উন্নত দেশের জন্য উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলাও জরুরি

ড. মো. হাদিউজ্জামান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। দায়িত্ব পালন করছেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবেও। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে পড়িয়েছেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টাতে। নগর পরিবহন, যানজট, পরিবহন অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শামীম রাহমান

পৃথিবীর অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে করোনা মহামারী। মানুষের যাতায়াতের ধরনে কি কোনো পরিবর্তন লক্ষ করছেন?

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বেই রাস্তায় ট্রিপের সংখ্যা কমেছে। এর সুফলটা পেয়েছে উন্নত দেশগুলো। ইউরোপ-আমেরিকার প্রায় প্রত্যেক দেশের বড় শহরগুলোতে যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে উল্টোটা। এখানে ট্রিপ কমেছে ঠিকই, কিন্তু যানজট আর কমেনি। কারণ, আগে যারা নিয়মিত বাসে উঠতেন, পারতপক্ষে তাদের অনেকেই এখন ব্যবহার করছেন ব্যক্তিগত গাড়ি। নিজের গাড়ি না থাকলে শরণাপন্ন হচ্ছেন রিকশা, অটোরিকশা কিংবা রাইডশেয়ারে চলা মোটরযানের। রাস্তায় বাড়ছে ব্যক্তিগত আর অযান্ত্রিক গাড়ির চলাচল। সম্প্রতি বুয়েটে আমরা একটা গবেষণা করেছি, সেখানে করোনাকালে মানুষের যাতায়াতের ধরনে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, তা খোঁজার চেষ্টা করেছি। আমরা দেখেছি, উন্নত বিশ্বের মতো ঢাকায়ও ট্রিপের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু যানজট কমেনি।

ঢাকার যানজট নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এর পরও যানজট না কমে বরং বেড়েছে। সমস্যাটা কোথায়?

২০০৫ সালে ঢাকায় গাড়ির গড় গতিবেগ যেখানে ২০ কিলোমিটারের ওপরে ছিল, এখন তা পাঁচ-ছয় কিলোমিটারে নেমে এসেছে। সামনের পাঁচ-দশ বছরে গাড়ির গতিবেগ মানুষের হাঁটার গতিবেগের চেয়েও কমে আসবে। আমরা বিগত দিনে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলাম, আরো কয়েক লাখ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন পাইপলাইনে রেখেছি, তার ফল কি আমরা আসলেই পাচ্ছি? পাচ্ছি না। ঢাকার যে যানজট সমস্যা, সেটা আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। অবস্থা কিন্তু রাতারাতি হয়নি। আমরা যদি ৩০ থেকে ৪০ বছর পেছনে ফিরে তাকাই, দেখতে পাব দুর্বল পরিকল্পনার শুরুটা সেখান থেকেই। ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো লক্ষ্য ছিল কিনা, তা নিয়েই আমি সন্দিহান। একটি শহর যখন গড়ে তোলা হয়, তখন সেখানে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয় ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনাকে। কোথায় কী ধরনের অবকাঠামো হবে, তার একটা রূপরেখা ঠিক করে নেয়া হয় পরিকল্পনায়। কিন্তু আমরা আজো তেমন পরিকল্পনা করতে পারলাম না।

এর দায় আসলে কার?

আমার কাছে মনে হয়, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ সরকারের যে সংস্থাগুলো রয়েছে, তারা কখনো বিষয়টাকে অনুধাবন করতে পারেনি। যেকোনো মেগাসিটির একটা ডিমান্ড মডেল থাকে, যেটি বলবে সামনের দিনগুলোতে শহরের জনসংখ্যা কেমন হবে। সেই চাহিদার ভিত্তিতেই গড়ে তোলা হবে বিভিন্ন অবকাঠামো। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ঢাকার জন্য চাহিদা মাথায় রেখে কোনো ধরনের মডেল এখনো গড়ে ওঠেনি। দায়িত্ব ছিল নীতিনির্ধারকদের, যাতে তারা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।

যানজটের ক্ষতি কি শুধু অর্থনীতিতেই সীমিত?

ঢাকা শহরে যানজট সমস্যা বাড়ছে এবং এটা আরো বাড়বে। ১০ বছর আগেও যানজটের ক্ষতি আমরা যেটা প্রাক্কলন করতাম, তা বছরে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো ছিল। আমাদের মূল্যায়ন বলছে, সেটা এখন বছরে ৬৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সময়ে আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি ১০-১৫ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে। বেশির ভাগ সময় আমরা যানজটের অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ে কথা বলি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ক্ষতির ব্যাপ্তি আমাদের নগর জীবনের সর্বত্র। যানজট আমাদের পাবলিক হেলথ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এটা সামাজিক ইস্যুতেও পরিণত হয়েছে। যেহেতু যানজটের কারণে আমরা সড়কে বেশি সময় ধরে থাকছি, ফলে আমাদের প্রডাক্টিভিটি কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আমাদের যেসব ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি করার কথা অবসর সময়ে, সেটা আমরা করতে পারছি না। দীর্ঘক্ষণ যানজটে থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে পরিবারে ঠিকভাবে সময় দিতে পারছি না। এর প্রভাব পড়ছে পারিবারিক সামাজিক জীবনেও। যানজটে বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত জ্বালানি পুড়ছে। এতে পরিবেশের ক্ষতিও বেড়ে যাচ্ছে।

যানজট কমাতে মেট্রোরেল কেমন ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে?

মেট্রোরেল এমন একটা পরিবহন, যেটা শুধু নির্দিষ্ট করিডরেই চলবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত আমরা ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল বানাচ্ছি। স্টেশন ২০টা। চালুর পর স্টেশনগুলো রুট ব্যবহারকারীদের কেন্দ্রে পরিণত হবে। বলা হচ্ছে, একেকটি স্টেশনে সব সময় অন্তত পাঁচ হাজার মানুষের যাতায়াত থাকবে। স্টেশন থেকে বের হওয়ার পর কিংবা স্টেশনে আসতে গিয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থায় স্টেশনগুলোতে যানজট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। আর যানজট থাকলে মানুষ তখন চিন্তা করবে, মেট্রোর চেয়ে সাধারণ বাসই ভালো। তারা মেট্রো ব্যবহার করতে চাইবে না। সমন্বিত ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড অবকাঠামো গড়ে তুলতে না পারায় এশিয়া মহাদেশের অনেকগুলো দেশে মেট্রোরেলের মতো প্রকল্প কিন্তু এরই মধ্যে ব্যর্থ হয়েছে।

ঢাকায় ধরনের ব্যর্থতা এড়াতে করণীয় কী হতে পারে?

যেসব দেশে মেট্রো বা বিআরটি প্রকল্পগুলো সফল হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে দুটো বিষয় কাজ করেছে। একটা হলো গণপরিবহনকে প্রথমে শৃঙ্খলায় আনা। তারপর হলো অ্যাকসেসিবিলিটি। অর্থাৎ স্টেশনগুলোতে মানুষ যেন হেঁটে আসতে পারে। এতে স্টেশনগুলোকে যানজটমুক্ত রাখা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট বা টিওডি। এর মাধ্যমে মেট্রো বা বিআরটি স্টেশনকে কেন্দ্র করে অন্তত আধা বর্গকিলোমিটার এলাকায় মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা। স্টেশনের আশপাশে বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য বাসস্থান গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত আমাদের যে এমআরটি- নির্মাণ করা হচ্ছে, তার স্টেশনগুলোকে ঘিরে ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলা বলতে গেলে অসম্ভব, কেননা এসব এলাকায় আমরা এরই মধ্যে অনেক অবকাঠামো গড়ে তুলেছি, যেগুলো স্থানান্তর করা যাবে না। ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট না হওয়ায়, রুটে যত যাত্রী পরিবহনের প্রাক্কলন করা হয়েছিল, বাস্তবে তার চেয়ে কম হবে। ঢাকায় যে দুটি বিআরটি আরো চারটি মেট্রোরেল গড়ে তোলা হচ্ছে, সেগুলোতেও ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্টকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। তবে মেট্রোগুলোকে ঘিরে এখনো ধরনের উন্নয়ন সম্ভব।

মানুষের হাঁটার ওপর জোর দিতে বলছেন, কিন্তু ঢাকায় তো প্রয়োজনীয় ফুটপাতই নেই।

সিউল কিংবা নিউইয়র্কের মতো শহরের নীতিনির্ধারকরা এক সময় চিন্তা করেছিলেন সড়কের প্রশস্ততা বাড়ানোর। কিন্তু তারা এখন উল্টোপথে হাঁটছে। সড়ক থেকে জায়গা নিয়ে ফুটপাত তৈরি করছে। সবুজায়ন করছে। আমাদের ঢাকা শহরে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ। সমপরিমাণ মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করে। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে কম-বেশি শতাংশ। কিন্তু ব্যক্তিগত গাড়িগুলো রাস্তার ৪০-৫০ শতাংশ জায়গা দখলে রাখছে। মানুষের জীবনযাপন সহজ করাই যদি আমাদের উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হয়, তাহলে কেন আমরা ব্যক্তিগত গাড়িকে এত গুরুত্ব দিচ্ছি? নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা রয়েছেন, তাদের উচিত সড়ক থেকে জায়গা নিয়ে প্রশস্ত হাঁটার জন্য সুন্দর পরিবেশের ফুটপাত তৈরি করা। ঢাকার বেশির ভাগ ট্রিপই স্বল্প দূরত্বের। হাঁটার জন্য ভালো ফুটপাত পেলে মানুষ কিন্তু ফুটপাত দিয়ে হেঁটেই গন্তব্যে যাবে। এতে একদিকে যেমন সড়কের ওপর চাপ কমবে, তেমনি স্বাস্থ্যগত উপকারও পাবে ফুটপাত ব্যবহারকারীরা। পরিবেশ দূষণও কমে আসবে।

ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ের মতো অবকাঠামো মানুষের কতটা কাজে লাগছে?

ঢাকাকে ঘিরে একটা সুন্দর পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল, যা আমরা এরই মধ্যে নষ্ট করে ফেলেছি। আমরা মেট্রোরেল বানাচ্ছি, বাস র্যাপিড ট্রানজিট তৈরি করছি ভালো কথা। কিন্তু গণপরিবহনকে আমরা শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পারিনি। আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই, তারা কিন্তু সবার আগে একটা সুশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। গণপরিবহনগুলো বিআরটি মেট্রোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ফিডার সার্ভিসের মতো কাজ করে। গণপরিবহনগুলো পুরো নেটওয়ার্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। বিআরটি কিংবা এমআরটি আমরা করছি একটা নির্দিষ্ট করিডর ধরে। করিডরের বাইরে যেতে হলে মানুষকে তো কোনো না কোনো পরিবহন ব্যবহার করতে হবে। এটার জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হতে পারে উন্নত বাস ব্যবস্থা। পথচারী আর গণপরিবহনের কথা চিন্তা না করে কিন্তু আমরা ফ্লাইওভার আর এক্সপ্রেসওয়ে বানাতেই বেশি মনোযোগী। আমাদের আশপাশের দেশে অনেক উদাহরণ আছে, তারা কিন্তু ফ্লাইওভার ভাঙা শুরু করে দিয়েছে। আমরা তাদের কাছ থেকেও শিক্ষা নিতে পারছি না।

বাংলাদেশেও কি ফ্লাইওভারগুলো অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে?

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি আগামী ২০-২৫ বছরের মধ্যে ঢাকার ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়েগুলো ভেঙে ফেলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। কারণ, গণপরিবহনের চাহিদা কিন্তু সব সময়ই থাকবে এবং দিন যত যাবে চাহিদা ততই বাড়তে থাকবে। চাহিদার জন্য গণপরিবহন চলাচল উপযোগী রাস্তা বানাতে হবে। কিন্তু আমরা যেভাবে শহরকে গড়ে তুলেছি, তাতে নতুন রাস্তা বানানোর কোনো সুযোগ নেই। একটাই উপায় হতে পারে, ফ্লাইওভার এক্সপ্রেসওয়েগুলোকে ভেঙে প্রশস্ত রাস্তা করা।

দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকায় বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজির কথা বলা হচ্ছে। এই ব্যবস্থার সম্ভাবনা কেমন?

এটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ হতে পারে। তবে ব্যবস্থার সুফলটা পেতে সময় লাগবে। বিদ্যমান মালিকদের রাজি করিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজ প্রবর্তনের কাজটা চ্যালেঞ্জিং। তবে রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ করার পাশাপাশি সড়কে লেন ব্যবহারটা ঠিক করতে হবে। তা না হলে আমরা সুশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারব না। পাশাপাশি যেসব রুটে গণপরিবহন চলবে, সেগুলো থেকে ধীরে ধীরে অযান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কোন ধরনের গাড়ি কোন রাস্তায় চলবে, তার একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করতে হবে। আমরা বলছি, ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশ হয়ে যাব। উন্নত দেশের অনেকগুলো সূচক আছে, শুধু জিডিপি দিয়ে উন্নত দেশ হওয়া যায় না। রাস্তায় চলাচল করা গাড়ি দেখে, রাস্তা দেখে, রাস্তার যানজট কিংবা শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলা দেখলেই কিন্তু সহজেই বোঝা যায় দেশ উন্নত নাকি অনুন্নত। তাই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন সেসব বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন