বাংলাদেশ ডকট্রিনের খোঁজে

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

বাংলাদেশ ৫১ বছরে পা দিয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে নিজেদেরই জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন, সময়ে কী কী অর্জন হয়েছে? মুক্তিযুদ্ধের তিন মূল স্তম্ভসাম্য, মানবিক মর্যাদা সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে ভবিষ্যত্মুখী বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের পথনকশা দরকার? এক্ষেত্রে উন্নয়ননীতির সঙ্গে নিরাপত্তানীতির কীভাবে সমন্বয় করা যায়? সমন্বিত নীতির কৌশল কার্যপ্রণালি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সংস্থাগুলো কী হবেএসব বিষয় পরিকল্পিতভাবে পর্যালোচনা বিন্যাস জরুরি।

বিশ্বের অনেক দেশেই সুনির্দিষ্ট ডকট্রিন বা মতবাদ আছে। মূলত রাষ্ট্রের নিরাপত্তানীতিতেই ডকট্রিন প্রতিফলিত হয়। আলোকেই পররাষ্ট্র প্রতিরক্ষানীতি প্রণীত হয়। কাজেই ভবিষ্যতের অগ্রসরমান বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ডকট্রিন থাকা প্রয়োজনীয়। ডকট্রিন অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগ পরিচালিত হবে এবং নিজস্ব মিশন ভিশনগুলো পূরণ করবে।

বাংলাদেশ ডকট্রিনের স্বরূপ কেমন হতে পারে? বাংলাদেশের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনাগুলো বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে। ভিত্তিভূমি আছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতাও কম নয়। পরম্পরায় এখানে বর্তমান আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে বিশ্লেষণের পাশাপাশি বাংলাদেশ ডকট্রিনের স্বরূপ সন্ধানের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। শুরু হোক বাংলাদেশ ডকট্রিন নিয়ে আলাপ-তর্ক-বাহাস। নিঃসন্দেহে থিসিস অ্যান্টিথিসিসের পর সিন্থেসিস তৈরি হবে।

জানা-অজানার দ্বন্দ্ব

সারা বিশ্ব অতিমারীর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই একে গ্রেট ডিজরাপশন বা মহাবিচ্যুতি বলছেন। ধরনের পরিস্থিতিতে অস্ট্রিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী জোসেফ সুম্পিটারের ভাষ্য ধার করে ক্রিয়েটিভ ডেসট্রাকশন তথা সৃষ্টিশীল ধ্বংস হিসেবেও দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ সময়ে পুরনোকে ভেঙে একটি সৃজনশীল নতুন পন্থার দিকেও যাওয়া যায়। এক্ষেত্রে কিছু অজানা এবং কিছু জানা বিষয় আছে। উদাহরণস্বরূপ, চতুষ্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ বা কোয়াডের কথা বলা যায়। কোয়াডের লক্ষ্য কী, প্রতিষ্ঠান কী এবং এটি আসলে কীভাবে কাজ করবে তা স্পষ্ট নয়। উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ন্যাটো এবং ওয়ারশ প্যাক্ট হয়েছিল। এগুলোর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য কৌশল সম্পর্কে মোটামুটি সবার স্পষ্ট ধারণা ছিল। ফলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়েছে।

কিন্তু জানা-অজানা অবস্থা একটি বিভ্রান্ত পরিস্থিতি বা কনফিউজড স্টেট তৈরি করে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একেক সময়ে নিজস্ব স্বার্থকে কেন্দ্র করে (শত্রু বা মিত্র উভয়ের ক্ষেত্রে হতে পারে) একেক ধরনের নীতি নেয়। একসময় চীনকে নিরাপত্তা পরিষদের আসন দেয়া হয়েছিল। আজকের চীনের উত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা ছিল। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা ছিল তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে। তখন নিক্সন প্রশাসনের খুবই পরাক্রমশালী কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার চীনের সঙ্গে একটি মেলবন্ধন তৈরি করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে লক্ষ করা গেছে, চীন যুক্তরাষ্ট্রকে মিরর বা প্রতিফলন করবে বলে আশা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র পরে বরং ধাক্কা খেয়েছে।

এশিয়া-প্যাসিফিক পার্টনারশিপের ক্ষেত্রে জানা-অজানা দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে অংশীদারিত্বের তিন নম্বর ধাপ চলছে। প্রথমে নাম ছিল পিভট টু এশিয়া, তারপর এল ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি, আর এখন বলা হচ্ছে এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি। মজার বিষয় হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো তার কৌশলটি পরিষ্কার করেনি। এর মধ্যে করোনাক্রান্তির আগেই বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ান জাপানিজরা চতুষ্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপকে বেশ এগিয়ে নিয়েছে। তারা এক্ষেত্রে বেশ আগ্রাসী কায়দায় সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছে। রকম পরিস্থিতিতে এর সঙ্গে ভারত যুক্ত হয়েছে। এখানে মুশকিল হলো, এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিটা আসলে কী ধরনের সাংগঠনিক কাঠামো নেবে, তার কার্যপরিধি কী হবে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কাজ করবে (মানবাধিকার, সামরিক, বাণিজ্যিক না গণতান্ত্রিক স্বার্থের ক্ষেত্রে হবে) পরিষ্কার জানা যাচ্ছে না। তার মানে যুক্তরাষ্ট্র আসলে বলতে পারছে না তার উদ্যোগ বা কৌশলটা কোনদিকে যাবে। কারণ তার অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি ধরে রাখতে এবং রাজনৈতিকভাবে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা-বৈরিতার এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। অবস্থায় তারা আসলে বিষয়গুলো পরিষ্কার করতে পারছে না। এজন্য অবস্থাকে বলা যায় জানা-অজানা অবস্থা, কিছু বিষয় জানা গেলেও অনেক বিষয় অপরিষ্কার। আবার প্রতিবেশী দেশের আইডিয়া অব ইন্ডিয়া নিয়ে একটি দোদুল্যমানতা বা অস্পষ্টতা আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন, ভোটাধিকার, বর্ণ ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ বিষয়েও বিভ্রান্ত অবস্থায় (কনফিউজড স্টেট) আছে।

অন্যদিকে চীন জ্ঞান, বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বড় রকমের উল্লম্ফন ঘটাচ্ছে। বড় ধরনের বৈষম্য থাকলেও চীন এখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটা ন্যায্যতা আনার চেষ্টা করছে। আবার চীন অন্তত তিন ধরনের বৈপরীত্যকে সমাধান করতে পারছে না। প্রথমত, চীন মনে করছে তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হবে। অথচ আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো উন্নয়নশীল দেশ রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, একটি দেশের পরাশক্তি হতে গেলে তার সফট পাওয়ার লাগে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকারের কথা ফেরি করে। চীন শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপরই জোর দিচ্ছে। শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্ক কিন্তু বন্ধু তৈরি করতে পারে না। বন্ধুত্ব তৈরি করতে না পারলে সম্পর্কের নরম্যাটিভ লেজিটিমেসি বা আদর্শিক বৈধতা তৈরি হয় না। তৃতীয়ত, চীনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কৌশলগত সাফল্যের পরিচয় দিলেও সফট পাওয়ার বাস্তবায়ন করার জন্য দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তির দেশ হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক দক্ষতা দেখাতে পারছে না।

এখন সবাই যার যার ঘর সামলাতে ব্যস্ত। রকম পরিস্থিতি একটা বড় রকমের সুযোগও বটে। যখন অনেকেই অজানার মধ্যে আছে, তখনই কিন্তু উত্থান হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিকে অগ্রসরমান বাংলাদেশ নির্মাণের পটভূমি হিসেবে সদ্ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সংবিধানের মূল বিষয়টিই ধারণ করতে হবেকারো সঙ্গে বৈরিতা নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ শান্তিবাদী এবং রক্ষণাত্মক ভূমিকা নিতে চায়। এভাবেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের উত্থান হতে পারে। আর এজন্যই বাংলাদেশের একটি সুনির্দিষ্ট ডকট্রিন দরকার। মুহূর্তকে হাতছাড়া করা যাবে না।

চারটি দৃশ্যকল্প

বাংলাদেশ জনসংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপসাগরীয় দেশ। উপসাগরের মাধ্যমে থার্ড কান্ট্রি কোনানড্রাম অর্থাৎ অন্য জায়গায় যেতে হলে আরেকটি দেশের ভেতর দিয়ে যেতে হয় পরিস্থিতিকে এড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশের ভূ-সীমানা অধিকাংশ এলাকা ভারত আর কিছু অংশ মিয়ানমারের সঙ্গে। বঙ্গোপসাগরকে আমলে নিলে বাংলাদেশের বিরাট সুবিধা আছে।

বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা অপরিসীম। তাদের মধ্যে সমরূপতাও আছে। অর্থে বাংলাদেশের উত্থানটা অন্য দেশের চেয়ে সহজ হওয়ার কথা। আলোচ্য প্রেক্ষাপটে এখানে চারটি দৃশ্যকল্পের আলোকে বাংলাদেশ ডকট্রিন সন্ধান করার প্রয়াস নেয়া যাক। প্রতিটি দৃশ্যকল্পের রয়েছে দুটো শর্তপ্রয়োজনীয় শর্ত (নেসেসারি কন্ডিশন) দরকারি শর্ত (সাফিশিয়েন্ট কন্ডিশন)

প্রথমত, আঞ্চলিক উত্তেজনাকর অবস্থায় প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে ভৌগোলিকভাবে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা রাষ্ট্র সর্বাধিক কৌশলগত স্বার্থ আদায় করতে সমর্থ হয়। কিন্তু অবস্থায় দরকারি শর্ত হিসেবে একটি জাতির ক্ষমতা নির্ভর করে তার উৎপাদনের উপকরণগুলো কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর ওপর। উৎপাদনের উপকরণের উৎপাদনশীলতা বেশি হলে সহজে পুঁজি গঠন হয় নির্ভরতা হ্রাস পায়।

দ্বিতীয়ত, একটি রাষ্ট্র আঞ্চলিক আপেক্ষিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে ভূখণ্ডের বাইরে পরাশক্তির সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে পারে। কিন্তু উৎপাদনের উপকরণগুলোর কার্যকর ব্যবহার নির্ভর করে উভয় জাতির রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ওপর। রাজনৈতিক সম্মতি, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতা অর্থনীতির চাকা সচল রাখার দরকারি শর্ত।

তৃতীয়ত, একটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশ সর্বাধিক সুবিধা আদায় করতে পারে, যদি প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে এবং তার বাইরে অন্যান্য দেশের সঙ্গে নানাবিধ উদ্দেশ্য সামনে রেখে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে। সাধারণত একটি দুর্বল রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রটি মূলত বিভিন্ন পরাশক্তির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। চেষ্টা রাষ্ট্রটিকে আরো দুর্বল করে দেয় এবং দুষ্টচক্রের মধ্যে নিপতিত করে।

চতুর্থত, একটি দেশকে সামনে এগিয়ে যেতে হলে তার সম্পদের সর্বোচ্চ উৎপাদনমুখীন ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভূকৌশলত অবস্থানকে কাজে লাগানো। দরকারি শর্ত হিসেবে আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর অধিপত্যের মধ্যে একটি দুর্বল রাষ্ট্রের সফল রূপান্তরের জন্য একটি ঐকমত্যের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রয়োজন। এটি রাষ্ট্রের আদর্শিক বৈধতা উৎপাদন করবে এবং জনগণের কাছে একটি দায়বদ্ধ সরকার ব্যবস্থা তৈরি করবে, যার মাধ্যমে উৎপাদনের উপকরণগুলোর কার্যকরী ব্যবহার নিশ্চিত হবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট উপর্যুক্ত দৃশ্যকল্পের আলোকে বাংলাদেশের জন্য চারটি বিকল্প চিন্তা করা যাক।

প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্মিলিত উদ্যোগ

বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে সংযুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে পারে। কিন্তু দেখতে হবে, এটি করতে গেলে দেশের জনগণের অ্যাস্পিরেশন বা আকাঙ্ক্ষা তাতে সায় দেয় কিনা। প্রতিবেশী দেশ যদি জানা-অজানা অবস্থার মধ্যে থাকে, তবে উদ্যোগ কাজে আসবে না। কারণেই দেখা দরকার, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আসলেই যথেষ্ট ক্ষমতা আছে কিনা উভয় দেশের জনগণের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার। অর্থাৎ সামনে গিয়ে বাংলাদেশও পুঁজি বা ক্যাপিটাল দেবে এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রও ক্যাপিটাল দেবে। এভাবে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি হবে। প্রেক্ষাপটে ব্যবস্থা খুব বেশি সুবিধাজনক নয়।

ভারসাম্য বজায় রেখে সম্পর্ক

বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যালান্স বা ভারসাম্য করতে পারে। এটা বাজারে সবচেয়ে চলতি বিষয়। তবে এটিই সবচেয়ে বিপজ্জনক! কারণ প্রথমটার ক্ষেত্রে একটা বিরাট ইতিবাচক বিষয় আছে যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র তার কৌশলগত ম্যাপে প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে প্রত্যক্ষ ভূরাজনৈতিকভাবে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে গণ্য করে। অথচ ব্যালান্স করতে গেলে প্রতিবেশী কৌশলগত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতাকালে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টানা যায়। একসময়ের সুসম্পর্ক পরিস্থিতি ভেদে বৈরিতার পর্যায়েও যেতে পারে। কাজেই দীর্ঘমেয়াদে দ্বিতীয় অপশনটিও বাংলাদেশের জন্য স্থায়িত্বশীল নয়।

পরাশক্তির সঙ্গে জোট

কোনো একটি পরাশক্তির সঙ্গে জোট বাঁধা কখন সম্ভব হবে তা খতিয়ে দেখার দরকার আছে। ইতিহাসগতভাবে এর অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। যেমন জাপান, তাইওয়ান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, এমনকি থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সঙ্গে মিত্রতার মাধ্যমে উত্থান নিশ্চিত করেছে। মুশকিলের বিষয় হলো, বর্তমান পরিস্থিতিতে পরাশক্তিগুলোর ভেতরকার এজেন্ডা অজানা।

নিজের মতো করে এগিয়ে যাওয়া

সারা বিশ্ব যখন পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির মধ্যে আছে, তখন প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণ না করে প্রপোজিশনাল পলিটিকসই বাংলাদেশ ডকট্রিনের মূল বিষয় হওয়া দরকার। এখন দেখা যাক, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কী কী উপাদান আছে। সবচেয়ে বড় সম্পদ সুবিধা হলো বঙ্গোপসাগর। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ বিভিন্ন ইকোনমিক জোন বা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। বিভিন্ন দেশ এক্ষেত্রে বেশ উৎসাহ দেখাচ্ছে। কিন্তু আমরা এখনো অফশোর ইকোনমিক জোনের ধারণার দিকে যেতে পারেনি। অফশোর ইকোনমিক জোন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হতে পারে। এখানে ব্র্যান্ডিং হতে হবে শান্তিপূর্ণ বঙ্গোপসাগর ধারণার রূপায়ণ।

যদি বহু দেশ বিনিয়োগ করে, তখন কিন্তু তাদের স্বার্থেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। শান্তিপূর্ণ বঙ্গোপসাগর ধারণার বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হলো বাংলাদেশ তার অফশোরকে বিনিয়োগযোগ্য পরিস্থিতিতে নিয়ে যাবে। যখনই কয়েকটি দেশ বিনিয়োগ করবে, তখন প্রত্যেকেই তার বিনিয়োগের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তখন তারা কোনোভাবেই বঙ্গোপসাগরকে কনফ্লিক্ট জোন বা সংঘর্ষপূর্ণ অঞ্চলের দিকে যেতে দেবে না।

বর্তমানে বাংলাদেশের একটা শক্তির জায়গা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এখন রিজার্ভের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলার। এজন্য দ্রুত এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট ব্যাংক করা দরকার। যদি শতাংশের বেশি হারে সুদে অন্যান্য দেশকে রিজার্ভের অর্থ থেকে ঋণ দেয়া যায়, অনেকেই নিতে আগ্রহী হবে। কারণ তাদের এখন অর্থ দরকার। কোনো দেশ যদি সংকটে থাকে, তখন তাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করলে দীর্ঘস্থায়ী মিত্রে পরিণত হয়। এতে একদিকে বাংলাদেশ শতাংশ হারে সুদ পাবে, অর্থনীতি বড় হবে। আবার আস্থার জায়গাও তৈরি হবে। অন্য দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি সহজ হবে। সুতরাং রিজার্ভকে কাজে লাগানো জরুরি।

প্রয়োজনীয় দরকারি শর্ত

বাংলাদেশ নিজস্ব সুনির্দিষ্ট ডকট্রিনের আলোকে সামনে এগিয়ে যেতে হলে কতগুলো প্রয়োজনীয় দরকারি শর্ত পূরণ করা জরুরি। প্রয়োজনীয় শর্তগুলোর একটি হলো, উৎপাদনের উপকরণগুলোর কার্যকর ব্যবহার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। এক্ষেত্রে পুঁজি গঠন ত্বরান্বিত করা জরুরি। শ্রমিকের দক্ষতা উৎপাদনশীলতা বাড়ালে তাদের মজুরিও বাড়বে। তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ গবেষণা বাড়ানোর বিকল্প নেই। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫-৬৫ বছরের কর্মক্ষম জনশক্তির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। যদি তা যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়, পরিমাণ কর্মক্ষম জনশক্তি যেকোনো দেশের উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এক বিরাট সম্পদ। একে জনমিতিক লভ্যাংশ বলা হয়। অতএব জনমিতিক লভ্যাংশ বাংলাদেশের মৌল অর্থনৈতিক কৌশল।

অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ বঙ্গোপসাগর গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে ডেভেলপমেন্ট ডিটারেন্স তৈরি করা। অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য বা ক্রেডিবল পাওয়ার হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করা। কারণ ক্রেডিবল পাওয়ার না হলে কোনো কিছুই কাজ করবে না। ছোট দেশ হলেও সিঙ্গাপুর ডিটারেন্স তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। কাজেই অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশকেও মেকানাইজেশন, থ্রি-ডাইমেনশনের দিকে যেতে হবে এবং এরিয়েল পাওয়ার নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে পররাষ্ট্র নীতির মৌল কাঠামো হবে শান্তির বঙ্গোপসাগর, প্রতিরক্ষানীতি ডেভেলপমেন্ট ডিটারেন্সকে আবর্তন করে হতে হবে। আর এজন্য অপরিহার্য নরম্যাটিভ লেজিটিমেসি বা আদর্শিক বৈধতা। অর্থাৎ জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটা সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

যেকোনো দেশের অগ্রগতির দরকারি বা অপরিহার্য শর্ত হলো জনগণের পক্ষ থেকে আদর্শিক বৈধতা (নরম্যাটিভ লেজিটিমেসি), কার্যকর শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এবং সক্রিয় নাগরিকত্বতথা রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের দায়িত্বশীল সম্পর্ক। উন্নয়ন শুধু রাষ্ট্র, বাজার বা পুঁজির বিষয় নয়। প্রাণকেন্দ্রে জনগণ নাগরিকের বৈধতা।


. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ উন্নয়ন অন্বেষণ-এর চেয়ারপারসন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন