নীতিমালা ছাড়া উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে সংসদীয় কমিটির উদ্বেগ

অভিন্ন পদ্ধতিতে উপাচার্য নিয়োগে বিধিমালা প্রণয়ন করা হোক

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই দেশে। আশির দশকের পর থেকে সরকারের পছন্দে দলীয়করণের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া। উপ-উপাচার্য কোষাধ্যক্ষ নিয়োগও একইভাবে হচ্ছে। অনেক সময় অসৎ অযোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে সরকারও বিপাকে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে। স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পরও উপাচার্য নিয়োগে কার্যকর কোনো নীতিমালা তৈরি করতে না পারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বড় ধরনের ব্যর্থতা। দ্রুতই -সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে গবেষণা, শিক্ষা এবং সার্বিক অর্থে জাতি গঠনের কেন্দ্রবিন্দু। উপাচার্য এটি পরিচালনার শীর্ষে অবস্থান করেন, তাই তার নিয়োগপ্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ, সংবেদনশীল এবং সবার গোচরে হলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ থাকে না। আর গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় যিনি পদে আসীন হবেন, তার অঙ্গীকারের জায়গাটি থাকবে অসীম। তাই বিতর্কিত হওয়ার মতো কাজ করার আশঙ্কা থাকে না বললেই চলে। প্রত্যাশা থাকবে, সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগে সর্বজনগ্রাহ্য অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করবে।

নিয়ম অনুযায়ী, ৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী নির্বাচনের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ হওয়ার কথা। সেটিও আজকাল হচ্ছে না। নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নিয়োগ পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে নিজস্ব আইনে পরিচালিত অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেয় সরকার। ইউজিসি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানসম্পন্ন শিক্ষা গবেষণার উত্কর্ষ সাধনসহ উচ্চশিক্ষার সার্বিক বিষয় দেখভালের দায়িত্ব পালন করলেও দুঃখজনকভাবে উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ইউজিসির কোনো ধরনের মতামত দেয়ার সুযোগ নেই। উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া শুধু হাস্যকরই নয়, দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষালয়গুলোর প্রতি চরম অবহেলা আর অবজ্ঞার শামিল। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে সম্ভাব্য উপাচার্যের ভিশন মিশন যেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা সেখানে তদবির দলান্ধতা সরকার এবং মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রশাসনিক নেতৃত্বদানের সক্ষমতা হিসেবে বিবেচিত হয়, যা হতাশাজনক। এর ফল আমরা প্রত্যক্ষ করছি, আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। উচ্চ-শিক্ষার মানও উন্নত হচ্ছে না।

পাশের দেশ ভারতে উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয় সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে। উন্নত দেশগুলোয়ও একই ধরনের চর্চা রয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়াদকাল ২০২৩ সালে শেষ হবে। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছে, গঠন করা হয়েছে উচ্চ পর্যায়ের উপাচার্য নিয়োগ প্যানেল। সেখানে সরকারের কর্মকর্তা ছাড়াও শিক্ষক, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে বহু জ্ঞানী ব্যক্তির সমাবেশ রয়েছে। উপাচার্য নিয়োগে তারা একটি সাকুর্লারও প্রকাশ করেছে। সেখানে উপাচার্য হওয়ার ক্রাইটেরিয়া পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। তার কাছ থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কী আশা করে এবং তার কাজের স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা কীভাবে নিশ্চিত হবে, তারও উল্লেখ রয়েছে। কেমব্রিজ বা অন্য অনেক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ হয় প্রক্রিয়ায়। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনো স্বচ্ছ প্রক্রিয়া না থাকায় নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করেছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে সরকার আর প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি। উপাচার্যদের যোগ্যতার শর্তগুলো কী হবে সে বিষয়ে প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ বা আইনে কিছুই বলা নেই। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে উপাচার্যের দায়িত্ব স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে, এমনকি কার কাছে জবাবদিহি করবেন, তারও উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হলে উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হবে সর্বাগ্রে।

উপাচার্য হওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা গবেষণা-প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার মাপকাঠির কোনো সুনির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্ক নেই। বিষয়টি কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া মোটামুটি উন্মুক্ত। ন্যূনতম যোগ্যতার কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। বিষয়ে নেই কোনো ধারা বা উপধারা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধরনের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি ক্ষেত্রে পেশাগত শর্ত জুড়ে দেয়া আছে। নতুন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে কৃষিবিজ্ঞানের এবং বিজ্ঞান প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাবিদকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। তবে যা- থাকুক না কেন, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে উপাচার্য নিয়োগের বিষয় সম্পূর্ণ আচার্যের এখতিয়ারভুক্ত করা হয়েছে। যোগ্যতা অভিজ্ঞতার কোনো ফ্রেমওয়ার্ক নেই। তেমনি উপাচার্য হতে ইচ্ছুক একজন ব্যক্তি কীভাবে জানতে পারবেন, কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদ খালি হয়েছে বা হবে, সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা জানাবেন বা দরখাস্ত করবেন, তার পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো কিছুই উন্মুক্ত করা হয় না। তাই কারও পক্ষে বিষয়ে জানা সম্ভব হয় না। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ ছাড়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তির পেছনে কোনো ভিত্তি বা নীতিমালা নেই। বলা যায় কোনো গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া নেই। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদে নিয়োগ দেয়া হয়, তার কোনো পর্ষদের -সংক্রান্ত হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই।

বিদ্যমান বাস্তবতায় উপাচার্য নিয়োগ লাভের ন্যূনতম যোগ্যতার মাপকাঠি ঠিক করতে হবে এবং নিয়োগপ্রক্রিয়ার ধাপগুলো কার্যপরিধি সুনির্দিষ্ট করে দেয়া প্রয়োজন। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ খালি হওয়ার ছয় থেকে নয় মাস আগেই পরবর্তী উপাচার্য নিয়োগের উদ্যোগ নিতে হবে। নিয়োগের উদ্দেশ্যে বিস্তারিত তথ্যসহ উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ প্রচার করতে হবে। প্রাপ্ত আবেদনগুলো প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করে ১০-১৫ জনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা যেতে পারে। এরপর অন্যান্য দেশের মতো তাদের সবার আলাদা আলাদা সাক্ষাত্কার গ্রহণ করতে হবে। সাক্ষাত্কারের ফল এবং সার্বিক যোগ্যতা বিবেচনায় এনে তিনজনের একটি প্যানেল তৈরি করে তা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ করতে পারে। নির্বাচিত তিনজনের প্যানেলের সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে একটি এক ঘণ্টার সেশনে নিজেকে উপস্থাপন, পদ লাভের উদ্দেশ্য তার কর্মপরিকল্পনা সবার কাছে উপস্থাপন করতে হবে। তিনজনের প্যানেল প্রস্তাব উপাচার্য নিয়োগ প্রদানের উদ্দেশ্যে আচার্যের কাছে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পাঠানো হবে। নিয়োগের পর উপাচার্যের জবাবদিহিও নিশ্চিত করা অপরিহার্য। যে কর্তৃপক্ষ উপাচার্য নিয়োগ প্রদান করে, সে কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত পর্ষদের মাধ্যমে বার্ষিকভাবে তার কাজের মূল্যায়ন করবে। পর্ষদ বছরের যেকোনো সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের যেকোনো অংশীজনের কাছ থেকে অভিযোগ গ্রহণ করবে, যা বিবেচনা করার বিষয়টির এখতিয়ার পর্ষদের হাতে থাকবে। এছাড়া ধরনের মূল্যায়নে যা হবে লিখিত এবং গোপনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। মূল্যায়নের জন্য গঠিত নির্ধারিত পর্ষদ তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে তা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবে। কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় করণীয় নির্ধারণ করবে এবং পর্ষদের মূল্যায়ন উপাচার্যকে অবহিত করবে। উপাচার্যের চারিত্রিক দৃঢ়তা, কর্মদক্ষতা, বিচক্ষণতা, সাহসিকতা এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে।

একটি দেশ আগামীতে কতটা এগিয়ে যাবে সেটি নির্ভর করে তার শিক্ষা পদ্ধতি কাঠামো কতটা শক্তিশালী সুদূরপ্রসারী তার ওপর। এক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি সবচেয়ে মজবুত হওয়া জরুরি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে একটি দেশ ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছে, কিন্তু একটি স্বচ্ছ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন উপাচার্য নিয়োগ পদ্ধতি ঠিক করতে পারেনি, যা দুঃখজনক। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অভিন্ন পদ্ধতিতে উপাচার্য নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে এখন যে প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য নিয়োগ হয় তাতে আত্মসম্মানবোধ আছে এমন কোনো যোগ্য শিক্ষক পদে নিজেকে ভাবতে পারেন না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অবশ্যই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে উপাচার্য নিয়োগ করা উচিত। একজনের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস থেকে ছয় মাস আগে নতুন উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হবে। বিজ্ঞাপনের শর্ত পূরণ করলে যোগ্য প্রার্থীরা দেশী-বিদেশী অধ্যাপকের সমন্বয়ে গঠিত একটি সার্চ কমিটির সামনে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তার ভিশন মিশন উপস্থাপন করবে। তার মেয়াদের চার বছরের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করবেন। সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে আচার্য একজনকে নিয়োগ দেবেন। কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য/উপদেষ্টা যাতে উপাচার্য পদের জন্য যোগ্য না হন সেটি শর্তের মধ্যে প্রয়োগ করা দরকার।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন