আলোকপাত

অর্থনৈতিক যুদ্ধের অধুনা কৌশল

কৌশিক বসু

যুদ্ধের সময় অর্থনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগের ইতিহাস পুরনো। কিন্তু বিশ্বায়ন আন্তঃসীমান্ত সরবরাহ শৃঙ্খলের উত্থান অহিংস যুদ্ধাস্ত্রকে অপ্রত্যাশিতভাবে শক্তিশালী করে তুলেছে। অর্থনৈতিক কিংবা আর্থিক নিষেধাজ্ঞাগুলো হয়তো কামানের গোলার মতো তাত্ক্ষণিকভাবে আঘাত হানে না, কিন্তু এগুলোর পরবর্তী প্রভাব অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক ভয়ংকর।

বিশ্বায়নের পৃথিবীতে অর্থনৈতিক যুদ্ধ কথাটি এতটাই সুশীল শব্দ যে এখনো আমরা পুরোপুরি এর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে এবং তা নিয়ন্ত্রণে নীতি-নিয়ম চালু করতে সক্ষম হইনি। শাস্তিমূলক অর্থনৈতিক অস্ত্রের কোনো সু-সংজ্ঞায়িত তালিকা নেই, যার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ক্ষতির মাত্রা অনুমান করা যায়।

সুতরাং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন ইউক্রেন আক্রমণ করেন, পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের সামনে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত এক পরিস্থিতি উপস্থিত হয়। যার জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন এবং তাদের ন্যাটো জোটের মিত্ররা পুতিনকে নিয়ন্ত্রণ দমনে পারমাণবিক যুদ্ধের পথে না হেঁটে বরং একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। তবে পশ্চিমা সরকারগুলো তাদের প্রয়োগকৃত অর্থনৈতিক সরঞ্জামগুলোর কার্যকারিতা বিশ্লেষণের জন্য লভ্য তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারবিষয়ক বিশাল কর্মযজ্ঞের মুখোমুখি। অবস্থায় আমি মনে করি, পরাশক্তিগুলোর মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত শুরুর আগেই বিশ্বের জন্য অর্থনৈতিক যুদ্ধবিষয়ক নীতি-নিয়ম প্রবর্তন জরুরি।

কীভাবে আরো কার্যকরী অর্থনৈতিক অবরোধ প্রয়োগ করে পুতিনকে পরাজিত করা যায়, এটি মুহূর্তে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা এবং অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির সঙ্গে রাশিয়ার আর্থিক বাণিজ্যিক লেনদেন বন্ধ করার মাধ্যমে দেশটির অর্থনীতিকে চাপে রাখা হয়েছে বটে কিন্তু প্রাথমিকভাবে যতটা ভাবা হয়েছিল ততটা চাপের মধ্যে তারা পড়েনি। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার তেলের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার বেড়ে যায়। এর সঙ্গে মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুবলের মানেরও বড় ধরনের অবমূল্যায়ন ঘটে। তবে যেমনটা ধারণা করেছিল রুবলের মান ততটা পড়েনি। তাছাড়া বর্তমান সময়ে তা খানিকটা পুনরুদ্ধারও হয়েছে।

কেন হয়েছে তা বোঝাটাও খুব সহজ। ধরুন বেশ কয়েকজন ক্রেতা বিক্রেতার একটা বাজারে গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা ইউ বলল, তারা আর অন্যতম সরবরাহকারী আর-এর কাছ থেকে তেল ক্রয় করবে না। ইউ যখন তেল ক্রয়ের জন্য অন্যান্য বাজারের দ্বারস্থ হবে তখন তাত্ক্ষণিক একটা ধাক্কা লাগবে, তেলের দাম বাড়বে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রভাবটি বিলীন হয়ে যাবে, কারণ আর তখন তার তেল অন্য ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে পারে, যেমন এক্স এদিকে এক্সের কাছে আগে যারা তেল বিক্রি করত, তারা এখন তাদের পণ্যটি আবার ইউয়ের কাছে বিক্রি করতে পারে।

এটাও সত্য, তেলের দাম এখনো আগের মতো কমেনি। বিশেষ করে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ পূর্ববর্তী অবস্থার কথা যদি বিবেচনা করা হয়। কারণ দীর্ঘ সরবরাহ পথ পণ্যের খরচ বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু হলিউডের মিউজিক্যাল ছবিতে আমরা যেমন দেখি হঠাৎ নৃত্যশিল্পীদের পার্টনারের পরিবর্তন ঘটলে প্রাথমিক অবস্থায় তা তাদের পারফরম্যান্সের ওপর প্রভাব ফেললেও তখন করার কিছুই থাকে না, অনুষ্ঠানটি চালিয়ে যেতে হয়।

এখানে আরো একটি কারণ থাকতে পারে, যা সম্ভবত রাশিয়ার পক্ষে গিয়েছে। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারণে তেলের দাম বাড়ার অর্থ হচ্ছে রাশিয়ার তেল রফতানি কমে গেলেও সামগ্রিক আয় কমেনি। তাছাড়া রুবলের মানের পুনরুদ্ধার ইঙ্গিত দেয়, সম্ভবত এটাই ঘটছে। অবস্থায় আরোপিত তেল নিষেধাজ্ঞা থেকে রাশিয়া যেন সহজে বেরিয়ে যেতে সক্ষম না হয়, তা নিশ্চিত করতে আমেরিকাকে আরো কার্যকরভাবে তিনমুখী হুমকি দিতে হবে। শুধু রাশিয়াকে হুমকি দিলেই চলবে না, রাশিয়ার কাছ থেকে যারা তেল ক্রয় করছে তাদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।

তাছাড়া তিনমুখী নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে আমেরিকা তো রীতিমতো ওস্তাদ দেশ। দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর বিপরীতে অনৈতিকভাবে তারা তা ব্যবহারও করেছে। উদাহরণস্বরূপ ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ যখন একটা দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির সামনে তখন তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন কিউবার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের সূত্র ধরে তাদের খাদ্যসহায়তা বন্ধ করে দেন। যদিও নিক্সনের পদক্ষেপটি অনৈতিক ছিল এবং এর কোনো আইনগত ভিত্তিও ছিল না। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে হেলমস-বার্টন অ্যাক্ট জারির মাধ্যমে বিষয়টিকে চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয়। হেলমস-বার্টন আইন হচ্ছে কিউবাকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে কৌশলে তৈরি করা ফেডারেল আইনের একটি অংশ। প্রেলিউড টু পলিটিক্যাল ইকোনমি নামে আমার লেখা গ্রন্থে আলোচনা করেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে আইনটির মাধ্যমে তিনমুখী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কিউবার কণ্ঠনালি চেপে ধরেছিল।

একইভাবে, ১৯৬২ সালে কিউবার মিসাইল সংকটের সময় যেমন বিশ্বকে পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কঠোর কৌশলগত বিশ্লেষণ ব্যবহার করে! বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমেরিকা আজ একই ধরনের বিশ্লেষণাত্মক নির্ভুলতা নিয়ে হাজির হয়েছে। আর ন্যাটো জোট তার সীমান্তে পুতিনের মতো স্বেচ্ছাচারীকে মোকাবেলা করছে।

উদীয়মান হুমকিগুলো পরাস্ত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরো বেশি সুস্পষ্টভাবে বলতে হবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের নিষেধাজ্ঞাগুলো শুধু পুতিন তার মিত্রদের বিপরীতে। ক্রেমলিনের বর্তমান ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীটি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমেরিকা রাশিয়ার অর্থনীতিকে পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে সহয়তা করবে। আর বার্তা সব রাশিয়ানের কাছে পৌঁছে দেয়া জরুরি।

এদিকে দীর্ঘমেয়াদে যে বিষয়টি অনেক বেশি মনোযোগ প্রাপ্তির দাবি রাখে তা হচ্ছে, সম্প্রতি রঘুরাম জি. রাজন যেমন তার লেখা অর্থনৈতিক অবরোধ বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে পাল্টে দেবে শীর্ষক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, অর্থনৈতিক অবরোধের লাগাম টানার জন্য একগুচ্ছ নিয়ম প্রবর্তন প্রয়োজন।

কেননা জটিল বহুজাতিক মূল্যশৃঙ্খলের বর্তমান বিশ্বায়িত বিশ্বে বড় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন রকমের কায়দাকানুন ব্যবহার করতে সক্ষম। যেমন অন্য দেশের অর্থনীতিকে আঘাত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া।

একইভাবে ক্ষমতাধর একটি দেশের সঙ্গে যদি উন্নয়নশীল কোনো রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব হয়, তাহলে স্থানীয় মুদ্রা ছাপিয়ে তা শহরে-বন্দরে বণ্টনের মাধ্যমে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ক্ষমতাধর দেশটি অন্য পক্ষকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির মধ্যে ফেলতে পারে। ধরনের কাজগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ না করলে যে কেউ তা থেকে ফায়দা তুলতে সক্ষম।

পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তা হয়তো পুতিনকে পরাস্ত করার জন্য যুক্তিযুক্ত, তবে তা অর্থনৈতিক যুদ্ধকে নজিরবিহীন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ঠিক যেমন প্রচলিত যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আমাদের সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত না করা ঘিরে বিধিনিষেধ। তেমনি অর্থনৈতিক সংঘাতে কোন পদক্ষেপটি অনুমোদিত এবং কোন পদক্ষেপটি নিষিদ্ধ, তার জন্য আমাদের নিয়ম তৈরি করতে হবে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

 

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন