প্রস্তাবিত বাজেট

স্বল্প বরাদ্দে শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে কি

মাছুম বিল্লাহ

প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে, তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অতিনগণ্য। গত অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ, এবার তা হয়েছে ১২ দশমিক শূন্য শতাংশ। কয়েক দশক ধরেই ১২ শতাংশের কাছাকাছিই ছিল বরাদ্দ। তাই বছরের বাজেটেও শিক্ষা রয়েছে গতানুগতিক ধারায়। করোনা-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার নানা গল্প শোনানো হলেও বাজেটে কোনো মৌলিক বা দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তনই দেখা যায়নি। জিডিপির দশমিক ৮৩ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে শিক্ষা খাতে। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম এবং বর্তমান সরকারের টানা ১৪তম বাজেট পেশ করা হয়েছে জুন। লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট, যা জিডিপির ১৫ দশমিক শতাংশ। এটি অস্বীকার করার জো নেই, আমাদের দেশের মতো একটি উন্নয়নশীল জনবহুল দেশের বাজেট তৈরি এবং তা বাস্তবায়ন করা একটি দুরূহ কাজ। তার পরেও সরকারকে সবার আলোচনা-সমালোচনা, প্রশংসা বিরোধিতার মুখোমুখি হয়ে বাজেট প্রতি বছর প্রণয়ন করতে হয়, পেশ করতে হয় এবং বাস্তবায়ন করতে হয়। তাই এতে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকেই যায়।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষার তিন মন্ত্রণালয় বিভাগে ১১ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা বিভাগ, কারিগরি মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এবং প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে মোট ৮১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে তিন বিভাগ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ ছিল ৬৯ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট ছিল ২৮ হাজার ২২২ কোটি টাকা। সে হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ বেড়েছে হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বিভাগে বাজেট ছিল ৩২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিভাগে বরাদ্দ বেড়েছে হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা। কারিগরি মাদ্রাসা বিভাগের জন্য অর্থবছরে হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় বিভাগের বরাদ্দ বেড়েছে ৭১৮ কোটি টাকা।

শিক্ষা খাতকে আমাদের অগ্রাধিকার দিতেই হবে। কভিডকালীন দেশের শিক্ষার্থীরা দুই বছর স্কুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরে ছিল। কাজেই অবধারিতভাবে তাদের শিক্ষাদান শিক্ষাগ্রহণ বিঘ্নিত হয়েছে। অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের কানেক্টের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এতে তারা কিছুটা উপকৃত হলেও সব শিক্ষার্থী অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেনি। বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ছিল অপ্রতুল। এসব ব্যাপারে আরো বেশি নজর দিতে হবে। তাছাড়া আমাদের শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলতে হলে টেকনোলজির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তাই  তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, আবার অন্যদিকে বাজেটে অপটিক্যাল ফাইবারের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে এবং ল্যাপটপ আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসিয়ে ডিভাইস কেনার খরচ বৃদ্ধির প্রস্তাব এসেছে, যা পরস্পর সাংঘর্ষিক।

শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার হার বৃদ্ধি, জেন্ডার সমতা আনয়ন, সাধারণ বিজ্ঞান প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের সমন্বয়ে শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন, ছাত্র-শিক্ষকদের বৃত্তি-উপবৃত্তিসহ আর্থিক সহায়তা প্রদান, মেধার বিকাশে নানরূপ কার্যক্রম গ্রহণ, সহায়ক নীতিমালা পরিবেশ তৈরি, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো নির্মাণ উন্নয়ন, বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা প্রদান, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, -বুকের প্রচলন, উপজেলা আইসিটি ট্রেনিং রিসোর্স সেন্টার স্থাপন ইত্যাদি বহুমাত্রিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসি) মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩৮ হাজার ২৮৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং ১৫ হাজার ১৬৩ জন শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২ হাজার শ্রেণীকক্ষ নির্মাণ করা হচ্ছে। -বুকের প্রচলন, উপজেলা আইসিটি ট্রেনিং রিসোর্স সেন্টার স্থাপন, ৩১৫টি উপজেলায় একটি করে বেসরকারি বিদ্যালয়কে মডেল স্কুলে রূপান্তর করা হয়েছে। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত দরিদ্র মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য গঠিত প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাসহায়তা ট্রাস্ট ফান্ডে সিড মানি হিসেবে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ট্রাস্টি বোর্ড গঠন ট্রাস্টি পরিচালনা বিধি প্রণয়নসহ জনবল কাঠামো চূড়ান্তকরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এগুলো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যেন যেকোনো ধরনের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিপত্তি বা ঝুঁকি মোকাবেলা করা যায়, সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। জাতীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার সমন্বয় থাকতে হবে। এজন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যা বাজেটে সেভাবে প্রতিফলিত হয়নি। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়নি, সেগুলো এমপিওর জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। যেগুলো এমপিও হয়েছে সেগুলো জাতীয়করণের জন্য আন্দোলন করছে। তারা ভাবছে রাষ্ট্র তাদের ঠকাচ্ছে। আবার এটিও ঠিক রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব ভবিষ্যৎ নাগরিকদের শিক্ষা প্রদান। তবে কতজন জনসংখ্যার জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রয়োজন, কতজনের জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয় কলেজ প্রয়োজন, তার একটি বিশ্বাসযোগ্য হিসাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের থাকা উচিত। দেখা যাচ্ছে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিল্ডিংসহ সব ধরনের অবকাঠামো আছে কিন্তু শিক্ষার্থী মাত্র ৫০ কিংবা ১০০ জন। একইভাবে অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, যেখানে শিক্ষার্থী ২০-৩০ জন, এমনকি দুজন কিংবা তিনজন শিক্ষার্থী নিয়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে। এখানেও রয়েছে সঠিক পরিকল্পনার অভাব। বিষয়গুলো একটি সঠিক ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে দেশে কোন পর্যায়ের কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, কতগুলো জনসংখ্যা এলাকার ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে প্রকৃত অর্থে প্রয়োজন, তার হিসাব কিন্তু মন্ত্রণালয়ের থাকা উচিত। বিষয়টি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। কাজেই এসব কর্মকর্তাকে ক্ষমতায়িত করতে হবে এবং প্রকৃত অর্থে যারা শিক্ষানুরাগী, শুধু একটি চাকরির খাতিরে চাকরি করছেন, এমন কর্মকর্তাদের বিভাগে যাতে না দেয়া হয়, সে বিষয়টিও খেয়াল রাখা দরকার।

ইউনেস্কো আইএলওর সুপারিশ এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বা জিডিপির শতাংশ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। বাজেটে শিক্ষা খাতে ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে টাকার অংকে বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও মোট বাজেট জিডিপির আনুপাতিক হারে কম হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে চমক না থাকলেও বরাদ্দ বেড়েছে। মূল বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে—‘কভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন এর আলোকে শিক্ষা বাজেট সেভাবে হতে পারত। বাজেটের শিক্ষা অধ্যায়ে অতিমারীর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষা খাতে বিশেষ উদ্যোগ শিরোনামের ১০৪ নম্বর অনুচ্ছেদটি -সংক্রান্ত হলেও ভেতরে বিশেষ উদ্যোগের কোনো কথা নেই। এখানে অধিকাংশই পুরনো কথা। করোনার সময়ে রেডিও-টিভির মাধ্যমে শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম সরাসরি চলছে। তবে নতুন অংশটুকুর কথা বলা যায়, শিক্ষার্থীদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য শিক্ষকরা নিয়মিত তাদের সঙ্গে সেলফোন ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। বিশেষ করে কভিডসৃষ্ট শিক্ষার ক্ষতি বলতে বিশেষজ্ঞরা যে শিখনশূন্যতা ঝরে পড়ার কথা এতদিন বলে আসছেন, সেগুলো থাকা উচিত ছিল। এবারের শিক্ষা বাজেটে নতুন যে রূপরেখা অনুমোদন হয়েছে এবং নতুন শিক্ষাক্রম যে আগামী বছর থেকে আংশিক বাস্তবায়ন হচ্ছে, সে বিষয়েও কথা থাকতে পারত। শিক্ষানীতি-২০১০-এর কথা বলা হয়েছে, ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে। যদিও বাস্তবতা ভিন্ন। আমরা জানি, নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার খসড়া সরকার ২০২০ সালেই প্রণয়ন করে এর ওপর পরামর্শ আহ্বান করে। ২০২১ সালে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত হয়। এরই মধ্যে এর পাইলর্টিও শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগে এর চূড়ান্ত অনুমোদন হয়েছে এবং আগামী বছর থেকে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হওয়ারও কথা রয়েছে। আর তাই আট লাখ শিক্ষককে ডিসেম্বর ২০২২-এর মধ্যে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথাও আছে। সেখানে নিশ্চয়ই বড় অংকের অর্থ খরচ হওয়ার কথা। গত অর্থবছরে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাহায্য মঞ্জুরি হিসেবে এককালীন কোটি টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। এবার সেখানে ২০ কোটি টাকা অনুদান দেয়া হবে। এটি ভালো দিক এবং যথার্থই যাদের প্রয়োজন, তারা যেন অর্থটা পায় তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

প্রস্তাবিত বাজেটে মোট জিডিপির আকার ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির প্রায় শতাংশেরও নিচে। এটি কাম্য নয়। অথচ এর বরাদ্দ দিয়েই আমরা ঢোল পেটাই, শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ইত্যাদি কথা বলে থাকি, সেটিও ঠিক নয়।

 

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ কান্ট্রি ডিরেক্টর

ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন