পর্যালোচনা

মানুষ মূল্যস্ফীতিকে কেন ভয় পায়

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, চাহিদার তুলনায় দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের স্বল্পতা এবং করোনার প্রভাব মোকাবেলায় দেশের বাজারে টাকার প্রবাহ বৃদ্ধিতে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। জুলাইয়ের দশমিক ৫৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বেড়ে আগস্টে দশমিক ৬৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ আগামীতে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি মানুষের কাছে, বিশেষ করে গরিব, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মধ্যবিত্তের কাছে সবসময় ভীতিকর। মূল্যস্ফীতিকে মানুষ কেন ভয় পায়, তা আলোচনা করাই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

১১ অক্টোবর বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিল্প খাতের কাঁচামাল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের প্রায় প্রতিটিরই আন্তর্জাতিক বাজার এখন ঊর্ধ্বমুখী। বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের আমদানি খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি ভোক্তা ব্যয়েও ব্যাপক উল্লম্ফনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এখন টান পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও। সার্বিকভাবে দেশের গোটা অর্থনীতিতেই এখন বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈশ্বিক পণ্যবাজারে মূল্যের বর্তমান গতি। যেমন নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন গমের মূল্য ছিল ২০০ ডলারের ঘরে। ধারাবাহিকভাবে বেড়ে এখন তা টনপ্রতি ২৬৫ ডলার ছুঁয়েছে। একই সময়ের মধ্যে সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি ৭৭৩ থেকে বেড়ে প্রায় হাজার ৪০০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। করোনা শুরুর আগে বিশ্ববাজারে প্রতি টন চালের মূল্য ছিল ৪২৪ ডলার। চলতি বছরের জুন শেষে বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম ৪৮৪ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা চলছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল এলএনজির দামে। ২০২০ সালের জুলাইয়ে বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনির দাম ছিল ২৪ সেন্ট। চলতি বছরের জুলাইয়ে প্রতি কেজি চিনির দাম ৩৭ সেন্ট পর্যন্ত উঠেছে। দাম আরো বাড়বে, কারণ ১৫ অক্টোবর ইন্টারকন্টিনেন্টাল এক্সচেঞ্জে আগামী বছরের মার্চে সরবরাহের জন্য লেনদেন হওয়া অপরিশোধিত চিনির দাম দশমিক শতাংশ বেড়েছে (বণিক বার্তা, ১৭ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল, এলএনজিসহ ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের ওপর।

দ্বিতীয়ত, চাহিদার তুলনায় দেশীয় উৎপাদনস্বল্পতা খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। প্রধান খাদ্য চাল চাহিদার তুলনায় উৎপাদিত না হওয়ায় সরকার চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রয়োজনে আরো চাল আমদানি করা হবে। বিশ্ববাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় জনগণকে বর্তমানের ৪৭-৪৮ টাকা কেজির মোটা চাল আরো বেশি দামে কিনতে হবে। খাদ্যশস্যে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা গমের চাহিদার (কম-বেশি ৭০ লাখ টন) শতকরা ভাগের ভাগই আমদানি করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারের গমের দাম বেড়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়বে, তেমনি অন্যদিকে জনগণকে আটা, ময়দা বা গম থেকে তৈরি খাদ্যপণ্য কিনতে বেশি অর্থ খরচ করতে হবে। একই কারণে অর্থাৎ স্থানীয় উৎপাদন-স্বল্পতার কারণে বাড়ছে ভোজ্যতেল, দুধ, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ বিভিন্ন মসলা, ফলমূল ইত্যাদির দাম। 

তৃতীয় যে বিষয়টি মূল্যস্ফীতিতে সহায়তা করছে তা হলো, দেশে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি। জুলাইয়ে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে অর্থপ্রবাহের গতি নিম্নমুখী থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাপক অর্থ সরবরাহ (এম-) বৃদ্ধির বার্ষিক সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ শতাংশ। এজন্য অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক খাত থেকে নিট ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা জোগান দেয়া হবে। আর বেসরকারি খাত থেকে জোগান দেয়া হবে লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা।

প্রশ্ন উঠতে পারে, মানুষ মূল্যস্ফীতিকে ভয় পায় কেন? নিচে এর প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো।

এক. মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ খাদ্যদ্রব্যের, বিশেষ করে চালের মূল্যবৃদ্ধি। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বরাত দিয়ে ১২ আগস্ট ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। শুধু মোটা চালের দাম বাড়েনি, বেড়েছে মাঝারি সরু চালের দাম। ১০ আগস্ট মানবজমিনের এক রিপোর্টে বলা হয়, মাঝারি ধরনের নাজিরশাইল মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬৬-৬৮ টাকা। আর সরু নাজির মিনিকেট ৭২ টাকা কেজিতে। একটি পরিবারে মাসিক যে ব্যয় হয়, তার প্রায় অর্ধেক চলে যায় খাদ্য সংগ্রহে। বিবিএসের প্রাথমিক হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ২০১৬ অনুযায়ী, জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট ব্যয়ের ৪৭ দশমিক ৭০ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। গ্রামাঞ্চলে খাদ্যে ব্যয় হয় ৫০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে খাদ্যে ব্যয়ের পরিমাণ ৪২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায়, গ্রামে বসবাসকারী কম-বেশি ৭০ শতাংশ মানুষ খাদ্যে বেশি ব্যয় করে। আর সাধারণ মানুষ খাদ্যে যে ব্যয় করে, তার কম-বেশি ৮০ শতাংশ চালে। বিআইডিএসের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়লে ৭৩ দশমিক শতাংশ হতদরিদ্র পরিবারই তখন চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। দরিদ্র পরিবারের বেলায় হার ৬৬ শতাংশ। তাই মোটা চালের দাম উচ্চহারে বৃদ্ধি পেলে তাদের খাদ্যনিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়ে। শুধু দরিদ্র হতদরিদ্ররা নন, চালের মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্তরাও, বিশেষ করে যাদের আয় নির্দিষ্ট। চালের দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্তদের আমিষজাতীয় খাবার কেনা অনেকটা কমিয়ে দিতে হয়। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু নারীদের পুষ্টির অভাব ঘটে। এতে অবনতি ঘটে তাদের স্বাস্থ্যের। তাছাড়া এসব পরিবারকে কমিয়ে দিতে হয় শিক্ষা খাতে ব্যয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা। সংকুচিত করতে হয় তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই খাদ্যে, বিশেষ করে চালের মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের কাছে ভীতি হয়ে দেখা দেয়।

তাছাড়া বেড়েছে চিনি, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, মাছ, মুরগি, রুটি-বিস্কুট ইত্যাদির দাম। চিনি পেঁয়াজের আমদানি শুল্ক কিছুটা কমানো হলেও এগুলো এখনো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সয়াবিনের দাম বেড়েই চলেছে। করোনাকালের আগে (মার্চ ২০২০) ১০৫ টাকায় যে সয়াবিন তেল (প্রতি লিটার) বিক্রি হতো, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। বেড়েছে মাছ মুরগির দাম। করোনাকালের আগের ১১৫ টাকার (প্রতি কেজি) ব্রয়লার মুরগি এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকায়। নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী, যেমন সুগন্ধি সাবান, কাপড় কাচার সাবান, টিস্যু, টুথপেস্ট, নারকেল তেল, রান্নার গ্যাস (এলপিজি) ইত্যাদির দাম বেড়েছে। 

দুই. খাদ্যবহির্ভূত খাতেও ব্যয় বেড়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে চিকিৎসায় ব্যক্তির নিজস্ব খরচ বেড়েছে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৭৪ শতাংশ এখন ব্যক্তির নিজস্ব খরচ। ২০১৫ সালে ব্যয় ছিল ৬৭ শতাংশ, ২০১২ সালে যা ছিল ৬৩ শতাংশ। আর স্বাস্থ্য ব্যয়ে ব্যক্তির নিজস্ব খরচের ৬৫ শতাংশের বেশি ব্যয় হয় ওষুধ সংগ্রহে। রোগ নির্ণয় পরীক্ষার জন্য ১৫-২০ শতাংশ, হাসপাতালের শয্যা বা কেবিনের ভাড়া বাবদ প্রায় ১০ শতাংশ এবং ডাক্তারের পরামর্শ ফি বাবদ - শতাংশ ব্যয় হয়। শহরাঞ্চলে বেড়েছে পানির দাম। করোনার প্রভাব কমে প্রায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসায় শহরাঞ্চলে বাড়ছে বাড়িভাড়া। বেড়েছে যাতায়াত ব্যয়, যা আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে আরো বেড়ে যেতে পারে।

খাদ্য খাদ্যবহির্ভূত খাতে যখন মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে এবং ঘটছে, তখন হ্রাস পেয়েছে মানুষের আয়। করোনা মহামারীর কারণে দেশে কর্মসংস্থানে মূল ভূমিকা পালনকারী বেসরকারি খাতে চাকরিচ্যুতি, বেতন/মজুরি হ্রাস এবং অন্যান্য কারণে মানুষের আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ পরিচালিত স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ওয়ার্কপ্লেস ২০২১ শীর্ষক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, করোনা মহামারীর সময়ে বিশ্বে প্রতি তিনজনের একজন চাকরি বা কাজ হারিয়েছেন। ফলে মানুষের আয় কমেছে। সমীক্ষায় আরো বলা হয়েছে, করোনার সময় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। করোনার কারণে অঞ্চলের ৬৬ শতাংশ সাময়িকভাবে কাজ থেকে ছিটকে পড়েছেন এবং ৫০ শতাংশ চাকরি হারিয়েছেন। একই সঙ্গে যোগ হয়েছে শ্রমশক্তিতে প্রবেশের উপযোগী মানুষ, বিশেষ করে শ্রমশক্তির চূড়ামণি যুবকরা। করোনার কারণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শ্লথগতির কারণে বেড়েছে বেকারত্বের হার, যা দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। কারণ বেকারত্ব দারিদ্র্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

সব শেষে বলতে চাই, যে সময় সাধারণ মানুষের আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে এবং দারিদ্র্যের হারে উল্লম্ফন ঘটেছে, সে সময় মূল্যস্ফীতি তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে। বিশেষ করে গরিব অতিগরিবরা খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তাই মূল্যস্ফীতি হ্রাসসহ সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধির জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক খাদ্য সচিব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন