জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের এক মহারথী

কোইচি হামাদা

ব্যাংক অব জাপানের প্রধান হিসেবে হারুহিকো কুরোদার ১০ বছরের মেয়াদ ছিল জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ সময়। গত মাসে প্রস্থানের পর এখন তার রেখে যাওয়া কর্মফল নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে।

হারুহিকো কুরোদা মূলত একজন জাপানি ব্যাংকার ও জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। যিনি ২০১৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৩-এর এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংক অব জাপানের ৩১তম গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ছিলেন। জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান হিসেবে পরপর দুই মেয়াদে ১০ বছর দায়িত্বে থাকাকালীন কুরোদা প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির মুদ্রানীতি পরিচালনা করেছেন, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে (যিনি গত বছর আততায়ীর হাতে নিহত হন) ২০১৩ সালে যখন কুরোদাকে ব্যাংক অব জাপানের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য নিযুক্ত করেন, তখন জাপান দুই দশক ধরে মূল্যপতন এবং মন্দায় নিমজ্জিত ছিল। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের উত্তরাধিকার যা কিনা উন্নত অর্থনীতিগুলোয় ব্যাপক আর্থিক সম্প্রসারণ উৎসাহিত করেছিল সেটিও এসব বিষয়কে খুব একটা সহযোগীতা করছিল না।

এর কারণ দুটি মুদ্রার মধ্যে বিনিময় হার তাদের অর্থ সরবরাহের আপেক্ষিক আকারের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে থাকে। মার্কিন ডলার ভিত্তির একটি উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ সহজেই জাপানি ইয়েনের মূল্য বাড়িয়ে তুলতে পারে, যে কারণে জাপানি সংস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটি রোধে ব্যাংক অব জাপানকে নিজস্ব সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি চালু করতে হয়েছিল। 

কুরোদার পূর্বসূরি মাসাকি শিরাকাওয়া এটি খুব কমই বুঝতে পেরেছিলেন এবং এজন্য তার নীতিগুলো বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। ফলে ইয়েনের মূল্য বেড়েছে এবং সেটি জাপানি ব্যবসাগুলোকে ক্ষতির সম্মুখীন করেছে। তাছাড়া উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি স্থবিরতা ও কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অধরা ছিল। উপরন্তু তার পূর্বসূরিদের মতো শুধু তোশিহিকো ফুকুই শিরাকাওয়া বেকারত্বের বৃদ্ধি রোধ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন। সে সময়ে প্রধান শহরগুলোর কাছে গৃহহীনদের থাকার তাঁবুর সংখ্যা বেড়ে যায়। 

তবে শিনজো আবে জাপানের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। তথাকথিত আবেনোমিকসের মধ্যে (শিনজো আবের অর্থনীতি) তিনটি ‘‌তীর’ অন্তর্ভুক্ত ছিল: আর্থিক উদ্দীপনা, সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি এবং প্রবৃদ্ধিবর্ধক অর্থনৈতিক ও নিয়ন্ত্রক সংস্কার। শিনজো আবে বিশ্বাস করতেন, হারুহিকো কুরোদা প্রথম উপাদানটি তদারকির জন্য সেরা প্রার্থী যা সত্যিকার অর্থে একটি বুদ্ধিমান সিদ্ধান্ত হিসেবে প্রমাণ হয়েছিল।

তার নিয়োগ নিশ্চিত হওয়ার পর হারুহিকো কুরোদা দ্রুততার সঙ্গে ‘বাজুকা’ প্রোগ্রাম চালু করেন, সেখানে বিপুল পরিমাণে সরকারি ঋণ কেনার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা বাড়ানোর এক অসাধারণ প্রচেষ্টা চালান তিনি। বন্ডের বাইরেও প্রচলিত পদ্ধতির পরিমাণগত সহজীকরণের জন্য কুরোদার ব্যাংক অব জাপান ইকুইটিও কিনেছিল। তিনি ২-২-২ ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করে তার লক্ষ্যগুলো প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে তিনি ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি অর্জনের জন্য দুই বছরের মধ্যে মুদ্রানীতির ভিত্তিকে দ্বিগুণ করার উদ্যোগ নেন।

তার করা উদ্দীপকের প্রভাব শ্রমবাজারেও প্রতিফলিত হয়। ২০১৮ সালের মার্চের শেষে শ্রমবাজারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং চাকরির সুযোগসহ আবেদনকারীদের সংখ্যার অনুপাত ১ দশমিক ৬২ হারে পৌঁছায়, যা কিনা ২০১৩ সালের মার্চের শেষে শূন্য দশমিক ৯৭ অনুপাত হারে ছিল (যখন শিরাকাওয়ার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালিত হচ্ছিল)। মহামারীর বিরূপ প্রভাব থাকা সত্ত্বেও জাপান ২০২২ সালে এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে এবং চাকরির সুযোগের তুলনায় আবেদনকারীদের অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ২৮ এ।

নিশ্চিত করে বললে, কুরোদার নেতৃত্বাধীন দশকে জাপানে চার মিলিয়নেরও বেশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল। তার সময়ে তাঁবুর গ্রামগুলো হারিয়ে যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাস ফিরে পান যে তারা স্নাতক ডিগ্রি পাওয়ার পর কোনো লাভজনক কর্মসংস্থান পাবেন। প্রকৃতপক্ষে এর প্রধান সুবিধাভোগী ছিলেন অল্প বয়স্ক তরুণরা, যাদের মধ্যে অনেকে অনিয়মিত কর্মচারী হিসেবে চাকরি পেয়েছিলেন। (এদিকে বয়স্ক প্রজন্ম জাপানের ঐতিহ্যবাহী জীবন-সময়-কর্মসংস্থান ব্যবস্থার সুরক্ষার ওপর নির্ভর করতে থাকে, যা আসলে সে দেশের অদক্ষ দ্বৈত শ্রমবাজারের একটি বৈশিষ্ট্য।)

যদিও শিনজো আবে সে সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন উপভোগ করেছিলেন, আবেনোমিকসের অনেক সমালোচক বলেছেন যে জাপান কখনই তার ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। উপরন্তু তারা ঘোষণা করে, অ্যাবেনোমিকসের কেন্দ্রে সম্প্রসারণমূলক নীতিগুলো জাপানকে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিতে ফেলেছে। এমনকি শিরাকাওয়াও সম্প্রতি তেমনই মতামত দিয়েছেন। তবে কুরোদা দুঃখ প্রকাশ করেন যে ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য এখনো অর্জন করা যায়নি, কিন্তু তিনি আশাবাদী স্থিতিশীল ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময় এখন অনেকটাই ঘনিয়ে এসেছে।

কিন্তু জাপানের মূল্যস্ফীতি দূর হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রাপ্ত তথ্য থেকে যা দেখা যায় তা হলো আবেনোমিকস যা কিনা কুরোদার মাধ্যমে আংশিকভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে, তা শ্রমবাজারকে নাটকীয়ভাবে শক্তিশালী করেছে এবং কর্মসংস্থান বাড়িয়েছে, যা মানুষের বিলম্ববিহীন দ্রুত অর্থনৈতিক কল্যাণ এবং দীর্ঘমেয়াদি আত্মবিশ্বাসের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। আর প্রকৃতপক্ষে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যগুলো অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো জনগণের সম্পূর্ণ কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া।

চীনা নেতা দেং জিয়াওপিং একবার বলেছিলেন, ‘কালো বিড়াল বা সাদা বিড়াল যেটাই হোক না কেন, যদি তা ইঁদুর ধরতে পারে তবে সেটাই ভালো বিড়াল’। শিরাকাওয়া নিশ্চয় একজন দক্ষ এবং নিবেদিতপ্রাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের গভর্নর হতে পারেন, তবে যদি আমরা ‘ইঁদুর ধরার’ উদ্ধৃতির মতো রেকর্ড অর্থাৎ নীতির ফলাফল বিচার করি তাহলে দেখব যে কিরোদার অর্জনের তুলনায় শিরাকাওয়ার রেকর্ড তুলনামূলকভাবে কম। (পাঠক হয়তো জেনে অবাক হবেন যে জাপানি ভাষায়, শিরাকাওয়া উপাধিটির অর্থ ‘একটি সাদা নদী’ এবং অন্যদিকে কুরোদার অর্থ হলো"‘একটি কালো ময়দান’)।

কুরোদা তার ব্যাংক অব জাপানের দায়িত্ব পরবর্তী সময়টা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে রাজস্ব ও মুদ্রানীতির ওপর বক্তৃতা দেয়া এবং দর্শনশাস্ত্রে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। এটা তার ব্যক্তিগত পাণ্ডিত্যসুলভ আগ্রহ থেকেই করেন। এছাড়া ব্যাংক অব জাপানের সাবেক গভর্নর টোকিওর একটি মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিলেন। আর তিনি এ সুযোগ কর্ম দিয়ে অর্জন করেন।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২০২৩]

কোইচি হামাদা: ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের বিশেষ উপদেষ্টা ছিলেন

ভাষান্তর: মো. আবিদ মঈন খান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন