২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে শুরু হয়ে করোনা মহামারী প্রায় দুই বছর স্থায়ী হলে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক স্থবিরতা তথা উৎপাদন হ্রাস, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা, সরবরাহ চেইনে বিপর্যয়, সার্ভিস সেক্টর ও পর্যটন শিল্পে অচলাবস্থা বিরাজ করতে থাকে। বেকারত্ব বৃদ্ধির ফলে মানুষের আয়-রোজগার কমে যায়। করোনা-উত্তর বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হতে না হতেই ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে উদ্ভূত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অবরোধ-পাল্টা অবরোধে বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে ধাবিত হয়। মূল্যস্ফীতি, খাদ্য সরবরাহ হ্রাস, জ্বালানি ও গ্যাস সরবরাহ হ্রাস এবং মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি রফতানি মন্দা, বৈদেশিক মুদ্রা সংকট প্রভৃতি মোকাবেলা করার জন্য দেশে দেশে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বনসহ ব্যাংক ও মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন আনতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। গ্রেট ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর গড় মূল্যস্ফীতি ৯-১০ শতাংশে পৌঁছে। এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ৯ শতাংশ থেকে শুরু করে কোনো কোনো দেশে মূল্যস্ফীতি ৫০ শতাংশ অতিক্রম করে। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট ইত্যাদির ফলে বাংলাদেশেও বিগত আট-নয় মাস যাবৎ মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এ মূল্যস্ফীতি বিবিএসের তথ্যানুযায়ী আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সাড়ে ৯ শতাংশ অতিক্রম করে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ও থিংকট্যাংকগুলোর জরিপে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশেরও বেশি। দিন দিনই চাল-ডাল, গম, ভোজ্যতেল, চিনি, তরিতরকারিসহ যাবতীয় খাদ্যসামগ্রীর দাম বাড়তে থাকে। মজুদদারি ও অতিমুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্যে অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্রমহ্রাস ও জ্বালানি তেল এবং তরল গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও তেল ও গ্যাস আমদানি সংকুচিত হয়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পায় এবং কৃষি ও শিল্পোৎপাদনে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গিয়ে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সুদের হার বৃদ্ধি করা হয়। এর ফলে উৎপাদন হ্রাস, বেকারত্ব ও মন্দার হাতছানি দেখা যায়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও থিংকট্যাংক ২০২৩ সাল থেকে বিশ্বমন্দা শুরুর পূর্বাভাস দিচ্ছে। দেশে দেশে জাতীয় আয়ের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিসহ মানুষের আয়-রোজগার কমে যাওয়া এবং খাদ্যনিরাপত্তায় হুমকি দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলেছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি হতে পারে। জাতিসংঘের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড বলেছে, আগামী বছর অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। এর প্রভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে, বেকারত্ব বাড়বে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে এবং বিশ্ববাণিজ্য হ্রাস পাবে। আঙ্কটাড প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, বিশ্বমন্দা শুরু হলে ৩৫ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে পড়বে। এফএও-এর জরিপে দেখা যায়, এশিয়ার নয়টি দেশ বড় রকমের খাদ্য সংকটের মধ্যে আছে। এ নয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে অদূর ভবিষ্যত বিশ্ব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাংলাদেশেও খাদ্যাভাবের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এবং দেশবাসীকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সর্বক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
করোনা
মহামারী ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিশ্ব
অর্থনৈতিক পরিস্থিতির নেতিবাচক ধারার পাশাপাশি
রাশিয়া-ইউক্রেন
যুদ্ধে এ দুই দেশ থেকে খাদ্য
সরবরাহ প্রায়
বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্বের
খাদ্য চাহিদার
৩০-৩৫ শতাংশ এই দুই দেশ থেকে আমদানি
করা হতো।
তাছাড়া ইউরোপ,
এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন
দেশ রাশিয়ার
গ্যাস, জ্বালানি
তেল ও সার ক্রয়
করে থাকে
যেগুলোর সরবরাহ
অবরোধও নিষেধাজ্ঞার ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে।
বাংলাদেশেও বৈশ্বিক মন্দাভাব ও মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বিগত ১০ বছরের মধ্যে বর্তমান মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের স্বল্পতার কারণে শিল্পোৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রফতানি প্রবৃদ্ধি গত বছরের তুলনায় অনেক কমে গিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, এলএনজি ও জ্বালানি তেল, সার ইত্যাদি আমদানি করা যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে সাহস পাচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ দরিদ্র এবং এর ভেতর ১ কোটি ৭০ লাখ অতিদরিদ্র। কল-কারখানার প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে এবং বিদ্যুৎ সংকটে অনেক শিল্প ও পোশাক কারখানা প্রায় ৫০ শতাংশ ক্যাপাসিটিতে চলছে। ইউরোপ-আমেরিকায় চাহিদা সংকোচনের কারণে রফতানিও কমছে। এসব কারণে স্বভাবতই একটি বিষয় বারবার আলোচিত হচ্ছে, বাংলাদেশ কি আরেকটি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে? আয়-রোজগার কমে গেলে বা জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ বেকারত্বের ঝুঁকিতে পড়লে তাদের খাদ্যনিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিবে।
উপর্যুক্ত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেশের সার্বিক খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি, কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ও মজুদ পরিস্থিতি, শিল্পোৎপাদন, জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও সার সরবরাহের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার বিশ্লেষণ এবং বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন।
প্রথমেই গত শতাব্দীতে বাংলাদেশের ঘটে যাওয়া দুটি দুর্ভিক্ষের কারণ ও স্বরূপ পর্যালোচনা করা যেতে পারে। ১৯৪২-৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলমান ছিল। তত্কালীন ব্রিটিশ সরকার বাংলায় উৎপাদিত চাল ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের একটা বড় অংশ যুদ্ধ এবং মিত্রশক্তির সৈনিকদের প্রয়োজনে ইংল্যান্ডে স্থানান্তর করে। এর সঙ্গে দেশীয় মজুদদার ও কালোবাজারিদের অতিমুনাফা লোভের কারণে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। ওই সময় দুর্ভিক্ষে বেশ কয়েক লাখ লোক মারা যায়।
একইভাবে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষও মনুষ্যসৃষ্ট এবং একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র ও কারসাজির ফল। এ দেশের মজুদদার, মুনাফাখোর ও কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য খাদ্য মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতির অবনীতির জন্য দায়ী। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে বিশ্বমন্দা দেখা দেয়। বাংলাদেশও এ মন্দার শিকার হয়। ১৯৭৩-৭৪ সালে কৃষি ফলন ভালো হলেও খাদ্য ঘাটতি থেকে যায়। মজুদদার ও চোরাকারবারি ব্যবসায়ীরা খাদ্যসামগ্রী মজুদ করে ভারতে পাচার করে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, ১০-২০ লাখ টন চাল পাচার হয়ে যায়। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। এদিকে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়। বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীদের মজুদদারি, কালোবাজারি ও অতি মুনাফাখোরি কার্যকলাপের ফলে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়, দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি সিদ্ধান্ত প্রকারান্তরে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। ১৯৭৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশ বিভিন্ন থেকে খাদ্য আমদানির কয়েকটি চুক্তি করে। বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র ঘাটতির মুখে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি কোম্পানি দুটি বড় চালানের বিক্রয় বাতিল করে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পিএল-৪৮০ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে প্রদত্ত খাদ্যসাহায্য পাঠানো স্থগিত রাখে। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে দেশে সরকারি হিসাবেই ২৭-৩০ হাজার লোক মারা যায়।
বর্তমান বিশ্বমন্দার ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালে বিশ্বের মোট আয়ের ঘাটতি হবে প্রায় ২০ শতাংশ (বিশ্বব্যাংক)। আঙ্কটাড বলেছে, পূর্বের মন্দা ও অর্থনৈতিক সংকটের তুলনায় এবারের মন্দা আরো তীব্রতর হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে ডলারের বিপরীতে অন্যান্য দেশের মুদ্রার মান হ্রাস পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মন্দাভাব কিছুটা কম হতে পারে। জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলো মূল্যবৃদ্ধির সুবাদে ভালো লাভ করছে। ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের প্রবৃদ্ধিও ভালো। বাংলাদেশ সম্বন্ধে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকির কথা বলা হলেও সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সঠিক নীতি নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নের দক্ষতার ওপর নির্ভর করছে আমাদের ওপর মন্দার চাপ কতটা পড়বে। ২০০৭-০৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বাংলাদেশে তেমন পড়েনি। এর প্রধান কারণ ছিল আমাদের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ শক্তি। দেশে শিল্প-কারখানা ও কৃষিতে উৎপাদন স্বাভাবিক ছিল, কর্মসংস্থানের বিপর্যয় হয়নি, অভ্যন্তরীণ চাহিদা পর্যাপ্ত ছিল।
এবারে প্রধানমন্ত্রী আসন্ন মন্দার প্রেক্ষিতে আগেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, আমাদের কৃষিতে উন্নতি করতে হবে। উন্নত জাতের শস্য উৎপাদন, সার ও সেচের ব্যবহার ঠিক রাখতে হবে, কোনো জমি অনাবাদি রাখা যাবে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খোলা নিশ্চিতকরণ, বাজারে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য মনিটরিং এবং শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
এরই মধ্যে সরকার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সরকারি অফিসে সাশ্রয়ের জন্য বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা খরচে সাশ্রয়ের জন্য সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত অফিসের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ স্থগিত করা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থব্যয় স্থগিত, যানবাহন ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা, ভ্রমণ ভাতা, আপ্যায়ন, আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৫০ শতাংশ ব্যয় কমানোসহ সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রতাসাধনের বেশকিছু আদেশ জারি করা হয়েছে।
এবার দেশের খাদ্য উৎপাদন ও মজুদ পরিস্থিতির দিকে নজর দেয়া যাক। গত বছর দেশে চালের চাহিদা ছিল ৩ কোটি ৫২ লাখ টন। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে জোগান নেমে আসে ৩ কোটি ৪৬ লাখ টনে। ফলে ৬ লাখ টন ঘাটতি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ২০ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়। গমের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে বার্ষিক ৭০ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১০-১২ লাখ টন। ফলে প্রতি বছর প্রায় ৬০ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়। দেশে চলতি বছর বোরো ধানের ভালো ফলন ছিল। কিন্তু হাওরের আগাম বন্যা এবং বৃহত্তর সিলেটসহ আরো কয়েকটি জেলায় কয়েক দফা বন্যার ফলে ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় উৎপাদন ১২-১৫ শতাংশ কম হয়েছে। সাম্প্রতিক খরা এবং ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে আমন ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। লবণাক্ততা, সেচের পানিস্বল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং সার ও কীটনাশকের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আগামী ফসলের ফলন নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা। ফলে খাদ্যশস্য আমদানি এ বছর পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বাড়াতে হবে।
চলতি অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমে ১৯ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু নানা কারণে এ পর্যন্ত চাল ও গম আমদানি লক্ষ্যমাত্রার এক-পঞ্চমাংশও সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে এ দুই দেশ থেকে খাদ্য আমদানি বিলম্বিত হচ্ছে। শিগগিরই আমাদের খাদ্য আমদানি বাড়াতে না পারলে পরবর্তী সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎপাদন কমে গেলে আমাদের আমদানি আরো বিপর্যস্ত হবে। বর্তমানে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়া, ডলারের তুলনায় টাকার মূল্য হ্রাস, এলসি খুলতে ব্যাংক কর্তৃক অনিহা ইত্যাদি কারণে আমদানি কম হয়েছে। খাদ্যশস্য আমদানিতে গতি আনয়নের জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পাশাপাশি প্রয়োজনবোধে সংগ্রহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। খাদ্যশস্য যেমন— চাল, গম মজুদ পরিস্থিতি সর্বদা মনিটর করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী শুধু অর্থনৈতিক মন্দারই পূর্বাভাস দেয়নি, খাদ্যশস্য উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনে বিপর্যয়ের কারণে ভয়াবহ খাদ্য সংকটেরও আভাস দিয়েছে।
অতীতের
অভিজ্ঞতায় দেখা
যায় বাংলাদেশে
খাদ্যদ্রব্যের তীব্র
অভাবের কারণে
দুর্ভিক্ষ হয়নি,
বরং মানুষ্যসৃষ্ট সংকট যেমন—মজুদদারি,
অতি মুনাফালোভ,
চোরাচালান প্রভৃতির
মাধ্যমে সরবরাহ
চেইনে বিঘ্ন
সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজেই
এখন থেকে
খাদ্যশস্য উৎপাদন
যাতে বিঘ্নিত
না হয় সেজন্য বাজেটে
কৃষিতে বিনিয়োগ
বাড়াতে হবে।
দেশের সার উৎপাদন, আমদানি,
মজুদ ও বণ্টনের ভালো
ব্যবস্থা চালু
রয়েছে। লক্ষ্য
রাখতে হবে কোনো কারণে
কোনো ব্যবস্থায়
যাতে বিঘ্ন
সৃষ্টি না হয়। অন্যান্য
খাদ্যশস্য যেমন—ভুট্টা, আলু, পেঁয়াজ, ডাল, আদা-রসুন
ইত্যাদি দেশে
উৎপাদন এবং বিদেশ থেকে
আমদানি নিশ্চিত
করতে হবে।
করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন কারণে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পে এবং সার্ভিস ও পর্যটন খাতে উৎপাদন কমে যাওয়ায় প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ কর্ম হারিয়েছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ভোগ চাহিদা বৃদ্ধি তথা অর্থনীতিকে গতিশীল রাখার জন্য সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতে শিল্পোৎপাদন বাড়াতে হবে, রফতানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার জন্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বর্তমানে বিশ্ববাজারে তরল গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্য কমতির দিকে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের তেল গ্যাস সংগ্রহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করে শিল্পোৎপাদন স্থিতিশীল রাখতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়ানোর পদক্ষেপ হিসেবে যেকোনো মূল্যে হুন্ডি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তাছাড়া রফতানি আয় দ্রুত দেশে আনার আদেশ জারি করতে হবে।
ব্যাংক
সেক্টরে বর্তমানে
নৈরাজ্য ও ভীতিকর অবস্থা
বিরাজ করছে।
ব্যাংক সেক্টরের
সমস্যাগুলো দূরীকরণে
একটি কমিশন
বা বিশেষজ্ঞ
কমিটি গঠন করে দ্রুত
ব্যবস্থা নিতে
হবে। খেলাপি
ঋণ আদায়
ও অর্থ
পাচার রোধে
কঠোর পদক্ষেপ
গ্রহণ করতে
হবে। জাতীয়
রাজস্ব বোর্ডের
প্রশাসনিক সংস্কার
ও অটোমেশনের
মাধ্যমে গতিশীলতা
আনয়নপূর্বক কর আহরণ তথা কর-জিডিপি
অনুপাত বাড়াতে
হবে। সামাজিক
নিরাপত্তা কর্মসূচির
পরিধি ও অর্থ বরাদ্দ
বৃদ্ধি করে বৃদ্ধ, বিধবা,
স্বামী পরিত্যক্তা ও কর্মহীন অতি দরিদ্রদের অন্তর্ভুক্ত করে এদের খাদ্যনিরাপত্তায় সহায়তা করতে হবে।
মোট কথা, দেশ যাতে
দুর্ভিক্ষাবস্থায় না পৌঁছে সেজন্য
সবাইকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে
দেশপ্রেম ও সততা বজায়
রেখে কাজ করতে হবে।
সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ
প্রতিরোধে সব ধরনের গুজব
ও অতিশয়োক্তি পরিহার করে সামাজিক
শান্তি শৃঙ্খলা
বজায় ও দেশের সার্বিক
স্থিতিশীলতা বজায়
রাখা সরকার
এবং বিভিন্ন
দল-মত নির্বিশেষে সবার
একান্ত কর্তব্য।
এটি সম্ভব
হলে বিগত
দুই দশকে
দেশের অব্যাহত
জিডিপি প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত মজবুত
ভিত্তির অর্থনীতি
এর আপন শক্তিতেই গতিশীল
থাকবে।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত