বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতি

ইউক্রেন সংকটে যে বাস্তবতা পশ্চিমা বিশ্বের বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন

ন্যান্সি কিয়ান

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাচ্ছে বলে খবর মিলছে। সৃষ্টি হয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। তবে ধরনের সংকট একদমই নতুন নয়, নতুন নয় রাশিয়ার লক্ষ্যও। কয়েক শতক ধরে ইউক্রেন মস্কোভিত্তিক সরকারগুলোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের অধীনে শাসিত হয়ে আসছে। দেশটি এখন ২০১৪ সালে চালানো হামলার মতো রাশিয়ার ভবিষ্যৎ আগ্রাসন থেকে সুরক্ষা পেতে চায়। এজন্য তারা ন্যাটোর সহযোগিতা প্রত্যাশা করে। কিন্তু রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করছেন, রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত থাকা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় আর সামরিক সম্প্রসারণ না করার বিষয়ে নিরাপত্তা জোটটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ওই প্রতিশ্রুতি তাদের মানতে হবে। 

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো অবশ্য যুক্তিতে রাশিয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করছে যে সব দেশেরই নিজস্ব ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার আছে। তবে ইউক্রেনের স্বাধীনতা সুরক্ষার বিষয়টি যতটা সোজা মনে হয়, ততটা নয়। ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিতে রাশিয়া যে ব্যয় করতে ইচ্ছুক এবং রাশিয়ার কর্তৃত্ব থেকে দেশটিকে রক্ষা করতে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো যে ব্যয় করতে ইচ্ছুক, তার মধ্যে ব্যাপক অসামঞ্জস্য বিদ্যমান। 

রাশিয়ার মিত্র কম, মাত্র গুটিকয়েক। অন্যদিকে ন্যাটো গঠিত বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ধনী ৩০টি দেশ নিয়ে; যাদের সর্বাধুনিক সামরিক বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। তার পরও ২০০ বছরের অধিক সময়জুড়ে পশ্চিমা ইউরোপীয় দেশগুলোর (যারা রাশিয়ার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত) বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশগুলোকে বাফার হিসেবে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছে রাশিয়া। দেশটির পক্ষে সেটি সম্ভব হয়েছে প্রায় সবসময়ই শক্তি প্রয়োগ আগ্রাসনের মাধ্যমে। 

আজকের ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপটে পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা তার পূর্বসূরিদের মতো। তিনি উদ্বিগ্ন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে রাশিয়ার পশ্চিমের বাফার অঞ্চলগুলো বেলারুশের কাছে পর্যবসিত হয়েছে। কাজেই রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের মধ্যে ইউক্রেনকে রাখার বিষয়টি পুতিনের  দিক থেকে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং দেশটির ভূরাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল।   

সন্দেহ নেই, যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোর অধিকাংশ সদস্যেরই পুতিনের মতো একই মাত্রার প্রেষণা নেই। উপরন্তু, ইতিহাসের নানা সময়ের অভিজ্ঞতা বলে যে বৃহৎ আগ্রাসী কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমান্ত থাকা রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতার নিরাপত্তা বিধান করা আসলে কতটা কঠিন। শীতল যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে এক ব্যয়বহুল যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। এরপর দক্ষিণ ভিয়েতনামকে স্বাধীন রাখতে মার্কিন পরাশক্তিকে আরো ব্যয়বহুল এক যুদ্ধ চালাতে হয়েছিল এবং অবশেষে সেখানে ব্যর্থও হয়েছিল তারা। ওই দুটি যুদ্ধ এশিয়ায় ২০ বছর স্থায়ী হয়েছিল, ৯০ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা তাতে নিহত হয়েছিলেন। সব মিলিয়ে ব্যয় হয়েছিল প্রায় দশমিক ট্রিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ।

আগের যুদ্ধগুলো থেকে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছু শিক্ষা পেয়েছে। রাজনৈতিক সুস্থিরতা-সুশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা বা একটি কার্যকর অর্থনীতি গড়ে তোলার ২০ বছরের ব্যর্থতার পর দেশটি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করেছে। এরই মধ্যে সেখানে তালেবানরা ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। যদিও আফগানিস্তান থেকে ইউক্রেন খুব ভিন্নতর। তবে প্রকৃত বাস্তবতা হলো, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের অন্য কোনো বিদেশী রাষ্ট্রে সামরিক অভিযানের ব্যাপারে কোনো আগ্রহই নেই।

এসব বিষয় পুতিন খুব ভালোভাবে জানেন। তার প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রনেতাদের মতো কর্তৃত্ববাদী নেতা অভ্যন্তরীণ জনমত দ্বারা সীমায়িত নন, বাধিত নন। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় কেন একটি যুদ্ধ জরুরি, সেটা জনপ্রতিনিধিদের বোঝাতে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র দেশগুলোর যতটা কাঠখড় পোড়াতে হবে, ততটা কঠিন হবে না পুতিনের জন্য। কেননা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেখানে রুশ জাতীয়তাবাদ ক্রমেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। পুতিনের শাসন মূলত বৈধতা পেয়েছে ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়ায় রাশিয়ার সম্প্রসারণের পর।

এটা সত্য, পুতিনের শাসনগত বৈধতা তার পর থেকে তাত্পর্যজনকভাবে কমেছে এবং দেশটির জনগণও মনে হয় ইউক্রেনে যুদ্ধ নিয়ে শঙ্কিত। কিন্তু সোভিয়েতকালীন দুর্ভিক্ষের মতো ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে পুতিন জানেন প্রধান কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে রুশ জনগণের ওপর উল্লেখযোগ্য ব্যয় চাপানো সম্ভব।

অধিকন্তু, সংকট নিরসনের উপায় হিসেবে পুতিনের আগ্রাসনের কৌশল গ্রহণের পেছনে ন্যাটোর নিজস্ব আচরণও ভূমিকা রাখতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার জিডিপি সামরিক ব্যয় সব সময়ের নিচে নেমে এলেও ন্যাটো অবসায়ন করা হয়নি, যদিও শীতল যুদ্ধের সময়কার সোভিয়েত ইউনিয়নকে কব্জা করার প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্যেই এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বরং তার পরিবর্তে মধ্য পূর্ব ইউরোপের সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোসহ তিনটি প্রজাতন্ত্রে জোটটি সামরিক সম্প্রসারণ করেছে।

এদিকে ২০০৮ সালের দিকে রাশিয়ার জিডিপি সামরিক ব্যয় আবার ঘুরে দাঁড়ায় এবং ইউক্রেন জর্জিয়াকে ন্যাটোতে যোগ দিতে রাশিয়া উসকে দিচ্ছে বলে ফ্রান্স জার্মানি আপত্তি প্রকাশ করে। এটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। ওই প্রশাসন সম্মত হয়েছিল, ন্যাটো ইউক্রেনকে ভবিষ্যৎ সদস্যপদ দেয়ার (যা বুখারেস্ট কম্প্রোমাইজ নামে পরিচিত) একটা অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি সনদ ইস্যু করবে।

ঘটনার কয়েক মাস পরে রাশিয়া জর্জিয়ায় আক্রমণ চালায় এবং পশ্চিমা দেশগুলো বলতে গেলে কোনো প্রতিরোধই করতে পারেনি। তদুপরি রাশিয়ার কৌশলগত বিজয় অর্থনৈতিক বিস্ফোরণের সঙ্গেও মিলে যায়। যার সবকিছুই পুতিনকে তার রাজনৈতিক ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সাহায্য করে। 

পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ন্যাটো আগে-পরে ইউক্রেনকে সদস্যভুক্ত করবে, যদি জোটটি মনে করে যে সেটি ঠেকাতে রাশিয়া আর লড়বে না। যদি রাশিয়া বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রদর্শন করে যে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিতে দেশটি সত্যিই লড়বে, তাহলে দুটি ঘটনা ঘটতে পারেহয় পশ্চিমা দেশগুলো শান্তি আলোচনায় ব্রতী হবে, নতুবা এমন এক যুদ্ধ হবে, যেটিতে লড়াই করতে ন্যাটোর খুব কমই আগ্রহ থাকবে। যাই ঘটুক না কেন, বিশ্বাসযোগ্যভাবে একটি যুদ্ধের হুমকি সৃষ্টি ইউক্রেনকে রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের মধ্যে রাখতে পুতিনের সম্ভাবনা অনেকটা বাড়িয়ে দেয় বৈকি। 

ঐতিহাসিকভাবে ন্যাটো সম্প্রসারণের সবচেয়ে জোরালো প্রবক্তা যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্তিসংগতভাবে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে হবে। রাশিয়া মরিয়াভাবে যুদ্ধ করবেই। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রও লড়াই করবেএটা বিশ্বাসযোগ্যভাবে দেখানো  না গেলে ইউক্রেনকে রুশ প্রভাব থেকে মুক্ত করা যাবে না এবং প্রকৃত অর্থে দেশটি স্বাধীনও হবে না। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি কল্পনা করলে দেখা যাবে যুুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বিধান্বিত উদ্যমহীন একটি যুদ্ধ চূড়ান্তভাবে ইউক্রেনের নাগরিকদের একটা ভয়াবহ মানবিক অর্থনৈতিক পরিণামের দিকে ঠেলে দেবে; যা মোটেই কাম্য নয়।

আজকের নির্মম বাস্তবতা মেনে নিতে পশ্চিমা দেশগুলোর কেউ কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছে। এর লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। তবে অন্য কেউ কেউ বলছেন, পুতিনের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছার যেকোনো ইচ্ছা মিউনিখে নািস জার্মানির সঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলিনের তোষণনীতির সমতুল্য হবে। ভাষ্যটি ঠিক নয়। পূর্ণ স্বাধীনতার আদর্শ না হলেও যুদ্ধ প্রতিরোধই হলো বর্তমানে সর্বোত্তম পন্থা, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মিত্র দেশগুলো ইউক্রেনের সার্বিক কল্যাণ সমুন্নত রাখতে পারে। এর অন্যথা সব দিক থেকেই বিপর্যয়কর হবে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

ন্যান্সি কিয়ান: যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির কেলগ স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের ম্যানেজারিয়েল ইকোনমিকস অ্যান্ড ডিসিশন সায়েন্সের অধ্যাপক; প্রতিষ্ঠানকালীন পরিচালক, চায়না ইকোনো ল্যাব অ্যান্ড নর্থওয়েস্টার্ন চায়না ল্যাব

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন