আলোচনা

ঐতিহাসিক সম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন

[গতকালের পর]

. আদনান মোর্শেদ: এবার আমরা . সাজ্জাদ জহিরের কাছে যাব। ইতিহাস সংরক্ষণের বিষয়টি আমাদের দেশে গণ-আলাপে কেন স্থান পায় না? আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে আত্মপরিচয়ের যে রাজনীতি, সেখানে কি ইতিহাস সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়? ব্যর্থতাটা কোথায়? মধ্যবিত্তের দীনতায়, শিক্ষায়? আমরা কি গবেষণালব্ধ, ইতিহাসসমৃদ্ধ জ্ঞান উৎপাদন করতে পারছি না বলে? নাকি প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেল এবং ভোগবাদে আবিষ্ট থাকার কারণে...

. সাজ্জাদ জহির: আমি আসলে একটু ভিন্ন আঙ্গিক থেকে আলোচনাটা তুলব। কিছুটা বেমানান লাগতে পারে, কিছুটা হতাশ হতে পারেন। সোস্যাল অ্যাক্টিভিজমের সঙ্গে সরাসরি কোনো বক্তব্য থাকবে না এখানে। তবে আপনি দুই গুচ্ছ প্রশ্ন করেছেন। শুরুতেই বলে নিই, দুই বছর ধরে আমার অ্যাফিলিয়েশন কিন্তু ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের সঙ্গে। বর্তমানে আমি সেখানকার নির্বাহী পরিচালক। আর প্রশ্নে যদি ফিরি তাহলে দেখব আলোচনার মূলে রয়েছে কিন্তু ইতিহাস ঐতিহ্য। শুরুতে প্রশ্ন জাগে কার ইতিহাস, কার ঐতিহ্য। কার কথাটির ভেতরে আত্মানুসন্ধানের বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে উল্লেখ না করে আত্মপরিচয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করাটা অসম্ভব। প্রথমেই যখন জানলাম বাংলায় সংলাপের আয়োজন করা হয়েছে, আমার ধারণা হচ্ছে আয়োজকরা শুরুতেই নিদেনপক্ষে বাংলা ভাষাভাষীদের বুঝিয়েছেন। সুতরাং পরিপ্রেক্ষিতেই ইতিহাস-ঐতিহ্য কতটা এগোচ্ছে, সেই বিষয়টি দেখি। তারও আগে পুরো কাঠামোটা চিন্তা করা ভালো। আমি নিজে যেহেতু পুরাতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ, স্থপতি কোনোটিই নই। আজকের সঙ্গে আমার যোগসূত্র টানতে গেলে আমার নিজের ভাবনা তিনটি জায়গায় বলা আছে, এটি শুধু উল্লেখ করব। একটি হলো বহুধাখণ্ডিত বাঙালি প্রাসঙ্গিক ভাবনা বলে একটি নিবন্ধ গত বছরের জানুয়ারিতে বণিক বার্তায় প্রকাশ হয়েছিল, যা আজকের আলোচনার সহ-আয়োজক। আর পাঁচ-ছয় বছর আগে উপমহাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার রাজনৈতিক অর্থনীতি প্রসঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে একটি প্রস্তাবনা উঠে আসছিল যে আসলে উপমহাদেশের একটি প্রধান বৈপরীত্য হলো পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের। সেই অর্থে আমরা পূর্বাঞ্চলের মধ্যে পড়ি। সুতরাং ওই ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে দেখলে অনেক বিষয় পরিষ্কার হবে।

বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে কয়েকটি ছোট প্রস্তাবনার মাধ্যমে উত্তরটা দেয়ার চেষ্টা করি। এক. সাধারণত জনগোষ্ঠীকে নিয়ে যদি চিন্তা করি, সাধারণ বাঙালি হোক বা যেকোনো জনগোষ্ঠী হোক, যাদের মধ্যে সুদূর অতীতের ঐতিহ্যকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে মতপার্থক্য নেই, তাদের মাঝে মতপার্থক্য তৈরি হবে নিকট অতীতকে নিয়ে। সুদূর নিকটের মাঝে একটা টাইমলাইন টানতে হয়, যেটি ক্ষমতাবলয়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ আজকে একাত্তর নিয়ে ভাবছি, কাল অন্য কেউ হয়তো সাতচল্লিশকে নিয়ে ভাববে। দুদিন পরে হয়তো কেউ আশিকে নিয়ে ভাববে। একেকটা টাইমলাইন কিন্তু বাছার ব্যাপার আছে। আমি জানি না, রিজওয়ানা ভালো বলতে পারবেন, ঐতিহ্য চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আইনি কাঠামোর ভেতরে নির্দিষ্ট বিষয় আছে কিনা। বাংলা ভাষাভাষীরা নিঃসন্দেহে দলে পড়ে না, অনেক অতীতের ব্যাপারে আমাদের সবারই ঐকমত্য আছে, এটা আমাদের ইতিহাস এবং এটা আমার ঐতিহ্য। আমরা যে সংকর জাতি, এটা সবাই স্বীকার করি। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা, বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী, এমনকি বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতিসত্তা নৃগোষ্ঠী আছে। সে কারণে ভিন্ন ভিন্ন সময়রেখা বেছে বিবাদে লিপ্ত হচ্ছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সর্বজনস্বীকৃতির বিকল্প একটি সম্মোহন আছে। আমরা শুনেছি যে কোনো কোনো ভূখণ্ডে এবং আমাদের এলাকায়ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী স্ব-স্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি নিয়ে সহাবস্থান করত। এটা অনেকে মনে করে। অনেকের মতে, বহু শতাব্দী আগে উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে তেমনটিই ছিল। ইতিহাসবিদরা ব্যাপারে বিশদ বলতে পারবেন। তবে আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় জেনেছি, বৈচিত্র্যসম্পন্ন সংগঠন বা সমাজকে কার্যকর রাখার উপাদান অনুসন্ধানের চেয়ে আমার সাবজেক্ট অর্থনীতিতে ট্র্যাজেডি অব কমনসের মোড়কে যৌথ উদ্যোগকে অকার্যকর ঘোষণা করার প্রবণতা প্রাধান্য পাচ্ছে। অর্থাৎ আমরা বুঝতে চেষ্টা করিনি কীভাবে সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়। সম্ভবত কারণে সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত প্রায় ক্ষণস্থায়ী হয়ে দেখা দিচ্ছে। নিজেদের মাঝে আমরা ডিভাইড অ্যান্ড রুলের স্বীকৃতি দিলেও বহিঃশক্তির উপস্থিতির বিভাজনের প্রভাব সামাজিক বিশ্লেষণের আওতায় তেমন আনার চেষ্টা করিনি। চিরাচরিত প্রথায় বেদবাক্যের মতো জেনেছি যে নির্দিষ্ট নৃগোষ্ঠী, স্বার্থগোষ্ঠী অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে দলিত করে নিজের সত্য বা কল্পগুলো সবার অতীত বলে প্রতিস্থাপন করতে সচেষ্ট হয়েছে। সর্বজনস্বীকৃত অতীত হোক বা ভিন্ন অতীতধারীর সহাবস্থান হোক, ইতিহাস ঐতিহ্যকে চিহ্নিত করার জন্য সময়রেখা নির্ধারণ জরুরি। এবং আপেক্ষিক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায় অতীতের একটি পর্বের সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরির জন্য অর্থাৎ বর্তমানকে সুদীর্ঘ কালের অতীতের সঙ্গে গ্রথিত করতে প্রতিটি সময়রেখায় গ্রহণযোগ্য গিঁট বাঁধা দরকার। ব্যাখ্যা দিলে বলব, আজকে যদি মনে হয় একাত্তর থেকে পর্যন্ত আমরা একটা সমঝোতায় যাব, তারও অনেক পদক্ষেপ আছে। সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয় আছে।

অন্য প্রশ্নগুলোর কয়েকটি দিক সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে বলব। অর্থনীতিতে অনেকে বলেন, পছন্দ একই রকম হলে সেবা পণ্যবাজারের আকারও বৃদ্ধি পায়। বাজার বড় হলে ইকোনমি অব স্কেল আসে। নিম্নব্যয়ে বাজারে জোগান দেয়া সম্ভব হয় এবং স্থানীয় পর্যায়ের উৎপাদনটা টেকসই হয়। একইভাবে ঐতিহাসিক নিদর্শনে দর্শনার্থীদের ভিড় হবে, যদি অনেকেই সেই নিদর্শন বা ঐতিহ্যের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে বলব, বিনিয়োগ আর্থিকভাবে লাভজনক হবে যদি স্বতঃস্ফূর্ত একাত্মতা ব্যাপক হয়। এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ধর্তব্যে আনা প্রয়োজন, যদি অভ্যন্তরীণ বাজার খণ্ডিত থাকে, তাহলে তা বিদেশী ব্যবসার সহজ শিকারে পরিণত হয়। সেটি যেমন মধ্যবিত্তের গৃহনির্মাণে নানা পছন্দ মেটাতে চীন থেকে পণ্য আমদানি বাড়ছে, তেমনি মসজিদ-মন্দির নির্মাণে আসা বাইরের অর্থের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটি সিরিয়াসলি ভাবার কথা বলব। কারণ এসব বিষয় যদি বন্ধ না করা হয় তাহলে বিভাজনটা বাড়তেই থাকবে।

দ্বিতীয় একটি বিষয় বলব, যা প্রবৃদ্ধিকে নিয়ে। নিজের চিন্তাকাঠামোয় যেভাবে ভাবছিলাম যে দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে একাত্মতা থাকা জনগোষ্ঠীর দেশে উন্নয়ন টেকসই হয়। বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না গিয়েও সাধারণভাবে দেখা যায়। প্রবৃদ্ধিনির্ভর উন্নয়ন হচ্ছে বলে ঐতিহ্যের প্রতি অবজ্ঞা দেখানো হবেএমন কোনো কারণ কিন্তু আমি দেখি না। অথচ অধিক মতকে পক্ষে নিয়ে ঐতিহাসিক নিদর্শন বা ঐতিহ্য চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে প্রবৃদ্ধিনির্ভর নতুন ইতিহাস গড়ার প্রয়াস দেখা যায়। এটা আসলে বাই ডিফল্ট, একটা জিনিস করতে পারা যায় না বলে আরেকটি জিনিস করতে হয়। এই যে প্রবৃদ্ধির দিকে তাড়িত হওয়া অনেকটা বাই ডিফল্ট, যেহেতু অন্য কিছু ঘটেনি এবং তার সঙ্গে আমরা মার্কেটটা দেখি।

আমার তৃতীয় প্রস্তাব, বহুধাবিভক্ত বাংলা ভাষাভাষী। এর নানান রূপ নানান চেহারা। আমার লেখায় কিছুটা ইঙ্গিত আছে। তাহলে বেরোনোর পথ কোথায়। সম্ভাব্য তিনটি পথ নিয়ে ভাবছিলাম। এক. আমাদের অতীত নিয়ে আমরা যদি একটা সর্বসম্মত মতে পৌঁছাতে পারি। দুই. ক্ষমতার দম্ভে কোনো এক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বা দল নিজেদের ইতিহাস অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়। সেটিও একটা সম্ভাব্যতা। তিন. আধুনিকতা প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে অতি নিকট অতীত থেকে ইতিহাসের যাত্রা শুরু করা। তিনটি জিনিস দেখতে পাচ্ছি আমার চোখের সামনে। ঐতিহ্যের সঙ্গে আত্মপরিচয়ের বাসনা জড়িত, যা মূলত অতীত আশ্রয়ী। সাধারণত যখন বাইরের আগ্রাসনের শঙ্কা জাগে, তখনই আত্মপরিচয় খোঁজার চেষ্টা করা হয়।

কয়েকটি কথা বলে শেষ করব। এক. সত্যি বলতে কি, শিক্ষা স্বাস্থ্যে আসলে খুঁজে বেড়াই কারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, কোথায় সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, দেখতে পাই না। যদিও আমি একমত রওনক আপা যেটি বলছিলেন, সীমিত লোকজনকে ভ্যাকসিন প্রয়োগের কাজটি অনেক সুন্দর হচ্ছে বলে অনেকেই জানে। কিন্তু মস্তিষ্কের অবস্থানটি কোথায়, সেটি ভাবার বিষয়। দুই. গিঁট বাঁধা মেলবন্ধন করতে কিছু সময়রেখা চিহ্নিত করা দরকার এবং তার সঙ্গে যেসব ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন, তা চিহ্নিত করা প্রয়োজন। ১৯৭১ থেকে আজ অবধি ছোটখাটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাশ কাটিয়ে করা হচ্ছে, তাও নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। আমি বাংলাদেশে ঐতিহাসিক নিদর্শনভিত্তিক ট্যুরিজম বাজার দেখছি। এটি আরো জোরদার করা জরুরি।

. আদনান মোর্শেদ: পরবর্তী প্রশ্নে আমি আবার . রওনক জাহানের কাছে যাচ্ছি। ইতিহাস সচেতনতাকে পাবলিক পলিসিতে পরিণত করতে রাষ্ট্রের কী ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

. রওনক জাহান: প্রথমে আমি বলব যে একটা স্টেটমেন্ট মানুষ নরম্যাটিকভাবে দিতেই পারে। বলতেই পারি, রাষ্ট্রের স্বায়ত্তশাসিত কিছু প্রতিষ্ঠান (অটোনোমাস ইনস্টিটিউশন) থাকা দরকার, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও আছে প্রত্নস্থলগুলো দেখার জন্য। কিন্তু আজকাল আমি বলব আমাদের বর্তমান অভিজ্ঞতার আলোকে যে কোনো কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দিই, তাহলে তা সুরক্ষিত থাকবে এমন নিশ্চয়তা নেই। আসলে রাষ্ট্র এবং সরকারের মধ্যে একটা পার্থক্য তো অবশ্যই থাকা দরকার। দুঃখজনকভাবে আমাদের সরকার এবং রাষ্ট্রের মধ্যে আর সেই ধরনের তফাত নেই। সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠান বলতে যা বোঝানো যায়, সেখানে কিছু নিজস্ব আইন থাকবে, একটা অটোনমি থাকবে, সেভাবে চলবে। সেখানে আজকাল বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে যে ধরনের রিক্রুটমেন্ট হবে, পলিটিকস হবে, তা কাম্য নয়।

ইতিহাস সচেতনতাকে পাবলিক পলিসিতে পরিণত করা যায় কিনা। ইতিহাস নিয়ে নিশ্চয়ই একটা বিতর্ক হতে পারে। যারা গবেষণা করবেন তারা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই সেই আলোচনাটা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু কখনই রাষ্ট্র বলতে পারবে না, এটিই আমাদের একমাত্র ইতিহাস। সেজন্য আমি আসলে রাষ্ট্র কী ধরনের প্রতিষ্ঠান করতে পারে, যাতে হিস্টরিক্যাল প্রিজারভেশন হবে, সেখানে আমি রাষ্ট্রের উদ্যোগের চেয়েও বেশি জোর দিতে চাই নন-স্টেট ভ্যারিয়াস ইনস্টিটিউশন, লোকাল ইনস্টিটিউশনের ওপর। এছাড়া আমি বলব যে রাষ্ট্রেরও যেসব প্রতিষ্ঠান আছে যেমন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, জাদুঘর প্রভৃতি। তারা নিশ্চয়ই অর্থ পায়, কিন্তু তারা যে ধরনের প্রোগ্রাম করে তা অনেক ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। অল্পবয়সী ছাত্রছাত্রীদের যদি ওখানে আনতে হয় তাহলে ইতিহাসকে খুব আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরতে হবে। এজন্য বিভিন্ন রকম মিডিয়া থাকতে পারে, বিদেশে মিউজিয়ামে বিভিন্ন বয়সী লোকজনের জন্য বিভিন্নভাবে হয়, যাতে তা খুব আকর্ষণীয় হয়। কিন্তু আমাদের দেশে যারা কিউরেটর হিসেবে কাজ করছেন, মিউজিয়ামে দায়িত্ব পালন করছেন, তারা তো এটা নিয়ে চিন্তাই করেননি। মহাস্থানগড়ের মিউজিয়ামে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। এতে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। সেখানে মিউজিয়ামের চেয়ে মিউজিয়ামের পরিচালকের বাড়ি বেশি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। অথচ মিউজিয়ামটাই সুন্দরভাবে সুরক্ষিত নয়। নিশ্চয়ই আমাদের সমস্যা টাকা নয়। যাদের টাকা দেয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যেই সমস্যা। ইতিহাস, ঐতিহ্যকে খুব জীবন্ত, আকর্ষণীয় করতে হবে, যাতে শিশু-কিশোরদের আগ্রহী করে তোলা যায়। আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস খুব বড় সম্পদ।

পৃথিবীর খুব কম দেশই দেখাতে পারবে, বগুড়ার মতো একটা জায়গায় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে হাজার হাজার বছর ধরে ক্রমাদিক্রমে বাস করছে। আমরা এটা নিয়ে খুব গর্বিত যে এত হাজার বছরের একটা সভ্যতা এত বছর জীবন অতিক্রান্ত করতে হলে কী রকম রেজিলিয়েন্স প্রয়োজন এবং আমাদের তা আছে। কিন্তু এর সবকিছুই আমাদের কানেক্ট করতে হবে। এটা খুব ইন্টারেস্টিং এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এখানে শুধু সরকার নয়, অনেক লোককে সম্পৃক্ত করতে হবে। উদ্যোগও নিতে হবে। যেমন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সরকারি প্রচেষ্টায় হয়নি, বেসরকারি প্রচেষ্টায় অনেকদিন তারা এটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। যতদিন কমিউনিটিজ, অন্য লোকজন একটা উদ্যোগে যুক্ত না হয়, শুধু সরকারের হাতে ছেড়ে দিলে অনেক সময় ডেড ইনস্টিটিউশন হয়ে যেতে পারে। অতএব, আমার প্রাধিকার আমি দেখছি যে আমরা যদি ইতিহাসের সঙ্গে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যগুলো ভালো করে বোঝার চেষ্টা করি, বিশেষ করে আজকের প্রজন্ম যে মিডিয়া বোঝে, তার মারফতেই তাদের কাছে আকর্ষণীয় করা দরকার। আমি কোথাও দেখি না যে সেখানে লোকাল কোনো স্কুলের শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে, বরং ঢাকা থেকে যাচ্ছে। বগুড়ার স্কুল বা লোকজন কেন মহাস্থানগড়ে যাওয়া বা দেখার আগ্রহ পাচ্ছে না। হ্যাঁ, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদকে নানা গালাগাল দিতে পারি, কিন্তু ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট থাকার সময় ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারগুলো প্রকাশ হতো। সেখানে প্রতিটি জেলার, উপজেলার ইতিহাস থাকত। এখন ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারের ঐতিহ্য কি আমরা রাখছি? নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে আমি কম্বোডিয়ায় গিয়েছিলাম, তাদের ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আছে। তখন ১৯৯৪ সাল। তখন তাদের অর্থনীতি ধ্বংসপ্রায় হয়ে গেছে। কিন্তু আমি দেখলাম যেখানে জেনোসাইড হয়েছিল সেই স্থানটি সুন্দর করে প্রিজার্ভ করে রেখেছে এবং চাক্ষুষভাবে মানুষ দেখতে পাচ্ছে। মাথার খুলি পর্যন্ত তারা সংরক্ষণ করে রেখেছে। আমরা ১৯৭১ সাল নিয়ে, গণহত্যা নিয়ে এত কথা বলি, কিন্তু তাদের স্মৃতিতে এমন কোনো স্মৃতিস্তম্ভ কি করেছি, যেখানে অন্তত তাদের নামগুলো লিখে রেখেছি? অথচ তারা কঙ্কালগুলো পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রেখেছে। যখন গিয়েছিলাম তখন তাদের অর্থনীতি বিধ্বস্ত, কিন্তু তারা এসব বিষয় প্রিজার্ভ করে রেখেছে। আমাদের পুরাকীর্তিগুলো সংরক্ষণ করা খুব জরুরি। আমি বলব, পাবলিক পলিসি সরকারের ঘাড়ে না দিয়ে নন-স্টেট অ্যাক্টরস কমিউনিটিজ, বিভিন্ন পেশার লোকজন যদি এসব বিষয়ে আগ্রহী হন, তারা যেন এগিয়ে আসেন, তাতে বেশি নজর দেব।

. আদনান মোর্শেদ: এবার আবার . হোসেন জিল্লুর রহমানের কাছে যাব দ্বিতীয় প্রশ্ন নিয়ে। সেটি হলো, সারা পৃথিবীতে হেরিটেজ ট্যুরিজম একটা বড় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এটি অনেক রাষ্ট্রের অনত্যম প্রবৃদ্ধির চালকে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে হেরিটেজ ট্যুরিজম নিয়ে খুব একটা কথা বলতে দেখা যায় না, পত্রপত্রিকায় কিছু লেখালেখি ছাড়া। এটাকে আপনি কীভাবে নৃতাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এই যে পাবলিক ফোরামে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না, এটা কি বহুশাস্ত্রীয় অ্যাপ্রোচের অভাব

. হোসেন জিল্লুর রহমান: ধারণাগত কিছু বিষয়ে আসলে মন্তব্য করতে চাই। যেমন আদনান একটি প্রসঙ্গ তুললেন এবং আমাকেও প্রশ্ন করলেন, কেন নাগরিক সমাজে কোনো ঢেউ উঠল না? এটা নিয়ে কেন কোনো গণ আলাপ নেই? কারণ টিএসসি বা কমলাপুর রেলস্টেশন ঐতিহাসিক পটেনশিয়াল হেরিটেজ পয়েন্ট। প্রাত্যহিক অস্তিত্বের মধ্যে তাদের কোনো ছোঁয়া তৈরি হয়নি। সেজন্য আমার কাছে মনে হচ্ছে আদনানের গণ আলাপের আকাঙ্ক্ষার ধারণাটিতেই আমি একটু প্রশ্ন তুলতে চাই, চ্যালেঞ্জ করতে চাই। ধারণাই আসলে সমস্যা কিনা। আসলে দরকার কিছু মোটিভেটেড বা প্যাশনেট আলাপ। গণ আলাপের ধারণাটি আমরা বড় করছি রাজনৈতিক মহল থেকে। বাংলাদেশে আমি একটা অদ্ভুত বিষয় দেখি, আমরা নন-স্টেট অ্যাক্টর বলছি বটে, যখন নন-স্টেট অ্যাক্টর আরো কার্যকর হতে চায়, তখন বিভিন্ন অসহযোগিতামূলক মনোভাব দেখা যায়। নন-স্টেট অ্যাক্টরস বাংলাদেশে খুব ভালো কাজ করছে। কিন্তু তারা যখন আরো কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখার জন্য ধারণাগত পথ খোঁজে তখন পলিটিক্যাল সার্কেলের বিষয়গুলো বড় করে আসে। যেমন গণ আলাপের বিষয়টি। আমি নিশ্চিত যে গণ আলাপ দিয়ে আসলে ঐতিহ্য সংরক্ষণের কোনো কিছু হবে না। পৃথিবীর কোথাও গণ উদ্যোগে এটা হয়নি। একটি প্যাশনেট গ্রুপই ঐতিহ্য সংরক্ষণে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমি শেষ করব এভাবে যে গণ আলাপের বিষয়টি ভুলে যান, বরং আমাদের মনোযোগ দিতে হবে প্যাশনেট অ্যাক্টিভিস্ট আলাপে। কয়েকটি সার্কেল যদি গড়ে ওঠে, একটি কিছু করে দেখায়, কোনো একটি স্থাপনাও যদি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে রক্ষা করা যায়, তাও ভালো। হয়তো কমলাপুরের বিষয়টি একটি ভিন্ন গল্প। কমলাপুরের বিষয়টি বোধহয় আরেকবার বলা দরকার, কমলাপুরের ওখানে উন্নয়ন বনাম সংরক্ষণের কোনো সমস্যা নেই। সেখানে রেলওয়ের অধিকার অবৈধ আমি বলব। যখন রেলওয়ে জমি অধিগ্রহণ করেছিল, তখন রেলের উদ্দেশ্যেই করেছিল। আইন অনুযায়ী সেটি ওই উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করলে ফিরিয়ে দেয়ার কথা, যাদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছিল। তারা মূলত সেখানে ল্যান্ডলর্ড সেজে গেছে। ল্যান্ডলর্ড সাজার গল্পটিই আসলে কমলাপুরের। এটি উন্নয়ন বনাম সংরক্ষণের কোনো আদর্শিক সংঘাত নয়। ওই বিষয়টি আমাদের বোঝাটা দরকার। সেজন্যই প্যাশনেট অ্যাক্টিভিস্ট আলাপটি কীভাবে বিস্তার ঘটানো যায়, সেদিকেই মনোনিবেশ করাটা জরুরি।

[চলবে]

শ্রুতলিখন: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন