বিদ্যুতের দাম সমন্বয় নিয়ে বিইআরসির দ্বিধা

প্রতিমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গণশুনানির মাধ্যমেই নির্ধারণ হোক

২০০৮ সাল থেকেই গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করে আসছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), কিন্তু সম্প্রতি সরকার আইন সংশোধন করে বিশেষ সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুবিধা নিজেদের হাতে নিয়েছে। এতে তৈরি হয়েছে জটিলতা। বিইআরসি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর দেয়া প্রস্তাবের বিষয়ে শুনানি করবে না মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে নিয়ে তৈরি হয়েছে দ্বিধা। বিষয়টি স্পষ্ট করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে, কিন্তু উত্তর মেলেনি। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি আটকে রয়েছে। এর আগে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব জমা হলে যাচাই-বাছাই শুনানি শেষে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গ্রাহক পর্যায়ে ১৮-২০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বিইআরসিতে জমা দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। কিন্তু আইন সংশোধনের ফলে বিইআরসি করণীয় নির্ধারণ করতে পারছে না। এমন অবস্থায় প্রক্রিয়াগুলো স্থবির হয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা সরবরাহকারী, গ্রাহক কারো জন্য সুখকর নয়। এর আগে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, আইন সংশোধন হলেও বিদ্যুতের দাম আগের মতোই বিইআরসি নির্ধারণ করবে। জনগণের প্রত্যাশাও তাই।  এমন প্রেক্ষাপটে আইন সংশোধনের মাধ্যমে বিইআরসির কার্যক্রমে যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে দ্রুতই তা কাটিয়ে উঠতে মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেবে বলে প্রত্যাশা।

গ্যাস বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি আনতে গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় সরকার বিইআরসি গঠন করেছিল, সেটিকে এত দিন ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখেছিল। এখন সেটি পুরোপুরি অকার্যকর করে ফেলা হলো আইন সংশোধনের মাধ্যমে। সরকারের কাজে স্বচ্ছতা জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য বিইআরসি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তারা গণশুনানির মাধ্যমে গ্যাস বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করে আসছে। এক্ষেত্রে বিক্রেতা, ভোক্তাসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত প্রদানের সুযোগ তৈরি হয়। দাম বাড়ানো ঠেকাতে না পারলেও গণশুনানির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি আদায় করা যেত। কার্যত এখন আর সেটি থাকবে না।

বিইআরসি খুবই শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। তারা চাইলে আইনবলে সরকারকে নির্দেশনাও দিতে পারে। কিন্তু তারা সে ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি। বিশ্বের অনেক দেশেই দেখা গিয়েছে ধরনের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন করে। অনেক সময় সরকারের সিদ্ধান্ত বাতিল করার অধিকারও রাখে। অধিকাংশ উন্নত দেশে এবং অনেক অনুন্নত দেশেও জ্বালানি পণ্যের দাম নির্ধারণ থেকে শুরু করে তাদের হিসাব-নিকাশ দেখভাল করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সরকারসহ বাজারে যেসব কোম্পানি ভোক্তাদের সেবা প্রদান করে তারা আইনের ব্যত্যয় ঘটালে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সেটা শোধরানোর ব্যবস্থা নেয়। এতে করে একটি শক্তিশালী দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়া গড়ে ওঠে, যা বাংলাদেশেও গড়ে ওঠে। বিইআরসি সে পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিল। যদিও বিইআরসি সরকারের মতের বাইরে দাম নির্ধারণ করেছে বলে খবর মেলে না। অর্থাৎ বিইআরসির আরো ক্ষমতায়ন দরকার।

আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে ৯০ দিন সময় লেগে যাওয়া সরকারের ভর্তুকির বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। দুটি কাজই বিইআরসির মাধ্যমে করা সম্ভব। ৯০ দিনের বিষয়টি আইনে বলা নেই। এটা বিইআরসির প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে। চাইলেই এটা সংশোধন করে সময় কমিয়ে আনা যায়। এরই মধ্যে সরকার সময়সীমা কমিয়ে ৬০ দিন করেছে। এটি সর্বোচ্চ সময়, বিইআরসি সরকার চাইলে এক মাসেই দাম সমন্বয় করা সম্ভব। এখানে আইনের কোনো জটিলতা নেই। দরকার সরকারের সদিচ্ছা। মূল্য সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বিইআরসির প্রক্রিয়া এক মাসের মধ্যেও শেষ করা যায়। এমনকি স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয়ও করা সম্ভব। তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) মূল্য প্রতি মাসেই সমন্বয় করছে বিইআরসি। বিদ্যুৎ গ্যাসের ক্ষেত্রেও সেটি সম্ভব। আর ভর্তুকির সঙ্গে দাম নির্ধারণের কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে সরকারের আইন সংশোধনের পক্ষের যুক্তিগুলো মোটেই জোরালো নয়। আগে বছরে একবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা দেয়া যেত, এখন একাধিক দফায় বাড়ানো যাচ্ছে, বিধিমালা সংশোধন করা হয়েছে। ঠিক একইভাবে বিইআরসির মাধ্যমে দাম নির্ধারণে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

স্বীকার করতে হবে বিদ্যমান আইন অনুসারেও সব ধরনের জ্বালানি তেলের মূল্যনির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির হাতে থাকার কথা, কিন্তু সরকারের জ্বালানি বিভাগ কতিপয় খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে বরাবরই সেটি নিজেরাই নির্ধারণ করেছে। ওই ক্ষমতাবলে তারা ন্যূনতম স্বচ্ছতা জবাবদিহির ধার না ধেরে জনগণের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। তবে সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে জনমত তৈরি হচ্ছিল। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বিদ্যুৎ-গ্যাসের মতো জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতাও বিইআরসিকে দেয়ার দাবি করছিলেন। কিন্তু হতাশাজনকভাবে সরকার সে দাবি পূরণের পরিবর্তে বিইআরসির অবশিষ্ট ক্ষমতাটুকুও কেড়ে নিয়েছে। আইন সংশোধনেও সরকার জবাবদিহি এড়ানোর চেষ্টা করেছে। বিইআরসি আইনে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একটা ন্যূনতম ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আলোচ্য সংশোধনীর ফলে বিদ্যুৎ জ্বালানি পরিষেবা বিক্রেতা সরকার নিজেই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে; ভোক্তা হিসেবে জনগণের কিছু বলার সুযোগ আর থাকবে না। এর মাধ্যমে সরকার এক যুগের অধিক সময়ের চেষ্টায় গড়ে ওঠা একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে, যা কাম্য নয়।

মূল্যবৃদ্ধির আবেদনে বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে চায় না। হিসেবে গরমিল করে। বহু অনিয়ম থাকে, যা গণশুনানিতে যুক্ত বিভিন্ন পক্ষের আলোচনায় উঠে আসে। এতে কোম্পানিগুলো তাদের আয়-ব্যয় হিসেবে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে বাধ্য হয়। কিন্তু সংশোধনীর পর সেই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিও কমে আসবে। বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের স্বচ্ছতা নিশ্চিত ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় ২০০৩ সালে আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বিইআরসি গঠন করা হয়েছিল। এত বছর পর এসে ওই সংস্থাগুলোর পরামর্শেই বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। প্রত্যাশা থাকবে, আইনে যা- থাকুক না কেন, বিদ্যুৎ জ্বালানি পণ্যের দাম বিইআরসির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। এতে সংশ্লিষ্ট খাতে স্বচ্ছতা জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হবে, জনগণের অর্থের সদ্ব্যবহারের জন্য যা জরুরি।

বিদ্যমান আইনে জ্বালানিমূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে কমিশনকে একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হতো। পরিষেবা সংস্থা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথমেই একটা খসড়া প্রস্তাব বিইআরসির কাছে জমা দিত। প্রস্তাবটা যাচাই-বাছাইপূর্বক বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি গণশুনানির জন্য আরেকটা প্রস্তাব প্রস্তুত করত। এর ওপর ভোক্তাদের প্রতিনিধিসহ সব অংশীজন প্রকাশ্য সভায় মতামত প্রকাশ করে থাকে। ওই গণশুনানির ভিত্তিতে কমিশন একটা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। অধিকাংশ সময় সে সিদ্ধান্ত পরিষেবা সংস্থার পক্ষে গেলেও কখনই মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ওই সংস্থার প্রত্যাশামাফিক হয়নি। আবার কমিশন মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নাকচও করে দিয়েছে। ওই অধ্যাদেশ কার্যকর হলে জরুরি জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জবাবদিহি স্বচ্ছতা থাকবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন