অভিমত

চা শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে রাষ্ট্র ও মালিক যখন একাকার

আবু তাহের খান

নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দিনে দিনে কষ্টকর ও অসহনীয় হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ১০ শতাংশ বিত্তবান দেশের মোট আয়ের ৪২ শতাংশ দখল করে আছে। তাদের রকেটগতির আয় বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৭৬৫ মার্কিন ডলার। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সাল নাগাদ তা একেবারে হেসেখেলেই ৩ হাজার ডলারকে ছাপিয়ে যাবে এমন আশা করাই যাই। তো যে দেশের মানুষের গড় আয় এখন ৩ হাজার ডলারের কাছাকাছি, সে দেশে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা (১.৫ ডলার)—শুনতে কি অবাক ও বিস্ময়কর লাগে না? তো এই ১৭০ টাকা মজুরির শ্রমিকের ৯৬ শতাংশের নিয়োগই আবার অনানুষ্ঠানিক। এ রকম অনানুষ্ঠানিক নিয়োগের আওতাধীন শ্রমিকরা যে তাদের নিয়োগকারীদের কাছ থেকে নিয়মিত উপেক্ষা, তাচ্ছিল্য, নিগ্রহ ও শোষণের শিকার হবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক এবং বাস্তবে হচ্ছেও তাই। উল্লিখিত শ্রমিকদের ৯৭ শতাংশেরই স্বাস্থ্যসম্মত কোনো প্রক্ষালন ব্যবস্থা নেই, সন্তান দিবা পরিচর্যা কেন্দ্রের সুবিধা নেই ৬৮ শতাংশের, আর শারীরিক, মৌখিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া তো সেখানকার নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে একেবারেই নিয়মিত ঘটনা। অন্যদিকে পুষ্টি, শিক্ষা, সাধারণ স্বাস্থ্য সুবিধা ইত্যাদির মতো মৌলিক মানবিক প্রয়োজনগুলোর ক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিস্থিতির বিষয়টি এখানে অনুল্লিখিতই থাকল।

এই যখন সংক্ষেপে বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের বঞ্চনা ও নিগ্রহের করুণ চিত্র, তখন এ করুণ দশা থেকে খানিকটা হলেও উপশম পাওয়ার আশায় নিজেদের দৈনিক মজুরি ১২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে বছর দেড়েক আগে ২০২২ সালের আগস্টে আন্দোলনে নেমেছিলেন ওই শ্রমিকরা। আন্দোলনের ধরন ও তীব্রতা দেখে প্রথম দিকটায় মনে হচ্ছিল, মালিক পক্ষ হয়তো তাদের মজুরি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়াতে সম্মত হবেন। কিন্তু স্বার্থ, সুবিধা ও শ্রেণিচরিত্রের বিবেচনায় রাষ্ট্র ও মালিক পক্ষের বন্ধন যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তখন সে আন্দোলন কি আর ধোপে টেকে? তাদের বর্ধিত মজুরি তখন আর দাবীকৃত ৩০০ টাকার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি—মালিক পক্ষ ও রাষ্ট্রের যৌথ আঁতাতে তখন তা ১৭০ টাকাতেই ফয়সালা হয়ে যায় এবং তা শুধু ফয়সালাই হয়নি—সেটি এমনই কুশলী ফয়সালায় রূপ নেয় যে দাবি পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও এবং ওই মুহূর্তে আক্ষরিক অর্থেই চা শ্রমিকদের অধিকাংশের পেটে আহার না থাকলেও আনন্দে আপ্লুত হয়ে তারা রাষ্ট্রের হাতে মূল্যবান উপহার সামগ্রী তুলে দেন।

মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা শ্রমিকরা ২০২০ সালেও একবার আন্দোলনে নেমেছিলেন। শ্রমিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, মালিক পক্ষ তখন তাদের মজুরি বাড়িয়ে দৈনিক ৩০০ টাকা করার আশ্বাস দিয়েছিল, যদিও মালিকরা এখন সে ধরনের কথা অস্বীকার করছেন (বিবিসি বাংলা, ২৭ আগস্ট ২০২২)। মোট কথা, মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চা শ্রমিকরা অনেকবারই তাদের দাবি-দাওয়া উত্থাপন করেছেন এবং সেসব দাবিদাওয়া শুধু যে যৌক্তিক তা-ই নয়—ন্যূনতম মানবিক জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্যও বটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এক্ষেত্রে শ্রমিকরা যা দাবি করছেন, প্রকৃত যৌক্তিক পরিমাণের চেয়ে তা অনেক কম। কিন্তু শোষিত ও নিগৃহীত হতে হতে নিজেদের অধিকার প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা এতটাই ভীতু এবং চিন্তা ও আশা-আকাঙ্ক্ষায় এতটাই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছেন যে জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজন ও চাহিদার কথা তুলে ধরার সাহসটুকুও তারা হারিয়ে ফেলেছেন। নইলে প্রায় ৩ হাজার ডলার মাথাপিছু আয়ের একটি দেশে একজন মানুষ দৈনিক ৫০০ টাকার কম মজুরি দিয়ে পরিবারের পোষ্যদের নিয়ে বাঁচার চিন্তা করেন কেমন করে? অথচ ২০২০ সাল থেকে দৈনিক মজুরি হিসেবে তারা চেয়ে আসছেন সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা।

বাংলাদেশের সব সরকারি ও অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই চাকরিতে যোগদানের একটি নির্দিষ্ট সময় পর (সাধারণত ছয় মাস থেকে এক বছর) চাকরি স্থায়ীকরণের বিধান চালু আছে। অথচ উপরোল্লিখিত প্রবন্ধের তথ্য অনুযায়ী ৯৭ শতাংশ চা শ্রমিকেরই স্থায়ী কোনো নিয়োগপত্র নেই। তা সত্ত্বেও সেখানে তারা বছরের পর বছর ধরে নিজেদের পরিপূর্ণভাবে উজাড় করে দিয়ে বিনা প্রতিবাদে নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ ও বৈশ্বিক ন্যায্যতা কি বলে যে তাদের এ নিরন্তর নিবেদিত চিত্ততা ও প্রতিবাদহীন নিভৃতচারিতা কোনো অপরাধ? যদি তা অপরাধ না হয়ে থাকে তাহলে তাদের এ অধিকারবঞ্চিত মানবেতর জীবনের জন্য কে দায়ী? রাষ্ট্রের কি এ ব্যাপারে কোনো দায় নেই? মালনীছড়া ও অন্যান্য চা বাগানের যে শ্রমিকরা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বুকের রক্ত দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের কাতারে নিজেদের যুক্ত করেছিলেন, তাদের কাছে এ রাষ্ট্র কী জবাব দেবে? শহীদ চা শ্রমিক হুসেনিয়া হাজরা, গুরনা ভর, বিনোদ সিং, অনুকূল গঞ্জ, কুলচন্দ্র তাঁতি প্রমুখের উত্তরসূরিদের কাছে কোন মুখে কোন ভাষায় এ রাষ্ট্র বলবে যে এই ৫২ বছর পরও আমরা তাদের জন্য দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি ও স্থায়ী নিয়োগপত্রের ব্যবস্থা করতে পারলাম না! 

তাহলে গত ৫২ বছরে আমরা কাদের জন্য কী উন্নয়ন করলাম? তবে কি উন্নয়ন করলাম শুধুই নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, স্বগোত্রীয় ও স্বশ্রেণীর মানুষের জন্য? মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যন্ত গ্রামের, পাহাড়ের, হাওরের, কৈবর্তপাড়ার, মুচিপল্লীর, কামারশালার তথা নিম্ন আয়ের, নিম্ন পেশার, নিম্ন শ্রেণীর প্রান্তিক মানুষরা কি তাহলে রাষ্ট্র স্বীকৃত সুবিধাপ্রাপ্তিযোগ্যদের তালিকায় পড়ে না? যদি পড়ে তাহলে যে সুবিধাভোগীদের খাতায় উল্লিখিত প্রান্তিক মানুষ বরাবর প্রান্তিকই রয়ে যাচ্ছে, তার ব্যাখ্যা কী? ওই যে সুবিধাভোগীদের পদভারে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, তাদের কণ্ঠের দরাজ শব্দে সব টেলিভিশনের পর্দা, তাদের গগনবিদারী আওয়াজে সব জনপদ নিরন্তর প্রকম্পিত হয়ে উঠছে, সেখানে শেষোক্ত ওই প্রান্তিক মানুষ নেই কেন? কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চা শ্রমিকদের উত্তরসূরিদের আজও ৩০০ টাকা মজুরির জন্য আন্দোলন করতে হয়? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রতিবেশী আসামে (ভারত) চা শ্রমিকদের দৈনিক ন্যূনতম মজুরি হচ্ছে ৩৩০ টাকা (২৫০ ভারতীয় রুপি) এবং শ্রীলংকার ক্ষেত্রে এটি হচ্ছে ৯৪০ টাকা (৪০৫ শ্রীলংকান রুপি)।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্টতই বলা আছে যেরাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে—কৃষক ও শ্রমিককে—এবং জনগণের অনগ্রসর অংশগুলোকে সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি দান করা। তো স্বাধীনতা লাভের ৫২ বছর পরও যদি ৯৬ শতাংশ চা শ্রমিক স্থায়ী নিয়োগপত্র না পান, ৯৭ শতাংশের স্বাস্থ্যসম্মত প্রক্ষালন সুবিধা না থাকে, ৬৮ শতাংশ নারী শ্রমিক দিবাভাগে কর্মরত অবস্থায় সন্তান পরিচর্যার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন, অধিকাংশ নারী শ্রমিক ক্রীতদাস-দাসীর মতো অহরহ শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে বুঝতে হবে যে সংবিধানে উল্লিখিত ‘জনগণের অনগ্রসর অংশগুলোকে সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তিদানের জন্য বাংলাদেশকে আরো বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে সেখানেও শর্ত এই যে চা বাগানসহ যেসব ক্ষেত্রে দেশের শ্রম শোষণ পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক, সেসব ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ অগ্রাধিকারমূলক সংশোধন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। নইলে সামনে যত বছরই পার হোক না কেন, দিনে দিনে পরিস্থিতির আরো অবনতি বৈ উন্নতি ঘটবে না। সেক্ষেত্রে সর্বশেষ পর্যায়ে খানিকটা হতাশা যুক্ত হলো এ কারণে যে আগামী ৭ জানুয়ারির বহুল আলোচিত নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারেও প্রান্তিক পর্যায়ের শ্রমিক ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর শোষণমুক্তির তেমন কোনো অঙ্গীকার নেই। 

আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক 

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)

শিল্প মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন