উপলব্ধি করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা তো দূরের কথা, দেখতেও পায় না।

বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আওতায় সম্পদ আহরণ এবং আহরিত সম্পদের বিতরণ ও বণ্টনের ক্ষেত্রে বিরাজমান অন্যায়, অদক্ষ ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থার কারণেও সমাজে অতিধনী ও অতিদরিদ্রের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। সেক্ষেত্রে কর, শুল্ক, খাজনা, ইজারা, স্ট্যাম্প, বন্ড, লিজ, শেয়ার বিক্রি ইত্যাদির ন্যায় সম্পদ সংগ্রহ পদ্ধতির আওতায় ন্যায্যতা অনুযায়ী তার তত বেশি অবদান রাখার কথা, যার যত বেশি সম্পদ। কিন্তু বাংলাদেশের চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার আওতায় ঘটছে তার উল্টোটি। এখানে বিত্তবানরা সরকারকে কম রাজস্ব দেয়, অর্থাৎ রাজস্ব প্রদানের ক্ষেত্রে তারা সরকারকে ফাঁকি দেয়; এবং যে পরিমাণে তারা ফাঁকি দেয়, সরকারও সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে সে পরিমাণ অর্থ নিম্নবিত্ত মানুষের কাছ থেকে আদায় করে নেয়। কারণ বাজেটের আওতাধীন পরিচালন ব্যয়গুলো নির্বাহের প্রয়োজনে রাজস্ব আহরণের ব্যাপারে নির্ধারিত বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চেষ্টা তাকে (সরকারকে) করতেই হয়। অথচ বিত্তবানরা যদি তা ফাঁকি না দিয়ে নিয়ম ও ন্যায্যতা অনুযায়ী পরিশোধ করত, তাহলে ওই পরিমাণ রাজস্ব পরিশোধ থেকে নিম্নবিত্ত মানুষ অব্যাহতি পেতে পারতেন। কিন্তু সেটি না হওয়ার কারণে তারই অনিবার্য ফল হিসেবে সমাজে অতিধনী ও অতিদরিদ্রের সংখ্যা ক্রমাগত হারে বাড়ছে।

হুবহু প্রায় একই কথা, আহরিত সম্পদের বিতরণ ও বিলি-বণ্টনের ক্ষেত্রেও (উন্নয়ন বরাদ্দ, পরিচালন ব্যয়, ভর্তুকি, প্রণোদনা ইত্যাদি)। সম্পদ আহরণ পদ্ধতির ন্যায় এক্ষেত্রেও অন্যায়, অনিয়ম, অদক্ষতা ও দুর্নীতিপরায়ণতায় এতটুকু কোনো ঘাটতি নেই। একটি ন্যায্য রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতায় এসব সম্পদ নাগরিকের প্রয়োজন ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সমতাপূর্ণভাবে বণ্টিত হওয়ার কথা থাকলেও দেশে বর্তমানে এর বেশির ভাগটাই হচ্ছে দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনায়, যেটি আবার প্রভাবিত হচ্ছে চতুর আমলা, ধূর্ত বণিক, সামাজিক টাউট ও অন্যান্য পর্যায়ের দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের দ্বারা। আর তারই ফলে উল্লিখিত বণ্টন প্রক্রিয়ার আওতায় রাষ্ট্রীয় সম্পদের সিংহভাগই রাতারাতি বিত্তবান শ্রেণীর হাতে চলে যাচ্ছে, অথবা সে সম্পদের মাধ্যমে নতুন বিত্তবান শ্রেণী গড়ে উঠছে। অন্যদিকে সম্পদের বিত্ত-বলয়মুখী ওই প্রবণতার অনিবার্য নিট ফলাফল হিসেবে দেশে বিত্তহীন বা নিম্নবিত্তের মানুষের সংখ্যাই শুধু বাড়ছে না, নতুন বিত্তবানদের রাজনৈতিক ও সামাজিক দাপট ও প্রভাবের কারণে নিম্নবিত্ত মানুষের অসহায়ত্বও দিনে দিনে প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে। মোট কথা, দেশে অতিধনী ও অতিদরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের মধ্যকার সামাজিক সম্পর্কটিও ক্রমান্বয়ে অমানবিকতার দিকে মোড় নিচ্ছে।

দেশে অতিধনী ও অতিদরিদ্রের সংখ্যা বাড়ার পেছনে দেশের আর্থিক খাতের সাম্প্রতিক ভূমিকার বিষয়টিও এখন প্রায় সর্বজনবিদিত। এ খাতের বিভিন্ন দুর্বল ও হীন আইন-কানুন, অপেশাদারি চর্চা, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা ইত্যাদি খাতটিকে এরই মধ্যে শুধু ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়েই ঠেকায়নি, এটিকে বিত্তবান লুটেরাদের এক নিরাপদ স্বর্গরাজ্যেও পরিণত করেছে। সেইসঙ্গে এ খাত থেকে প্রায় ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয়া হয়েছে নিম্নবিত্তের সাধারণ মানুষ ও ছোট উদ্যোক্তাদের। আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় অংশীদার দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যকার ১৯ প্রতিষ্ঠানের ২৪ ঘটনায় গত দেড় দশকে ৯২ হাজার কোটি টাকারও বেশি লোপাট হয়ে যাওয়ার উদাহরণই এটি প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে এ সময়ের মধ্যে দেশে অতিধনী সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ভূমিকাই অগ্রণী। আর এটা তো খুবই সাধারণ সূত্র যে দেশে অস্বাভাবিক হারে অতিধনী সৃষ্টি হওয়ার অর্থ হচ্ছে বিপুল সংখ্যায় অতিদরিদ্রের সংখ্যাও বেড়ে যাওয়া এবং বস্তুত সেটাই ১৫ বছর ধরে এ দেশে বিরামহীন গতিতে ঘটে চলেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আর্থিক খাতের ব্যাংক-বহির্ভূত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও এক্ষেত্রে নেহাত কম নয়।

রফতানি বৃদ্ধি, অপ্রচলিত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা ইত্যাদি বাবদ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিভিন্ন প্রকৃত-অপ্রকৃত উদ্যোক্তা ও রফতানিকারকদের যে পরিমাণ নগদ ভর্তুকি, প্রণোদনা ও অনুরূপ অন্যান্য আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হয়েছে, যার একটি বড় অংশই অসত্য ঘোষণা ও ভুয়া কাগজপত্রের ভিত্তিতে অন্যায়ভাবে তছরুপ হয়েছে, সেটিও সমাজে অতিধনী সৃষ্টি হওয়ার পেছনকার একটি বড় কারণ। এ-সংক্রান্ত সমুদয় তথ্য একীভূত ও সমন্বয় করলে দেখা যাবে যে প্রতি বছরের বাজেটের একটি বড় অংশই এ সৎ-অসৎ নগদ ভর্তুকি গ্রহীতারা খেয়ে ফেলছে। অথচ বহু বছর কিংবা কিছু বছর আগে বিশেষ প্রয়োজন ও পরিস্থিতিতে চালু হওয়া এসব নগদ ভর্তুকি ও প্রণোদনার এখন আর কোনো প্রয়োজনই নেই। কিন্তু কায়েমি সুবিধাবাদীরা কখনো রাজনৈতিক তদবিরে, কখনো আমলাতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষকে অনৈতিক পন্থায় সম্মত করে, আবার কখনো-বা কৌশলে উল্লিখিত উভয় পক্ষকে ফাঁকি দিয়ে বছরের পর বছর ধরে এসব সুবিধা গ্রহণ করেই যাচ্ছে। আর এটি যে কেবল দেশে অতিধনীর সংখ্যাই বাড়াচ্ছে তা-ই নয়, একই সঙ্গে তা রাষ্ট্রীয় বা জনগণের সম্পদের অপচয়ও ঘটাচ্ছে। 

সম্প্রতি নতুন অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর তৈরি পোশাক শিল্পসহ ৪৩টি শিল্পের ওপর থেকে সীমিত পরিসরে ওই ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে এ সংখ্যা হয়তো আরো বাড়বে। এ অবস্থায় এ নিয়ে সুবিধাভোগীদের মধ্যে কিছুটা শোরগোলও শুরু হয়ে গেছে। অথচ ২০২৬ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের পরবর্তী স্তরে উন্নীত হওয়ার সূচি অনুসরণ করার লক্ষ্যে আরো অনেক আগে থেকেই এ ধরনের ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত ছিল। ভাগ্যিস আবুল হাসান মাহমুদ আলী অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। নইলে নগদ ভর্তুকির আগের এ ধারা আরো যে কতদিন বহাল থাকত, তা কেবল ভবিতব্যই জানে। তবে যুক্তি এবং জনগণের কাছে দায় ও জবাবদিহিতার বিষয়টি মানলে এ ধরনের ভর্তুকি যত দ্রুত প্রত্যাহার করে নেয়া যায়, দেশ ও জনগণের জন্য ততই মঙ্গল। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সে মঙ্গলবোধ যতক্ষণ পর্যন্ত না জন্মাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রচলিত নীতি কাঠামোর আওতায় অতিধনীদের সংখ্যাই শুধু বাড়তে থাকবে না, একই সঙ্গে নিম্নবিত্তের বর্ধিত সংখ্যক মানুষও ক্রমান্বয়ে আরো বিত্তহীন হয়ে পড়বে। 

গ্রাম ও শহরের মধ্যে আয় ও বিত্তবৈষম্য বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও প্রায় অনুরূপ। বাংলাদেশের পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থাই এখন এককেন্দ্রিক ও একই সঙ্গে রাজধানীকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে সব সিদ্ধান্তও এখান থেকেই গৃহীত হয়। ফলে সে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতায় সম্পদের ভৌত অবস্থান যেখানেই থাকুক না কেন, এর মালিকানা, নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব যে রাজধানীকেন্দ্রিক শীর্ষ নেতৃত্ব ও তার নিকট পরিধিতেই সীমাবদ্ধ, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। সেক্ষেত্রে সম্পদের ন্যূনতম ভাগ পাওয়ার লক্ষ্যে সুপারিশ সংগ্রহকরণ কিংবা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে নিজের পক্ষে টানার জন্য রাজধানীই শেষ পর্যন্ত তার প্রকারান্তরিক গন্তব্য। আর এরূপ ক্ষমতা কাঠামোর আওতায় গ্রাম ও শহরের মধ্যে সম্পদবৈষম্য যে ক্রমাগত হারে বাড়তে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক এবং এটাও স্বাভাবিক যে সেটা অধিকাংশ গ্রামীণ মানুষের পক্ষে যাবে না

পরিশেষে সব মিলিয়ে তাই বলব, বাংলাদেশে অতিধনী ও অতিদরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াটা ঐতিহ্যিক ধারার কোনো গতানুগতিক বিষয় নয়। বরং এটি হচ্ছে রাজনীতি ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে একটি বিশেষ প্রভাবশালী শ্রেণী ও গোষ্ঠী কর্তৃক সচেতনভাবে নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার প্রয়াস এবং সে প্রয়াস বস্তুতই অতিধনিক শ্রেণীর এমন এক খোলামেলা ‘উন্নয়ন প্রচেষ্টা’ যেখানে তারা বলতে এতটুকুও সংকোচ বোধ করেন না যে উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে বৈষম্য বাড়বেই। অর্থাৎ বৈষম্যকে তারা মোটেও অন্যায্য বলে মনে করেন না। আর বৈষম্যকে যারা মোটেও অন্যায্য মনে করেন না তাদের পক্ষে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কীভাবে এবং কতটুকুই-বা সম্ভব? মোটেও সম্ভব নয়। আর তা সম্ভব নয় বলেই এ আশঙ্কা থেকেই যায় যে নিকট ভবিষ্যতের বাংলাদেশে অতিধনী ও অতিদরিদ্রের সংখ্যা দুই-ই আরো অধিক হারে বাড়তে থাকবে এবং সেটি বাড়তে থাকলে বিষয়টি এ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য শুধু একটি ভয়ের নয়, আতঙ্কেরও বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক 

বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন