সিন্ডিকেটের কবলে ডলারের বাজার

বাজার কারসাজি রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হোক

খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলারের দাম ক্রমেই বাড়ছে। সোমবারও প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল সর্বোচ্চ ৯৮ টাকা। আকস্মিকভাবে ডলারের দাম সেঞ্চুরি ছাড়িয়েছে। মঙ্গলবার দিনভর প্রতি ডলার বেচাকেনা হয়েছে ১০২ টাকায়। কোথাও কোথাও মানি এক্সচেঞ্জগুলো হাঁকিয়েছে ১০৪ টাকাও। এমনটা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সুতরাং বাজার স্বাভাবিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি ডলার বাজার কৃত্রিমভাবে অস্থিতিশীল করে সুবিধা আদায় করতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থাও নিতে হবে।

করোনাকালে দেশের অর্থনীতি চাপে থাকলেও দুই বছরে ডলারের দাম বাড়েনি। করোনা-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জোরালোভাবে শুরু হয়। শিল্পের প্রয়োজনে বাড়ে আমদানিও। এরই সূত্র ধরে এক মাসের বেশি সময় ধরে বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার। ক্রমে বাড়তে থাকে ডলারের দাম। সর্বশেষ সেঞ্চুরি পার হয়ে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে ডলারের খুচরা বাজারে। অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী, বাজারে কোনো পণ্যের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে ওই পণ্যের দাম বাড়ে। এটি ডলারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যজনিত কিংবা করোনা-পরবর্তী বিদেশ ভ্রমণের কারণে ডলারের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু চাহিদা এত বাড়েনি যে আকস্মিকভাবে ডলারের দামে বড় উল্লম্ফন ঘটবে। তদুপরি সরবরাহেও তেমন একটা ঘাটতি নেই। তাহলে হঠাৎ কেন ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি? এটা খতিয়ে দেখা চাই।

এটা সত্য, দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার (ব্যাংক টু ব্যাংক) এখনো কিছুটা স্থিতিশীল। মঙ্গলবারও ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯৪ থেকে ৯৬ টাকা। এর আগের দিনও প্রায় একই দামে ডলার বেচাকেনা হয়েছিল। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, ডলারের নির্ধারিত বিনিময় হার এখন ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। তবে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের বিনিময় হারে বড় ধরনের তারতম্য হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের রেমিট্যান্সপ্রবাহে। বেশি বিনিময় হার পাওয়ার প্রত্যাশায় বাড়বে অবৈধ হুন্ডির তত্পরতা। এতে রেমিট্যান্সের বড় অংশ ব্যাংকিং চ্যানেলে না এসে হুন্ডিতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে। এমনটা হলে আরো চাপে পড়বে দেশের রিজার্ভ। কাজেই সংকটের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে নীতিনির্ধারণী মহলের কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।

অবশ্য মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের ভাষ্য, এখন প্রবাসফেরত বিদেশী পর্যটকদের কাছ থেকে তেমন ডলার মিলছে না। অন্যদিকে ভ্রমণ, কেনাকাটা, শিক্ষা ব্যয়, চিকিৎসাসহ সব ধরনের বিদেশগামী দেশী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এসব কারণে খোলাবাজারে ডলার সরবরাহ কমেছে। মূলত সরবরাহ সংকটে বাড়ছে ডলারের দাম। কিন্তু দায়িত্বশীল মহল বলছে ভিন্ন কথা। তারা খোলাবাজারে ডলারের দামে বড় উল্লম্ফনের পেছনে ব্যাংকার ট্রেডারদের যোগসাজশকে দায়ী করছেন। নিত্যপণ্যের বাজারে আমরা সিন্ডিকেটের কথা প্রায়ই শুনি। এবার ডলারের খোলাবাজারে যে সিন্ডিকেটের কারসাজির অভিযোগ উঠেছে, এটা হতাশাজনক। তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখা চাই। এর আগে ২০১২ সালেও ডলারের বাজার সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছিল। নিয়ম-কানুন মানতে বাধ্য হলেও মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো অতিমুনাফার জন্য বাজার কারসাজি করেছিল। ফলে বেড়ে গিয়েছিল ডলারের মূল্য। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে তদারকি বাড়িয়েছিল। ফলে নিয়ন্ত্রণে আসে ডলারের দাম। এবারও তা- করতে হবে।

আমরা দেখছি, দেশের আমদানি বিল ক্রমেই বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে গড়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৬৮৩ কোটি ডলার। অর্থবছরের বাকি তিন মাসে একই হারে আমদানি হলে বছর শেষে দেশের আমদানি ব্যয় ৮২ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। রেকর্ড সর্বোচ্চ আমদানি প্রবৃদ্ধি চলতি হিসাবের ঘাটতিকে ২০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে পারে। অবস্থায় আমদানিতে লাগাম টানতে বিলাসপণ্যের আমদানি ঋণপত্রের ন্যূনতম নগদ মার্জিন ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়, এমন পণ্যের নগদ মার্জিন নির্ধারণ করে দিয়েছে ৫০ শতাংশ। এর পরও ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ক্রমেই চাপ বাড়ছে রিজার্ভে। এক্ষেত্রে আরো ইনোভেটিভ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

বতর্মানে রফতানি প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী। তবে আমদানি যে হারে বাড়ছে তার তুলনায় রফতানির গতি শ্লথ। ফলে বাণিজ্য ঘাটতির ব্যবধান ক্রমেই প্রসারমান। ঘাটতি কিছুটা মেটানো হয় প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিদেশ থেকে পাঠানো ডলার দিয়ে। কিন্তু খোলাবাজারে ডলারের দাম অত্যধিক বেড়ে গেলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে কেউ উৎসাহিত হবে না। বেছে নেবে হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক পথ। তাতে তারা ডলারপ্রতি মূল্য বেশি পাবে। এতে বরং আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় আরো বিরূপ প্রভাব পড়বে। সুতরাং খোলাবাজারে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে কারসাজি বন্ধ করতে হবে। দায়ীদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোপরি বাড়াতে হবে পরিবীক্ষণ নজরদারি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রচেষ্টায় ডলারের অস্বাভাবিক মূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবে, এমনটাই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন