এবারো সেরা আটশতে নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়

উচ্চশিক্ষার উত্কর্ষে ঘাটতিরই প্রতিফলন

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডস (কিউএস) বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাংকিং ২০২৩ প্রকাশ করেছে। বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে স্থান পেয়েছে সব মিলিয়ে হাজার ৪০০ বিশ্ববিদ্যালয়। এবার বিশ্বসেরা ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে পাঁচটি। আর যুক্তরাজ্যের চারটি ছাড়াও আছে সুইজারল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়। তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) এবারো প্রথম ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। টানা চতুর্থবারের মতো একই অবস্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) প্রতিষ্ঠান দুটির অবস্থান ৮০১-১০০০তম। এছাড়া র‍্যাংকিংয়ে ১০০১ ১২০০তম অবস্থানে রয়েছে বেসরকারি ব্র্যাক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। দেশে উচ্চশিক্ষায় প্রতি বছর রাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য অর্থ ব্যয় হচ্ছে। বাস্তবায়ন হচ্ছে নানা প্রকল্প। এর পরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থানে উন্নতি নেই। বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে থাকছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এটা জ্ঞানসৃজন, গবেষণা উচ্চশিক্ষার মানে ঘাটতিরই প্রতিফলন।

৫০ পেরিয়ে বাংলাদেশ। সময়ে দেশে উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটেছে বিস্তর। নতুন অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অনুমোদন পেয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসির তথ্য বলছে, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৫৯। তবে সংখ্যায় বাড়লেও মানে রয়ে গেছে প্রশ্ন। তারই প্রতিফলন ঘটছে বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হতাশাজনক অবস্থানে। শুধু কিউএস নয়; সাংহাই টাইমসের মতো অন্য স্বীকৃত বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়েও বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। এর পেছনে বেশকিছু কারণ দায়ী। উচ্চশিক্ষার অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্য গবেষণা হলেও দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয় না। গবেষণার বদলে চলে মুখস্থনির্ভর চাকরিকেন্দ্রিক পড়ালেখা। বিভাগ বা ডিসিপ্লিনভিত্তিক প্রকাশ হয় না ভালো কোনো জার্নাল। রয়েছে মানসম্পন্ন শিক্ষকের ঘাটতি। নিয়োগে আগে কিছুটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়া ছিল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়। পদোন্নতিতেও গবেষণার বিষয়টি অনেকটা উপেক্ষিত। স্বভাবত গবেষণাকেন্দ্রিক পাঠদানেও এর নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান। আবার আধুনিক শিক্ষা সরঞ্জামের ব্যবহার তেমন নেই। পুরনো সেকেলে শিক্ষা উপকরণ দিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান বিনিময়। গলদ আছে শিক্ষাক্রমে। প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে বিশ্ব। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী করা হচ্ছে না শিক্ষাক্রম; করলেও তার গতি বেশ শ্লথ। আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত জার্নালে গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশের প্রেষণা যোগ্যতা নেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। নিজস্ব মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও নেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক র‍্যাংকিং প্রতিযোগিতায় ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।

আমরা দেখছি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ডের বাইরে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। এবারের কিউএস র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষ ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় রয়েছে সিঙ্গাপুরের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, চীনের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, হংকংয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম ২০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আছে দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি, তাইওয়ানের একটি, সৌদি আরবের একটি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি রয়েছে প্রতিবেশী ভারতের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ও। মূলত নতুন জ্ঞানসৃজন গবেষণার মাধ্যমেই উল্লিখিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজকের অবস্থানে উন্নীত হয়েছে।  কাজেই প্রতিষ্ঠানগুলো কী ধরনের পাঠক্রম অনুসরণ করছে, শিক্ষাদান পদ্ধতি কেমন, মান নিয়ন্ত্রণে কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলেছে, সর্বোপরি সেখানকার পরিবেশ কেমন প্রভৃতি বিষয় বিশেষভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলোর তথ্য যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয় না। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের অবস্থাই চরম দুর্দশাগ্রস্ত। ওয়েবসাইটে গেলে বহু পুরনো কিছু তথ্য মেলে অথবা আদৌ কিছুই জানা যায় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি নেই। ফলে দেশের বাইরে থেকে যদি জানতে চান বাংলাদেশী কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে, ওয়েবসাইট থেকে প্রায় কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। এর সমাধান কিন্তু কঠিন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা শিক্ষা এবং অন্যান্য অর্জন সম্পর্কে খুব সহজেই ভালো ওয়েবসাইট বানানো হালনাগাদ করে রাখা সম্ভব। দরকার কেবল সদিচ্ছা সচেতনতা। বিভিন্ন র‍্যাংকিং পদ্ধতিতে স্কোপাস ইনডেক্সড প্রকাশনা (সাইটেশনসহ) এবং শিক্ষাদান গবেষণা রেপুটেশনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। যেমন, কিউএস র‍্যাংকিংয়ে রেপুটেশন সাইটেশনের (স্কোপাস) অবদান যথাক্রমে ৫০ ২০ শতাংশ। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কোপাস ইনডেক্সড প্রকাশনা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে হওয়া গবেষণার ফলাফল ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর/স্কোপাস ইনডেক্সড জার্নালে প্রকাশের সমুদয় ফি প্রদানের ব্যবস্থা নেয়াসহ গবেষকদের বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করতে হবে। বিশ্বজুড়ে চালানো রেপুটেশন সার্ভের মাধ্যমে যে রেপুটেশন-সংশ্লিষ্ট স্কোর হিসাব করা হয়, সেখানেও কীভাবে আরো ভালো করা যায়, তা নিয়ে ভাবা দরকার। যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, শিক্ষক-গবেষকদের বিদেশে সেমিনার-কনফারেন্সে বেশি বেশি যোগদানের ব্যবস্থা করা, বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটের গুণগত মান বৃদ্ধি, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানবিনিময় এবং বিদেশে অবস্থানরত অ্যালামনাইদের সংযুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।

গবেষণার জন্য অর্থায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এখনো গবেষণায় বরাদ্দ কম। আগ্রহী শিক্ষকদের তেমন কোনো প্রণোদনা দেয়া হয় না। বেসরকারি পর্যায় থেকেও গবেষণায় অনুদান দেয়ার প্রথা বিরল বললেই চলে। ফলে অনেকেই ইচ্ছা থাকলেও কাঙ্ক্ষিত গবেষণা করতে পারেন না। আবার উল্টো দিকে গবেষণায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যেটুকু বরাদ্দ দেয়া হয়, তাও অনেক সময় ঠিকমতো ব্যয় হয় না। আনুগত্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাজনৈতিক দলীয় রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের কারণে যথার্থ শিক্ষক বা শিক্ষার্থী অনেক ক্ষেত্রে গবেষণাসংক্রান্ত অর্থ পান না। এতে গবেষণা ব্যাহত হচ্ছে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার মান পরিমাণ বাড়াতে হলে এসব বিষয়েরও সুষ্ঠু সুরাহা প্রয়োজন।

উচ্চশিক্ষার বিশ্বায়ন ঘটেছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যকার প্রতিযোগিতা এখন বৈশ্বিক। বিভিন্ন সংস্থার করা র‍্যাংকিং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় নতুন মাত্রা এনেছে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সম্মানের, সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলার। সুতরাং এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার মানে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিযোগিতা নিশ্চিতে বিদেশী পিএইচডি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি, শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত কমানো, বিদেশী শিক্ষক নিয়োগ, বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ওপর জোর দিচ্ছেন না শিক্ষাবিদরা। এগুলো যথাযথভাবে আমলে নিতে হবে। সম্প্রতি র‍্যাংকিংয়ে অবস্থান উন্নয়নের জন্য বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকার, ইউজিসি কর্তৃপক্ষের সময়োপযোগী পদক্ষেপে দেশে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন