জন্মনিবন্ধনের বাইরে এক কোটি শিশু

শিশু অধিকার সুরক্ষা ও সঠিক জনমিতিক নীতি প্রণয়নের অন্তরায়

রাষ্ট্রীয় পরিসীমায় নাগরিকের অধিকার প্রয়োজনীয় সেবাপ্রাপ্তিতে জন্ম-মৃত্যুর মতো ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরকারি নিবন্ধনভুক্ত থাকাটা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি এটি শিশুদের বেলায়ও সমানভাবে সত্য। এজন্য যথার্থভাবেই জাতিসংঘের শিশু অধিকার বিষয়ক কনভেনশনে জন্মের স্বল্পতম সময়ের ব্যবধানে একটি শিশুর নিবন্ধন নিশ্চিতের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সরকারি নিয়মেও জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নবজাতকের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে নিয়মটি যথাযথভাবে পরিপালিত হচ্ছে না। পাসপোর্টের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা জন্মনিবন্ধন সনদ আর জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করায় প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় সবাই জন্মনিবন্ধনের আওতায় এসেছেন। তবে শিশুদের, বিশেষ করে বিদ্যালয়ে ভর্তির আগে জন্মনিবন্ধনের প্রবণতা বেশ কম। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, আইনি বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও পাঁচ বছরের নিচে আনুমানিক এক কোটি শিশু নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছে। সরকারিভাবে নিবন্ধিত না হওয়ার মানে হলো তারা সরকার বা আইনের চোখে অদৃশ্য। ফলে আইনগত পরিচয়ের প্রমাণ ছাড়া তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনি সুবিধাসহ অন্য মৌলিক সেবা নিশ্চিত করা কঠিন। অন্যদিকে একই কারণে যৌন নিগ্রহসহ শোষণ-নির্যাতন, শিশু পাচার, বাল্যবিবাহ শিশুশ্রমে তারা অধিক অরক্ষণীয়। কাজেই অধিকারভিত্তিক সুরক্ষা নিশ্চিতে সব শিশুকে সরকারি নিবন্ধনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

বাস্তবতা হলো যে শিশু জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে দেশে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। প্রথমত, জন্মনিবন্ধনের ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতনতার ঘাটতি বিরাজমান। অনেক মা-বাবাই নিবন্ধনের গুরুত্ব যথাযথভাবে বুঝতে পারেন না। তারা সাধারণত ছয় বছর বয়সে ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তির সময় জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন। অনেকেরই কীভাবে শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে হয়, সে সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব আছে। বিশেষত নারী কিশোরী মায়েরা সেবার ব্যাপারে তেমন অবগত নন। এক্ষেত্রে প্রচার-প্রচারণা বাড়িয়ে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে শিশুর জন্মনিবন্ধনের ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, খরচ। নিবন্ধন ফি খুব একটা বেশি না হলেও দূরত্ব বেশি হওয়ায় প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সরকারি দপ্তরে এসে সনদ নেয়ার যাতায়াত খরচই অনেক নিম্ন আয়ের মা-বাবার জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ। তদুপরি অনেক ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি নেয়ারও অভিযোগ আছে। এটিও অভিভাবকদের অনাগ্রহের একটি কারণ। তৃতীয়ত, নিবন্ধনের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত জটিলতা হয়রানি আছে। এটি দূর করতে হবে। প্রক্রিয়াটি সহজতর, যতটা সম্ভব হয়রানিমুক্ত করতে হবে। চতুর্থত, কাগজভিত্তিক ইলেকট্রনিক নিবন্ধনের মধ্যে অধিক্রমণ, দ্বৈততা সামঞ্জস্যহীনতার সমস্যা প্রবল। কেউ হয়তো ঢাকার বাইরে থেকে নিয়েছে, কিন্তু নিবন্ধন সনদ হারিয়ে ফেলায় নতুন করে ঢাকা থেকে আবার নিয়েছে। এতে নিবন্ধনের সঠিক তথ্যটি পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই এসব সমস্যা নিরসন করে অভিভাবকদের শিশুর জন্মনিবন্ধনের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে হবে। আরেকটি বড় ইস্যু হলো, ঘরে শিশু প্রসবের আধিক্য। উন্নত দেশগুলোয় হাসপাতালভিত্তিক প্রসব ব্যবস্থা নিশ্চিতের কারণে জন্মের পর পরই প্রতিটি শিশুর জন্মনিবন্ধন করা যায়। ফলে ওইসব দেশে কাজটি তুলনামূলকভাবে সহজ। কিন্তু আমাদের দেশে ঘরে প্রসব হওয়া শিশুর রিপোর্টিং ম্যাকানিজম তৈরি হয়নি, যার জন্য অনেকেই নিবন্ধনের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের নেতৃত্বে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে এমনকি প্রত্যন্ত এলাকায়ও কীভাবে সব শিশুকে নিবন্ধনের আওতায় আনা যায়, তার উপায় অন্বেষণ জরুরি। 

জন্মনিবন্ধন ব্যক্তির জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় রাষ্ট্রের জন্য। জনসংখ্যার বয়সভিত্তিক হালনাগাদ তথ্য রাষ্ট্রের সঠিক নীতিনির্ধারণের জন্য খুবই জরুরি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জননিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়ে নীতিনির্ধারণের জন্য রাষ্ট্রকে সবসময়ই বয়সভিত্তিক জনসংখ্যার ওপর নির্ভর করতে হয়। হালনাগাদ তথ্য না থাকলে সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই সঠিক না- হতে পারে। তাই আধুনিক রাষ্ট্র জন্মনিবন্ধনের ওপর অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছে। আমাদেরও কাজটি যথাযথভাবে করা চাই। 

যথাসময়ে শিশুদের জন্মনিবন্ধন না হওয়ার পেছনে জন্মনিবন্ধন সনদের প্রায়োগিক ব্যবহারের অপ্রতুলতাও বড় মাত্রায় কাজ করছে। ২০১০ সাল থেকে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন হচ্ছে বটে, কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ যাত্রার এত বছর পরেও শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া এখনো মান্ধাতা আমলের পদ্ধতিতেই পরিচালিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তির বহুল ব্যবহার থাকলেও সমন্বিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআইকে তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় আনা হয়নি। ইপিআই কর্মসূচিকে তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় আনা হলে শুধু জন্ম নিবন্ধন সনদের নম্বর লিখেই শিশুদের সব মৌলিক তথ্য স্থানান্তর করে বিনিময়যোগ্য তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা যাবে, যা ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা ভবিষ্যতে জাতীয় জনসংখ্যা তথ্যভাণ্ডার গঠনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। জন্মনিবন্ধনকে অন্য সেবা ব্যবস্থার আবশ্যকীয় শর্তে পরিণত করা গেলে সব শিশুকে সরকারি নিবন্ধনের আওতায় আনা কঠিন হবে না। উন্নত দেশগুলো কীভাবে শতভাগ জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত করতে পেরেছে, সেই অভিজ্ঞতা অনুসরণপূর্বক সরকারের কার্যকর উদ্যোগ কাম্য।   

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন