জ্বালানি

বিদ্যুতের বাজারে বারবার পরীক্ষা নিরীক্ষা বন্ধের সময় এসেছে

ইয়ানিস ভারোফাকিস

ঠিক আমার জানালার উল্টোদিকে পাহাড়ি জায়গায় থাকা বায়ুবিদ্যুতের টারবাইনের ব্লেডগুলো আজ আরো প্রবল শক্তিতে ঘুরছে। গত রাতের ঝড়ের কারণে এখনো বেশ বাতাস বইছে, ফলে বিদ্যুৎ গ্রিডে বাড়তি কিছু কিলোওয়াট যুক্ত হচ্ছে প্রায় শূন্য বাড়তি খরচ দিয়েই (অর্থনীতিবিদদের ভাষায় বলা যায় প্রান্তিক ব্যয় দিয়ে) কিন্তু জীবনযাত্রার প্রবল ব্যয়ের সংকট শেষ করার লড়াইয়ে শামিল জনগণকে অনেক বেশি ভুগতে হতো যদি এসব কিলোওয়াট তৈরিতে টেক্সাস থেকে গ্রিসের উপকূলে আনা বেশ ব্যয়বহুল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হতো। গ্রিস ইউরোপের বাইরেও এমন অযৌক্তিকতা বেশ ভালোভাবেই ছড়িয়ে রয়েছে যেটা শেষ হওয়া দরকার।

মূলত একটি বিভ্রম থেকেই অযৌক্তিকতার শুরু, বিভিন্ন রাষ্ট্র একটি প্রতিযোগিতামূলক কিন্তু দক্ষ বিদ্যুৎ বাজারকে অনুকরণ করতে পারে। যেহেতু আমাদের বাড়ি বা ব্যবসা ক্ষেত্রে শুধু একটি বৈদ্যুতিক তার প্রবেশ করতে পারে, সেই বিষয়টিই বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে তা একটি নিখুঁত একচেটিয়ার দিকে পরিচালিত হবে। তাতে এমন একটি ফল আসবে যেটা কেউ চায় না। ফলে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে জনগণের উপযোগিতাকে প্রতিস্থাপনে তারা একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারকে অনুকরণ করতে পারে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিতরণ করা হয়। কিন্তু সেটা তারা পারেনি।

বাজার মৌলবাদ সারা বিশ্বের বিদ্যুৎ নেটওয়ার্কের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদ্যুৎ খাত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার সদস্য দেশগুলোকে বাধ্য করে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্টেশন থেকে বিদ্যুৎ গ্রিডগুলো আলাদা করার এবং বিদ্যুৎ স্টেশনগুলোকে বেসরকারীকরণ করে নতুন ফার্ম তৈরি করার। সেখানে গ্রিডের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে। বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি অন্য হোস্ট কোম্পানিকে তাদের তারগুলো ইজারা দেবে যারা পাইকারি দামে বিদ্যুৎ কিনবে এবং বাড়ি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খুচরা ব্যবসা করার জন্য প্রতিযোগিতা করবে। উৎপাদকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে পাইকারি মূল্য আরো কমে যাবে। আর খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে কম দাম থেকে শুরু করে বেশি মানসম্পন্ন সেবা পর্যন্ত চূড়ান্ত গ্রাহকের সুবিধাদি নিশ্চিত হবে।

আফসোস, তাত্ত্বিকভাবে এর কোনোটাই কাজ করে না, বাস্তবে ফেরা যাক।

সবসময় গ্রিডের মধ্যে সব পয়েন্টে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার জন্য এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য সিমুলেটেড বাজারগুলো পরস্পরবিরোধী বাধ্যবাধকতার মুখোমুখি হয়। বাজার মৌলবাদরা যেসব সমাধান প্রস্তাব করেছিল সেটা দ্বিগুণ ছিল। সেগুলো হলো অন্য একটি বাজার তৈরি করা, যেখানে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনের অনুমতি দেয়া হবে এবং প্রান্তিক মূল্য নির্ধারণ করা থাকবে। তার অর্থ দাঁড়ায় এর ফলে প্রতিটি কিলোওয়াটের পাইকারি মূল্য সবচেয়ে দামি প্রতি কিলোওয়াটের সমান হবে।

নির্গমনের অনুমতি দেয়া বাজারের উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদকদের কম দূষণযুক্ত জ্বালানি ব্যবহারে আরো বেশি প্রভাবিত করা। নির্ধারিত করের পরিবর্তে সেখানে বাজারই টনপ্রতি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের দাম নির্ধারণ করবে। তাত্ত্বিকভাবে, লিগনাইটের মতো ভয়ংকর সব জ্বালানির ওপর যতদিন বেশি নির্ভরতা থাকবে ততদিন ইইউর দেয়া নির্গমন অনুমতির চাহিদা তত বেশি বাড়বে। ফলে তাদের দামও বেড়ে যাবে এবং প্রাকৃতিক গ্যাসে বা পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চলে যাওয়ার জন্য প্রণোদনা আরো শক্তিশালী হবে।

প্রান্তিক খরচের মূল্য নির্ধারণের উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ সরবরাহের ন্যূনতম মাত্রা নিশ্চিত করা, যেন কম খরচের উৎপাদকদের মাধ্যমে বেশি খরচের বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোরকে বাজার থেকে সরিয়ে দেয়া রোধ করা যায়। দামে কম খরচের উৎপাদকরা যথেষ্ট লাভবান হবেন এবং তারা সস্তা, কম দূষণকারী জ্বালানি উৎসে বিনিয়োগ করার কারণ খুঁজে পাবেন।

তবে নিয়ন্ত্রকদের মাথার মধ্যে কী রয়েছে সেটা জানার জন্য হাইড্রোইলেক্ট্রিক এবং লিগনাইটচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। হাইড্রোইলেক্ট্রিক স্টেশন তৈরি করার নির্ধারিত মূল্য অনেক বেশি কিন্তু সেটার প্রান্তিক ব্যয় শূন্য। যখন পানি ঘূর্ণায়মান হবে, তারপর স্টেশনে যেসব কিলোওয়াট তৈরি হবে সেগুলোর জন্য খরচ হবে না। বিপরীতে লিগনাইটচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন অনেক বেশি কম খরচের, কিন্তু সেখানে কিছুটা প্রান্তিক ব্যয় রয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতি কিলোওয়াট তৈরিতে দামি লিগনাইট ব্যবহারের নির্ধারিত পরিমাণকে প্রকাশিত করা যায়।

প্রতি কিলোওয়াট জলবিদ্যুতের দাম কোনোভাবেই লিগনাইট ব্যবহার করে তৈরি করা বিদ্যুতের প্রান্তিক মূল্য থেকে যেন কম না হয় সেখানে নির্ধারণ করায় ইইউ চেয়েছে জলবিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি মোটা মুনাফা দিয়ে পুরস্কৃত করতে। নিয়ন্ত্রকদের আশা, সেটা পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতাতেই একটি বিনিয়োগ। সময়ে লিগনাইটচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরবর্তী সময়ে অলাভজনক হয়ে যাবে (কেননা দাম শুধু তাদের প্রান্তিক ব্যয় পূরণ করবে) এবং যেহেতু এর ফলে দূষণ ছড়ায়, কারণে অনুমতি চাওয়ার আবেদনও বাড়বে।

কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় তত্ত্বের তুলনায় কম ক্ষমাশীল। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সারা বিশ্বের সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাপক বিপর্যস্ত হওয়ার পর ইউক্রেনে আক্রমণ চালায় রাশিয়া, ফলে প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও বেড়ে যায় তিন গুণ। সবচেয়ে বেশি দূষণ সৃষ্টিকারী জ্বালানি (লিগনাইট) সে সময়ে বেশি ব্যয়বহুল ছিল না, ফলে জীবাশ্ম জ্বালানি বা এলএনজির অবকাঠামোয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করে। প্রান্তিক ব্যয় নির্ধারণে বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুব্ধ খুচরা গ্রাহকের কাছ থেকে অনেক বেশি ভাড়া নেয়, তারা তখন উপলব্ধি করে বিদ্যুতের গড় দামের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে পরিশোধ করছেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই, জনগণ যদি দেখে যে তাদের মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ব্লেড দিয়ে তাদের নিজেদের পরিবেশের কোনো উপকার হচ্ছে না, বরং দৃশ্যপট বদলে দিচ্ছে তাহলে তারা বায়ুবিদ্যুতের বিপক্ষে ঘুরে যাবে।

প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি স্থানীয় একচেটিয়া মালিকানার ওপর একটি সিমুলেটেড বাজারের করা অসাধুতার সময় ঘটে যাওয়া স্থানীয় ব্যর্থতাগুলোকে প্রকাশ করেছে। সেটা আমরা সবাই দেখেছি। কত সহজে উৎপাদনকরা খুচরা বিক্রির দাম নির্ধারণে গোপনে আঁতাত করতে পারেন। পুনর্নবায়নযোগ্য বিষয়াদির তুলনায় তাদের অসংগত লাভ কীভাবে জনগণকে পরিবেশবান্ধব ভাবনায় ফেরার বিপক্ষে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। কীভাবে সিমুলেটেড বাজার দরিদ্র দেশগুলোর জ্বালানি খরচ কমে যাবে এমন একটি সাধারণ ক্রয়কেও বাধাগ্রস্ত করেছিল। কীভাবে খুচরা বিদ্যুৎ বাজার একটি ক্যাসিনোর মতো হয়ে ওঠে যেখানে বিভিন্ন কোম্পানি ভবিষ্যতের বিদ্যুতের দাম নিয়ে পূর্বাভাস করে, ভালো সময়ে লাভ করে এবং যখন তাদের বাজি খারাপ হয়ে যায় তখন রাষ্ট্রীয় বেইলআউট প্রত্যাশা করে।

এখন বিদ্যুতের বাজারে বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করার সময় এসেছে। তার পরিবর্তে আমাদের যেটা দরকার সেটা হলো পাবলিক এনার্জি নেটওয়ার্ক, যেখানে বিদ্যুতের দাম গড় খরচ এবং সে সঙ্গে ছোট্ট মার্ক আপ প্রকাশ করবে। সে সঙ্গে আমাদের একটি কার্বন ট্যাক্সও দরকার, যে আয় থেকে দরিদ্র জনগণদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আমাদের বড় আকারে ম্যানহাটন প্রজেক্টের মতো ভবিষ্যতের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে (যেমন পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন এবং বড় আকারের উপকূলে ভাসমান উইন্ডফার্ম) বিনিয়োগ দরকার। সবশেষে আমাদের পৌরসভা মালিকানাধীন কিছু নেটওয়ার্ক দরকার, যারা বিদ্যমান পুনর্নবায়নযোগ্য (সৌর, বায়ু ব্যাটারি) বিষয়গুলোর একটি কমিউনিটিতে রূপান্তরিত হবে এবং তারাই নিজেদের প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের মালিক, ম্যানেজার এবং সুবিধাভোগী হবে।

[স্বত্ব:প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

 

ইয়ানিস ভারোফাকিস: গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী ইউনিভার্সিটি অব এথেন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক 

ভাষান্তর: শর্মিলা সিনড্রেলা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন