আগামীর টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তায় গ্রিন ফুয়েল

আবু তাহের

মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর দেশের অর্থনৈতিক ভিত মজবুতকরণে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিল জ্বালানি নিরাপত্তা ও টেকসই জ্বালানির পথ তৈরি করা। সে লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে নেন। আর এগুলোয় মজুদ ছিল প্রায় সাড়ে ১২ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট (টিসিএফ) গ্যাস। তখনকার সময় এ জ্বালানির আর্থিক মূল্য ছিল ৪-৫ মিলিয়ন ডলার, যার বর্তমান বাজারমূল্য ৩ লাখ ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশের জ্বালানি প্রাপ্তির নিশ্চয়তায় বিপুল এ পরিমাণ অর্থ ব্যয় ছিল অবিস্মরণীয় ঘটনা। সেখান থেকেই মূলত দেশের অর্থনীতির মেরুকরণ। বঙ্গবন্ধুর কেনা ওই পাঁচটি ক্ষেত্র এখনো দেশের মোট গ্যাস উৎপাদনের ৮২ শতাংশ জোগান দিচ্ছে।

দিনটিকে স্মরণে রাখতে ২০১০ সাল থেকে সরকারিভাবে ৯ আগস্ট জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ‘স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয়, জ্বালানির সাশ্রয়’-এ প্রতিপাদ্যে যথাযোগ্য মর্যাদায় এবার দিবসটি পালন করা হবে। এ উপলক্ষে বাণী দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘গ্যাস সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার এবং গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক অবকাঠামো নির্মাণ স্মার্ট, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ও বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার এবং জ্বালানির অপচয় রোধ করে সাশ্রয়ী ব্যবহার টেকসই উন্নয়ন অর্জন গতিশীল করবে।’ সরকারপ্রধান বলেন, ‘জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাদের সরকার নতুন নতুন উৎস থেকে জ্বালানি আহরণ এবং জ্বালানিসমৃদ্ধ দেশসহ আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের মাধ্যমে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে এলএনজি আমদানি অব্যাহত রেখেছে। আমদানীকৃত এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে।’ 

দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম তিন দশকে খুব বেশি উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি। বিদ্যুৎ খাতের টেকসই ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ২০১০ সালে প্রথম পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে সরকার। গ্যাস খাতের উন্নয়ন ও লক্ষ্যমাত্রায় ২০১৭ সালে ‘গ্যাস সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান’ করা হয়। দুই খাতকে এগিয়ে নিতে দেশী-বিদেশী অর্থায়নে বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন সক্ষমতায় অভাবনীয় সাফল্য পেলেও প্রাইমারি এনার্জি খাতে নিশ্চিত করা যায়নি টেকসই নিরাপত্তা। স্থানীয় গ্যাস-তেল অনুসন্ধানে বিভিন্ন সময় সরকারের অবহেলাকেই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন এ খাতসংশ্লিষ্টরা। প্রকারান্তরে বেড়েছে আমদানিনির্ভরতা। উচ্চমূল্যের জাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে ধুঁকতে হচ্ছে সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

দেশের জ্বালানি খাতের মহাপরিকল্পনায় স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে মিক্সড জ্বালানির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। জ্বালানি তেল, গ্যাস, কয়লা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও পরমাণু শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এককভাবে গ্যাস ও জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানিয়ে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়তে হয় সরকারকে। 

জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জলবায়ুকে ধ্বংস করছে, যার অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাণ-প্রকৃতি। তাই আজ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানির বাইরে গিয়ে নবায়নযোগ্য বা গ্রিন ফুয়েলের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আগামীতে পরিবেশ দূষণমুক্ত ও খরচসাশ্রয়ী প্রযুক্তির বাজার তৈরি করা হচ্ছে। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও নিজস্ব সম্পদের ব্যবহারে অবহেলা ও আমদানিনির্ভর বাজারে প্রবেশ করে আর্থিক চাপে পড়েছে। ফলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি হতে পারে বাংলাদেশের জন্য বিকল্প বিদ্যুতের উৎস্য।

বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায়ও বলা হয়েছিল, ২০২১ সালে দেশে মোট উৎপাদন সক্ষমতার ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের পর্যাপ্ত সক্ষমতা তৈরি হলেও করা যায়নি নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা। এখনো বাংলাদেশ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বর্তমান সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুতের সক্ষমতা ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা নির্ধারণ করেছে। যেখানে ২০৪১ সালের মধ্যে মোট সক্ষমতার ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য খাত থেকে উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন সক্ষমতা এখন ২৭ হাজার মেগাওয়াটের ওপর। প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস উত্তোলনে উৎপাদনে রয়েছে ১৯টি গ্যাসক্ষেত্র। বিপুল পরিমাণ কয়লার মজুদ থাকলেও যৎসামান্য উৎপাদন করা হচ্ছে। এছাড়া আরো ১৮-২০ ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেও রয়েছে অনাবিষ্কৃত। 

জ্বালানি নিরাপত্তায় দেশে সবচেয়ে বড় বিষয়টি এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন, সবার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। দেশে গত দেড় দশকে শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে। তবে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্নতায় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ১০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার কথা থাকলেও সেটি করা যায়নি।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ১৩৪ মেগাওয়াট। এ সক্ষমতা শিল্প খাতের ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ধরে। মোট বিদ্যুৎ সক্ষমতার ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে  আসার কথা থাকলে এ খাত থেকে ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত নিয়ে কাজ করা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) তথ্য অনুযায়ী, দেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াটের কিছু বেশি, যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪ শতাংশের কিছু বেশি। তবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) সঙ্গে কানেকটেড এমন গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা মাত্র ৭০০ মেগাওয়াটের মতো।

দেশে নবায়নযোগ্য খাতের মধ্যে এখনো সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল সৌরবিদ্যুৎ। বাকি উৎস্যগুলোর সম্ভাবনা থাকলেও সেগুলো এখনো গবেষণা পর্যায়ে। যে কারণে দেশে নবায়নযোগ্য খাতের মধ্যে যতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে তার সিংহভাগই সৌরকেন্দ্রিক।

স্রেডার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত দেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সৌরবিদ্যুতের সক্ষমতা ৯৬০ দশমিক ৮ মেগাওয়াট, হাইড্রো ২৩০, বায়ু ২ দশমিক ৯, বায়োগ্যাস শূন্য দশমিক ৬৯ এবং বায়োমাস শূন্য দশমিক ৪ মেগাওয়াট।

দেশে গত দুই দশকে নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগ খুব বেশি বাড়ানো যায়নি। এর প্রধানত কারণ নীতিমালা, প্রণোদনা এবং এ খাতের যথাযথ প্রচার না থাকা। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সময়ের ব্যবধানে সৌরবিদ্যুতের প্রযুক্তি, বিশ্বব্যাপী ক্লিন এনার্জির প্রসার এবং এ খাতে নেট মিটারিং সিস্টেম চালু হওয়ায় এখন সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসছেন।

জ্বালানিবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের বড় সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এই উৎস্য থেকে অন্তত তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে। জ্বালানি তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যু কেন্দ্রগুলোর ওপর চাপ কমাতে দিনের বেলায় সৌরবিদ্যুৎ গ্রিডে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এতে যেমন জ্বালানির ব্যয় সাশ্রয় সম্ভব, তেমনি গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কম হবে। আগামীতে ক্লিন এনার্জির কথা চিন্তা করলে সৌরবিদ্যুৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন