সময়ের ভাবনা

সরকারি চাকরির প্রতিযোগিতা কিছু প্রচ্ছন্ন ইশারা

গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজীম

গত দশক থেকেই বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাগুলোর ফলাফল প্রকাশের পরপর সফল চাকরিপ্রার্থীদের নিয়ে গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনা ও উদযাপনের চিত্র চোখে পড়ে। পরিবার ও স্বজনদের কাছে সফল প্রতিযোগীরা অনেকটা সেলিব্রিটির মর্যাদা পান, পত্রিকাগুলোতেও তাদের প্রস্তুতি ও সাফল্যের বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখা যায়। সরকারি চাকরিকে সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে দেখার প্রবণতা অবশ্য নতুন কিছু নয়, ব্রিটিশ আমল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে সরকারি চাকরি সামাজিক মর্যাদা উত্তরণের হাতিয়ার।

পাশাপাশি একই সময়ে যারা বেসরকারি খাতে বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবন শুরু করেন তাদের নিয়ে সচরাচর এমন আলোচনা ও আগ্রহ দেখা যায় না। কিন্তু বেসরকারি খাতের অনেক বিশেষায়িত চাকরি অর্জনে সাফল্য সরকারি চাকরি প্রাপ্তির চেয়ে তুলনামূলক কম পরিশ্রম ও মেধার পরিচায়ক, এমনটি বোধহয় অনুমান করা সমীচীন হবে না।

সমাজে সরকারি ও বেসরকারি খাতের চাকরিপ্রাপ্তির সামষ্টিক উদযাপনের এ পার্থক্যের মাঝে বেশকিছু প্রচ্ছন্ন ইশারা আছে, দুশ্চিন্তার কারণও আছে। সেগুলো নিয়েই এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই।

তার আগে পাঠকের জন্য আরো কিছু তথ্য তুলে ধরা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক মনে করছি। ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে অন্তত ৪৯ হাজার ১৫১ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ৫৮টি দেশে পড়াশোনার জন্য গেছেন। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ১১২ এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৬ হাজার ৬০৯। ১৫ বছরে বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থী বেড়েছে তিন গুণ। আমরা ধরে নিতে পারি বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ যথেষ্ট মেধাবী, বিশেষত যারা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়তে যান। বিশ্বের অসংখ্য দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তাদের উন্নত বিশ্বের র‍্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জায়গা করে নিতে হয়।

এদিকে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে তারা ১৫ হাজার ১২৮ বিদেশীকে বাংলাদেশে চাকরির জন্য ওয়ার্ক পারমিট অনুমোদন দেয়, যা আগের বছরের তুলনায় ৮৭ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ৭ হাজার ৭৯০ বিদেশী নতুন ও ৭ হাজার ৩৩৮ বিদেশী আগের ওয়ার্ক পারমিটের নবায়ন চেয়েছেন বলে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। এ কর্মীদের সিংহভাগ রাশিয়া, চীন ও ভারতের নাগরিক।

এসব তথ্য থেকে তিনটি প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে—(১) দেশে অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি চাকরি বেসরকারি চাকরির চেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে, (২) পাশাপাশি মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশ বিদেশে চলে যাচ্ছেন এবং (৩) বেশকিছু খাতে বিশেষায়িত কর্মীর ঘাটতি রয়েছে, যা বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশ থেকে কর্মী এনে চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য করছে।

এ পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে এবার আমরা আলোচনার মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। সরকারি চাকরির বেতন স্কেল সর্বশেষ ২০১৫ সালে বড় আকারে বাড়ানো হয়েছিল। এরপর সাম্প্রতিক বছরগুলোর মূল্যস্ফীতিতে এ বেতন স্কেল চলতি বাজারে খুব আকর্ষণীয় কিছু নয়। তার পরও এ চাকরিগুলো নিয়ে বিপুল প্রতিযোগিতা ও আগ্রহ ইঙ্গিত দেয় যে সরকারি চাকরিতে আরো কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে যা শুধু বেতন দিয়ে বিচার্য নয়। যার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো, বেশকিছু সরকারি ক্যাডারের চাকরিতে অবৈধ অর্থ উপার্জনের অবারিত সম্ভাবনা, ক্ষমতার প্রদর্শন ও অপব্যবহারের সুযোগ। এছাড়া চাকরির দীর্ঘমেয়াদি নিশ্চয়তা, স্থায়িত্ব, অনেক ক্ষেত্রে সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়ালেখার সুযোগ ইত্যাদি বিষয়ও তরুণদের সরকারি চাকরিতে বেশি আগ্রহী করে তুলেছে গত দেড় দশকে।

এর বাইরে আরেকটি ব্যাপার মনে রাখা জরুরি, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমন অসংখ্য বিভাগ রয়েছে যাদের ডিগ্রির বেসরকারি খাতে কোনো চাহিদা নেই। এই গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরির বাজারে একমাত্র সুযোগ বিদ্যমান সরকারি চাকরিতে। এ পরিস্থিতি স্পষ্ট করে তোলে উচ্চশিক্ষায় আমাদের ব্যর্থ পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতা। ট্যাক্সের টাকা খরচ করে আমরা লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি এমন সব বিষয়ে যাদের জন্য বাজারে সেসব বিষয়ে কোনো কর্মসংস্থান নেই। তারা কম খরচে কোনোভাবে একটি সার্টিফিকেট লাভের আশায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ চার-পাঁচটি বছর এইসব ডিগ্রি অর্জনে ব্যয় করছে, এরপর মুখোমুখি হচ্ছে সরকারি চাকরির তীব্র প্রতিযোগিতার। অল্পসংখ্যক সফল হলেও একটি বড় অংশই দীর্ঘ বেকারত্বের চক্রে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষায় এভাবে রাষ্ট্রের সম্পদ ও ছাত্রদের সময়ের অপচয়ের এক অনন্ত চক্র চলমান রয়েছে বাংলাদেশে।

এর বিপরীতে বেসরকারি খাতের চাকরি অনেক ক্ষেত্রেই আর সরকারি চাকরির তুলনায় আকর্ষণীয় থাকছে না। মেধাবীদের আকর্ষণে সরকারি চাকরির বিপরীতে বেসরকারি খাত অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা যাচ্ছে, মেধাবী তরুণ কর্মজীবীদের অনেকে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বেসরকারি খাতে কর্মজীবন শুরু করলেও এরপর চলে যাচ্ছেন সরকারি চাকরির দিকে অথবা বিদেশে।

মেধাবী ছাত্র ও কর্মীদের বিদেশে চলে যাওয়ার প্রবণতা আগেও ছিল। কিন্তু পাশাপাশি বাজারে মেধাবী চাকরিপ্রার্থীদের সরকারি খাত তুলনামূলক বেশি আকর্ষণ করতে পারলে বোঝা যায় বেসরকারি খাত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের জন্য প্রণোদনা বাড়াতে পারছে না অথবা সরকারি খাত এমন কিছু একটা দিতে পারছে যা বেসরকারি খাতের পক্ষে দেয়া সম্ভবই নয়। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে এমনও হতে পারে যে বেসরকারি খাত সচেতনভাবেই প্রণোদনা বৃদ্ধি করছে না, যেহেতু বাংলাদেশের বিপুল চাকরিপ্রার্থীর বাজারে সস্তায় কর্মী পাওয়া খুবই সহজ। এ কারণগুলো মিলেমিশে আজকের পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

বেসরকারি খাতের চাকরির আকর্ষণ মেধাবী তরুণদের কাছে ক্রমশ ম্লান হয়ে যাওয়ার বহুমাত্রিক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে এর ফলাফল শুভ হবে এমন আশা করার কোনো কারণ নেই।

যেকোনো উন্নয়নশীল দেশেই সরকার ও প্রশাসন প্রবৃদ্ধির সহায়ক, কিন্তু মূল চালক বেসরকারি খাত। মেধাবী কর্মীদের আকর্ষণে বেসরকারি খাতের পিছিয়ে পড়ার অর্থ হলো মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বেসরকারি খাতে উদ্ভাবন, গবেষণা ও উন্নয়নের সক্ষমতা কমে যাওয়া। সস্তা শ্রমের সুবিধা নিয়ে মূল্য সংযোজন করে রফতানির প্রবৃদ্ধির যে ধারা বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে রচিত হয়েছে, তা থেকে পরবর্তী ধাপে যেতে হলে বেসরকারি খাতকে উদ্ভাবন ও নতুন নতুন বিশেষায়িত পণ্য/ সেবা খাতে প্রতিযোগিতা করতে হবে। মেধাবী নেতৃত্ব ও মানবসম্পদ ছাড়া তা সম্ভব হবে না।

স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে রাষ্ট্রের অর্থায়নে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশ যে মেধাবী মানবসম্পদ তৈরি করতে পারে তাও সীমিত। সেই সীমিত সম্পদের একাংশ বিদেশে চলে গেলে এবং আরেক অংশ সরকারি খাতে চাকরিতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকলে তা দুশ্চিন্তার কারণই বটে। এই দুশ্চিন্তা শুধু বেসরকারি খাতের জন্যই নয়, সরকারি খাতের জন্যও। বেসরকারি খাত ধারাবাহিকভাবে ভালো করতে না পারলে তা সবার জন্যই সংকট ডেকে আনতে পারে।

এ থেকে উত্তরণের পথ সহজ ও সরলরৈখিক নয়। তবে মোটাদাগে আমাদের দুটো আঙ্গিক থেকে ভাবতে হবে—১. সরকারি চাকরি থেকে যা আইনসম্মতভাবে পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু বাস্তবে সরকারি কর্মচারীরা যা পাচ্ছেন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে, সেসব প্রণোদনা কীভাবে কমিয়ে আনা যায় এবং ২. দেশীয় বেসরকারি খাতকে কীভাবে মেধাবী কর্মীদের জন্য আরো আকর্ষণীয় করে তোলা যায়।

সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের সাফল্য-ব্যর্থতার উদযাপন ও সরগরম আলোচনার পাশাপাশি এ পরিস্থিতির মাঝে প্রচ্ছন্ন দুশ্চিন্তাগুলো নিয়ে আমাদের বোধ হয় আরো বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজীম: ডিজিটাল ফাইন্যান্স এক্সপার্ট, ইউনাইটেড নেশন্স ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইউএনসিডিএফ)।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন