বিশ্ব অর্থনীতি

অর্থ কীভাবে জীবনকে জটিল করছে

ক্যাথরিনা পিস্তর

অর্থ ব্যবস্থাকে মনে করা হতো চাহিদা পূরণের হাতিয়ার, এটাই মুখ্য ছিল না। খাদ্য ও আবাসন থেকে পারিবারিক ছুটি কাটানো পর্যন্ত দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেকটি কাজ আর্থিক পরিশোধের মাধ্যমে আমরা একভাবে না একভাবে শেষ করি। যদি আমাদের হাতে নগদ টাকা না থাকে, আমরা ঋণ নিই।

কোম্পানিগুলোও তাই করে। হয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় অথবা তারা শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে। এটা নেয় বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। যারা ভবিষ্যতে লাভের আশায় বিনিয়োগ করে। এভাবে পুঁজি গ্রহণকারী ও অর্থদাতা উভয়কে একসঙ্গে করে পুঁজিবাজার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷

ফাইন্যান্স এখন আর শুধু মধ্যস্থতাকারী নয়। যা সঞ্চয়কারী থেকে ঋণগ্রহীতাদের হাতে টাকা সরবরাহ করে। এর কার্যকারিতা আর এমন লোকদের মধ্যে টাকা দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, যারা ভবিষ্যতে সুদাসলে টাকা ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করবে। বিপরীতে, ফাইন্যান্স এখন চালকের আসনে। এটা সরকারসহ অন্যদের জন্য এজেন্ডা নির্ধারণ করছে।

ফাইন্যান্সের দুটি বড় সমস্যা রয়েছে। এক. এটি বোবা। কারণ, এটি শুধু সংখ্যা পড়তে পারে। বুঝতে অক্ষম। কম মূল্যায়িত। কঠিন সামাজিক সমস্যা বা জটিল ব্যবসা বা প্রকৌশল পরিকল্পনাভুক্ত। দুই. এটি বিপজ্জনক। কারণ, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে থাকা লোকেরা মনে করে যে তারা বেশি স্মার্ট (বাস্তবে যতটা নয়)। এ কারণে তাদের ধারণা, সমাজের নেত্বত্বে তারাই থাকবেন।

আপনি যদি প্রাইস ট্যাগের দিকে তাকান, তবে বিশ্ব শাসন করা সহজ বলে মনে হতে পারে। সবকিছু তুলনা করা যায়। লাভ করার জন্য শুধু কম টাকায় কিনতে হবে এবং বেশি টাকায় বেচতে হবে। টাকা কোথায় খাটাচ্ছেন, কী কেনেন বা বেচেন—এসব নিয়ে মাথা না ঘামালে আপনি নৈতিক বিনিয়োগকারী নন। একটি পণ্যের বাস্তব গুণ, নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য বা সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মূল্যনির্ধারণ প্রক্রিয়া জড়িত।

প্রকৃতপক্ষে, বিনিয়োগকারীরা যত কম জানেন বা এ ধরনের বিষয়ে কম যত্নবান হবেন, বাজার তত বেশি তারল্য সংকটে পড়বে। তাই যে সম্পদগুলো দীর্ঘকাল ধরে রয়েছে, যেমন তেল ও গ্যাস কোম্পানির শেয়ার, – নতুন ব্যবসার তুলনায় বেশি আকর্ষণীয়৷ নথির অভাবে সম্পদের দাম কম বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে পারে, যা লাভের অনিশ্চয়তার বার্তা দিতে পারে।

ফাইন্যান্স এভাবে বিতর্কের প্রয়োজনীয়তা দেখিয়ে মিলিয়ে যায়। যদি প্রত্যেকে বুঝতে পারে যে দাম কী? আলোচনা করার আর কিছুই বাকি থাকে না৷ আপনি যদি বিশ্বাস করেন, কোনো পণ্যের দাম বেশি, আপনি এটি কমাতে পারেন৷ বাজারে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রয়োজন হয় না। এটা এখানে এবং এখন সর্বোচ্চ দরদাতার হাতে সম্পদ তুলে দেয়।

এ প্রবণতা মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে সমস্যা ও সমাধানের অদলবদল করে। এটা কেবল বাজার কারবারির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অনেক সরকার স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এ পদ্ধতি মেনে চলে। এমনকি ঋণদাতার শর্তগুলো মেনে নিতে বাধ্য হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেশনাল বাজেট অফিসকে অবশ্যই আইন প্রণয়নের খরচ এবং সুবিধার ব্যয় বইতে হয়। আদালত মাঝে মাঝে কিছু পদক্ষেপের সমালোচনা করেন, যাতে এ ধরনের বিশ্লেষণ অন্তর্ভুক্ত থাকে না। উদাহরণস্বরূপ, গুরুত্বপূর্ণ বীমা কোম্পানি মেটলাইফের পদবি চ্যালেঞ্জ করার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

পণ্যের ব্যবহার কমালে খরচ কমে যায়। পণ্য ও পরিষেবার মূল্যের পার্থক্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটি আমাদের মিথ্যা ধারণা দিতে পারে। যদিও আমরা এ বিষয়ে ভালো জানি। এটি আমাদের প্রকৃতি, স্বাস্থ্য, সুখ, জলবায়ু এবং জীবনের সঙ্গে কারখানা এবং পণ্যকে একত্র করার দিকে নিয়ে যায়। এটি আমাদের কেবল সেই বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করার জন্য চাপ দেয়, যেগুলোর মূল্য দেয়া যায় না। যেমন ন্যায়বিচারের বিষয়গুলো।

আমরা বিশ্বের এ হ্রাসমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘সমাধান’-এর জন্য ধন্যবাদ দিতে পারি। যেমন বাড়ির মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আর্থিক বাজার উন্নয়ন বা গভীর করার জন্য একটি ব্যক্তিগত-পেনশন ব্যবস্থা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সবুজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা।

প্রাইস ট্যাগসহ একটি পণ্য তৈরি করুন। বিনিয়োগকারীরা এটির দিকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। বিশেষ করে যদি ক্ষতির আশঙ্কা না থাকে, সবাই সরকারি নিশ্চয়তার ওপর আস্থা রাখে (যেমনটি প্রায়ই হয়)।

কিন্তু ফলাফলগুলো বিবেচনা করুন৷ আমরা একটি বন্ধকি বাজার পেয়েছি, যা নির্মাণসামগ্রী ও বাড়ির দামে উল্লম্ফন ঘটিয়েছে। আবাসন সংকট সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। পেনশন ব্যবস্থায় ভবিষ্যতের দায়বদ্ধতা পূরণের জন্য নিরাপদ সম্পদের প্রয়োজন। যদি তেল ও গ্যাসে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখা হয়, শক্তির উৎস, উৎপাদন ও বিতরণের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে কয়েক দশক দেরি হয়; কারণ সবুজ সম্পদ ওই পদ্ধতিতে কাজ করে না। ‘বাজারের জাদু’তে আমরা একটি স্ফীত, ভঙ্গুর আর্থিক ব্যবস্থা পেয়েছি। যেখানে ক্রমাগত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি প্রয়োজন। পাছে এটি বিস্ফোরিত হয়ে অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়।

এর কোনোটিই খুব বেশি আলোড়ন তৈরি করে না। সর্বোপরি, দাম ভবিষ্যতের জন্য দুর্বল পথপ্রদর্শক, যা সহজাতভাবে অজানা এবং অজ্ঞেয়। যখন শক্তিশালী প্রমাণ থাকে যে এটি অতীত থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বিচ্যুত হবে। ১৯৩০-এর দশকে জন মেনার্ড কেইনস বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে বিশ্বযুদ্ধ কবে হবে বা ১৯৬০-এর দশকে মুদ্রাস্ফীতির হার কী হবে তা জানা অসম্ভব।’ ২০২৩ সালে আমরা জানি না যে জলবায়ু পরিবর্তন কতটা দ্রুত হবে, পরবর্তী দাবানল কোথায় ছড়িয়ে পড়বে বা বিশ্বের কোন অংশ খরা, বন্যার মুখোমুখি হবে।

যেহেতু এ পরিস্থিতিগুলো অনিশ্চিত, তাই বাজার সঠিকভাবে মূল্য নির্ধারণ করতে পারে না। যদি না আমরা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ উপেক্ষা করি। আমরা নিশ্চিতভাবে একটি জিনিস জানি: আরো জলবায়ুজনিত ধ্বংসযজ্ঞ আসছে। এটি যে অতিরিক্ত সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব আনতে পারে তা আমরা ধারণা করতে পারি না।

পরিস্থিতি এতটা খারাপ যে অর্থ আজ চালকের আসনে বসে রয়েছে। আমরা স্বীকার করছি, সবচেয়ে সুস্পষ্ট সমাধান হচ্ছে অবিলম্বে কার্বন নির্গমন কমানো। এটা খুব ‘ব্যয়বহুল’ও। সেজন্য নির্গমন কমানোর প্রতিশ্রুতি থেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারগুলো সরে আসছে। আগে নির্ধারণ করা লক্ষ্য সংশোধন করছে। শর্ত বাস্তবায়নে বিলম্বিত নীতি অবলম্বন করছে।

অর্থ ব্যবস্থাপনা এতটা গভীরে গেঁথে গেছে, মনে হয় অবিদ্বানের রাজনীতি করতে হবে। প্রাইস ট্যাগের ওপর অন্ধভাবে নির্ভর করার মাধ্যমে আমরা ঐকমত্য গড়ে তোলা এবং কার্যকর কৌশল তৈরি করার দক্ষতা থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেছি। বিশাল খরচের দায় সেই সব মানুষের ওপর আরোপ করা উচিত নয়, যাদের জীবনটাই কম দামি। এ দুর্যোগ থেকে অর্থের চেয়ে বেশি কেউ লাভবান হয় না। কিন্তু সেই দায় চিরকাল চলতে পারে না।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]


ক্যাথরিনা পিস্তর: অধ্যাপক, তুলনামূলক আইন, কলম্বিয়া ল স্কুল, ‘দ্য কোড অব ক্যাপিটাল: হাউ দ্য ল ক্রিয়েটস ওয়েলথ অ্যান্ড ইনইকুয়ালিটি’র লেখক।

ভাষান্তর: হানযালা হান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন