আলোকপাত

মুদ্রানীতি কি বাজেটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ

ড. আর এম দেবনাথ

ভুল, সবই ভুল, যা জেনেছি এতদিন তার সবটাই ভুল। কেন এ কথা বলছি? এতদিন জানতাম ব্যাংকের সুদনীতি, মুদ্রা সরবরাহ, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংক মানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিষয়। এমনকি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণও। কিন্তু এখন জানতে পারছি—না, সুদনীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিষয় নয়। বিষয়টি তাহলে কী? বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বলেছেন এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ২০২০ সালের এপ্রিলের দিকে যখন সুদের হার একটি অভিজাত হোটেলে বসে স্থির করা হয় তখন আমরা বলেছিলাম—এটা কী? তখনকার গভর্নর ওই ‘‌নয়-ছয় সুদনীতি’কে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলেননি। কিন্তু এবার নতুন গভর্নর অকপটে স্বীকার করলেন গত কিস্তির সিদ্ধান্তটি যেমন ছিল রাজনৈতিক, তেমনি এবারের সুদের হারের সিদ্ধান্তটিও রাজনৈতিক। হতে পারে! কিন্তু তাহলে তো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এতে জড়িত হওয়ার কথা নয়। অর্থমন্ত্রী তার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে যেমন রাজস্ব নীতির ঘোষণা করেছেন, তেমনই তিনি মুদ্রানীতিও (মনিটারি পলিসি) ঘোষণা করতে পারতেন। না, তিনি করেননি। এর যুক্তি কী? সাধারণত আমরা দেখেছি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজেট ঘোষণার পর তার মুদ্রানীতি রাজস্ব নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঘোষণা করে। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে সুদের হার নির্ধারণও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তবে কি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হরেদরে সরকারের ঋণ নেয়ার ঘটনাটিও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত? বিষয়টি বুঝতে পারছি না। তবে কি কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার আইনি ক্ষমতা ও অধিকার স্বেচ্ছায় সারেন্ডার করেছে সরকারের কাছে? যদি তাই হয় তাহলে তো আর কথা বলা যায় না। যদি ব্যবসা-অর্থনীতি-রাজনীতি-ব্যাংকিং সব একাকার হয়ে যায় তাহলে জনগণের বাঁচার পথ কী? অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় কবে ফিরবে? এসব প্রশ্ন এখন অনেকের মনে। যাক এসব প্রশ্ন, দেখা যাক মুদ্রানীতিতে কী আছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর এই ছয় মাসের জন্য তার মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। এর থেকে মানুষের প্রত্যাশা ছিল নতুন মুদ্রানীতিতে ‘লেন্ডিং রেটের’ ওপর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ক্যাপ তুলে নেবে। অর্থাৎ তুলে নেবে ঋণের ওপর সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা। এত‌ে আমানতকারীরা লাভবান হবেন। মূল্যস্ফীতি থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি তারা পেতে পারে। কিন্তু ‘হা হতোস্মি’। দেখা গেল কেন্দ্রীয় ব্যাংক লুকোচুরি খেলা খেলল। তারা আগে ঋণের ওপর সুদের হারে ঊর্ধ্বসীমা করে দিয়েছিল ৯ শতাংশ। এখন কার্যত ঊর্ধ্বসীমা আবার নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। বাজারের হাতে পুরোপুরি ছেড়ে দেয়া হয়নি। মুদ্রানীতির পরবর্তী সার্কুলারে দেখা যাচ্ছে অন্যান্য ঋণের সুদের হার হবে ৯ শতাংশের স্থলে ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। অন্যান্য ঋণের ক্ষেত্রেও সুদের হার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এখানে ব্যাংকগুলোর নড়াচড়ার কোনো অবকাশ নেই। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করে করল? আবার কীভাবে বলল, ‘এই হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে?’ বস্তুত কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হারকে ‘ট্রেজারি বিলের’ সুদের সঙ্গে ‘ট্যাগ’ করে দিয়েছে। ট্রেজারি বিলের সুদের হার কি বাজারে নির্ধারিত হয়? নিশ্চয়ই নয়। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত—এটাই বাস্তবতা। ওই রেটের সঙ্গে ১ শতাংশ যোগ করে ঠিক করা হয়েছে ‘অন্যান্য’ বা সাধারণ ঋণের ওপর সুদের হার। যদি তাই হয় তাহলে এটা বাজারভিত্তিক হলো কীভাবে? বাজার মানে চাহিদা-সরবরাহের ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারিত হবে এবং তা হবে আমানত ও ঋণের উভয় ক্ষেত্রেই। আগে তা-ই ছিল। ব্যাংকের বোর্ড যখন-তখন সুদের হার নির্ধারণ করে বিজ্ঞাপিত করতে পারত। এখন বলা হচ্ছে একবার ঋণের ওপর সুদের হার ঠিক করা হলে ছয় মাসের মধ্যে তা আর পরিবর্তন করা যাবে না। যদি তা হয় তাহলে সুদ নির্ধারণে ব্যাংকের ক্ষমতা বা অধিকার রইল কই? বলা হচ্ছে অর্থনৈতিক গতিধারা অব্যাহত রাখা এবং দক্ষ ঋণ ব্যবস্থাপনার জন্য এসব করা হচ্ছে? এটা কীভাবে তা বোধগম্য নয়।

বলা হচ্ছে এবারের মুদ্রানীতিটি ‘সংকোচনমূলক’। টাকার সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এর উদ্দেশ্য। গভর্নর বলছেন সরবরাহের দিকটা ঠিক রেখে তিনি নীতি সুদ বাড়িয়েছেন। এখানেও তো দেখা যাচ্ছে সাংঘর্ষিক অবস্থা। বাজেট তো সম্প্রসারণমূলক। খরচ অনেক বাড়ানো হয়েছে। এখন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট হবে সম্প্রসারণমূলক, যার মুদ্রানীতি হচ্ছে সংকোচনমূলক। তাই যদি হয় দুইয়ের মিলনস্থল কোথায়? এর উত্তর বাংলাদেশ ব্যাংকই দিতে পারবে। আবার কথা আছে। দেখা যাচ্ছে নতুন মুদ্রানীতিতে ভোক্তা ঋণের ওপর সুদের হার কমানো হয়েছে ১ শতাংশ। এসব ঋণের ওপর সুদের হার ছিল ১২ শতাংশ। এখন তা হবে ১১ শতাংশের মতো। অথচ এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ। এখন সুদের হার কম বলে ভোক্তা ঋণের পরিমাণ বাড়বে না তো? ভোক্তা ঋণ এই টান টান বাজারে বৃদ্ধি পাওয়াটা কি ঠিক হবে? এছাড়া সাধারণ ঋণের ওপর সুদের হার অল্প স্বল্প বাড়ানোর যুক্তি দেয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ব্যয়। কথাবার্তায় মনে হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যবসায়ীদের কথাবার্তায় একটা ধারণা দেয়া হচ্ছে যে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাবে। এতে তারা প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হারাবেন। এখানে একটা প্রশ্ন সবিনয়ে করা যায় কি? মোট উৎপাদন ব্যয় বা ব্যবসায়িক ব্যয়ের মধ্যে উৎপাদক বা ব্যবসায়ীর সুদ ব্যয় কত? মোট খরচের সুদ খরচ কত শতাংশ? এ প্রশ্নের জবাব কেউ দিচ্ছেন না।

আবার অন্য একটা দিকও আছে। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ঋণের ওপর সুদের হার বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ। প্রশ্ন বড় বড় ব্যবসায়ীর কি ঋণ করার আরো প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? তারা অনেক ঋণ নিয়েছেন। বহু ক্ষেত্রে ওভার ক্যাপাসিটি তারা সৃষ্টি করেছেন। অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা টাকা পাচারও করছেন। এ কথা বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন বলেছে, তেমনি বলেছে ব্যাংকারদের শীর্ষ সংস্থা ‘‌এবিবি’। এমতাবস্থায় তাদের আরো সস্তায় ঋণ দেয়ার যুক্তি কতটুকু? বিশেষ করে যখন দেখা যাবে সস্তা ঋণ এরই মধ্যে আমাদের বহু ক্ষতি করেছে। সস্তায় ঋণ দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এলান স্পিন সে দেশের বহু ক্ষতি করে গেছেন। ‘‌ক্রেডিট ইজ আ স্ক্যার্স কমোডিটি’—এ কথা কি এমনিতেই বলা হয়? অবশ্য কথা আরো আছে। বর্তমানে যে সুদের হার করা হয়েছে তা বড়দের জন্য কিছুই না। কিন্তু ছোট ছোট ঋণের ক্ষেত্রে এটা অসহনীয় হতে পারে। অথচ সুদের হার হরেদরে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটা কি কেস টু কেস হওয়া উচিত ছিল না?

বলা হয়েছে সরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি হবে ৪৩ শতাংশ, যা চলতি বছরে মাত্র ৩৭ শতাংশ। আবার বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার কমানো হয়েছে। চলতি বছরে এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশের মতো। এ নিরিখেই বোধ হয় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। গড়ে গিয়ে হবে ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। এখানে প্রশ্ন সরকার এত ঋণ কেন নিচ্ছে? বিশেষ করে কেন সরকার নিজে মালিক বলে নিজের ব্যাংক থেকে সমানে ঋণ নিয়ে যাচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরো বেশি নেবে। মুশকিল হচ্ছে এ টাকা বেসরকারি ব্যাংকের হাতে, এমনকি সরকারি ব্যাংকের হাতেও নেই। তাহলে ভরসা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো এখন পর্যন্ত ডলার কিনতে কিনতে ফতুর হয়েছে। এটা ঘটেছে ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে চলতি অর্থবছরে নাকি ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা তারা ডলার বিক্রি করে ব্যাংকগুলো থেকে তুলে নিয়েছে। এখন কী করা? ব্যাংকগুলো বাঁচবে কী করে? সরকার টাকা পাবে কোত্থেকে? কোত্থেকে নেবে ঋণ? ব্যাংকে তো মুদ্রা (ডিপোজিট) নেই। অতএব করণীয় কী? করণীয় হচ্ছে নোট ছাপিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দেদারসে সরকারকে ঋণ দিয়ে যাবে। যুক্তি হিসেবে গভর্নর বলেছেন, এ টাকা সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা হিসেবে খরচ করা হছে না। খরচ করা হচ্ছে উন্নয়নের কাজে। উন্নয়নের জন্য টাকা না দিলে বড় বড় প্রকল্পের কাজ সব বন্ধ হয়ে যাবে। এ যুক্তি কী করে তিনি দিলেন তা বুঝতে পারছি না। উন্নয়নের টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোট ছাপিয়ে সরকারকে দেবে। যদি তাই হয় তাহলে আর্থিক শৃঙ্খলা থাকে কোথায়? এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় স্মরণীয়। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ যখন আমাদের তুঙ্গে, তরতর করে বাড়ছে, তখন যুক্তি দেয়া হলো এত টাকা জমিয়ে লাভ নেই। ব্যবসায়ীদের দেয়া হোক। তারা ব্যবসা, শিল্পে লাগাক। দেশের উন্নতি হোক। এসব বলে ৭-৮ বিলিয়ন ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসায়ীদের ঋণ হিসেবে দেয়। এসব এখন ‘‌গলার কাঁটা’। আইএমএফ বলেছে, তোমরা করেছ কী? রিজার্ভ এসব ডলার নিচ্ছে। রিজার্ভ হিসাবায়নে তা বাদ দিতে হবে। অতএব তাই হলো। ফলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ এখন তলানিতে। এ ধরনের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত দেশের কল্যাণে আসে না।

মুদ্রানীতিতে যা নেই তা হচ্ছে খেলাপি ঋণের টাকার কথা। এসব উদ্ধারের ব্যবস্থা কী? ঋণ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা কী? বড় বড় ঋণ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা কী? খেলাপিরা আবার ঋণ পাবে কিনা, না তারা শাস্তি পাবে—এসব ব্যাপারে কোনো পরিষ্কার দিকনির্দেশনা নেই। খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারলে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট কিছুটা হলেও কমত। এছাড়া পথ হচ্ছে মুদ্রা (ডিপোজিট) বাড়ানো। মুদ্রা মানে ‘মানি’। ‘‌মানির’ সংজ্ঞায় আমানত আছে। দেখা যাচ্ছে মুদ্রানীতি হয়েছে কিন্তু ব্যাংকে কোনো ‘মুদ্রা’ নেই, আমানত নেই। এর ব্যবস্থা কী? বলা হচ্ছে সুদনীতির মাধ্যমে এসব করা হবে। দেখা যাচ্ছে, ঋণের ওপর গড়ে ১ শতাংশ সুদ বাড়ানো হয়েছে। যদি ধরে নিই এই ১ শতাংশ ব্যাংকগুলো তাদের আমানতকারীদের এখন দিতে পারবে এটা একটা স্বস্তির দিক। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে বহু ব্যাংক ‘নয়-ছয়’ সুদনীতি লঙ্ঘন করে আমানতের ওপর ৬ শতাংশের ওপরে সুদ দিচ্ছে। তার পরও তারা কোনো আমানত পাচ্ছে না। কারণ দৃশ্যতই এ সুদের হার অপ্রতুল। সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশ। এতে আমানতের ওপর সুদের হার ৭ শতাংশ—এটা কিছুই নয়। পরিশেষে বলা যায়, যে মূল্যস্ফীতি ঠেকানোর জন্য মুদ্রানীতি, শুধু তা দিয়ে মূল্যস্ফীতি ঠেকানো যাবে না। রাজস্ব নীতি, বাণিজ্য নীতি, মুদ্রানীতির সামঞ্জস্য বিধান না করে মূল্যস্ফীতি ঠেকানো যাবে না। পণ্যের সিন্ডিকেট নির্মূল করতে না পারলে যে মূল্যস্ফীতি বাড়বে ছাড়া কমবে না।

ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন