পর্যালোচনা

ব্যাংকিং খাত কি এভাবেই চলবে?

ড. আর এম দেবনাথ

ব্যাংকিং খাতের ওপর প্রায়ই খবর থাকে। এতে যেমন তথ্য ও পরিসংখ্যান থাকে, তেমনি থাকে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য ও মন্তব্য। তাদের একাংশের মন্তব্য ও বিশ্লেষণ পাঠ করলে মনেই হয় ব্যাংকগুলোর দুর্দশার জন্য বহুলাংশে দায়ী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। তাদের অদক্ষতা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপের কারণে আজ ব্যাংকিং খাত সার্বিকভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। যত সমালোচনাই করা হোক না, যেকোনো অভিযোগের তীরটি থাকে পরিচালনা পর্ষদ এবং/অথবা ব্যক্তিগতভাবে পরিচালকদের দিকে। এসব পড়ে পড়ে একটা জনমতও তৈরি হয়ে গেছে। আমিও অনেকটা ওই দিকেই। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকটা খবরে আমার তালগোল পাকিয়ে গেছে। প্রথম খবরটি (২১.১০.২০) একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের, যাদেরকে আমরা লিজিং কোম্পানি বলে থাকি। এর নাম ‘বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেড’। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বলতে গেলে এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও কর্তৃত্ব সরকারের হাতে। এর একটি শক্তিশালী উপদেষ্টা পরিষদ আছে। এতে আছেন তিনজন মন্ত্রী, একজন উপদেষ্টা এবং একজন প্রতিমন্ত্রী। বণিক বার্তার খবরানুযায়ী, এই কোম্পানিটিতে বোর্ডে আছেন সাতজন সচিব। মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত এই কোম্পানি ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ’। খবরে প্রকাশ, এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৫৮৪ কোটি টাকা রেখে লিজিং কোম্পানিটির বারোটা বাজিয়েছেন। এ খবর নাকি বোর্ডের কেউ জানেন না। সমালোচকরা অবশ্য সরকারি ব্যাংকের বোর্ডের ক্ষেত্রে যা বলেন, সেই সুরে কথা বললে তো প্রশ্ন করতে হয়—তাদের অজান্তে কীভাবে এত টাকা দুর্বল কোম্পানিতে আমানত হিসাবে রাখা হয়? এর সঙ্গে কারা কারা জড়িত? বিষয়টি এখন ‘দুদকের’ মামলায়। তিন-চারজন মন্ত্রী ও সাতজন সচিব—খুবই জটিল বিষয় নিশ্চয়। বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেডের এই উদাহরণ সম্পর্কে কী ধারণা হয়? প্রতিষ্ঠানের কাজে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বোর্ডের দায়িত্ব-কর্তব্য কতটুকু, দৈনন্দিন কাজে তাদের হাত কতটুকু? এসব অনিয়ম-দুর্নীতিতে তাদের হাত কীভাবে সম্প্রসারিত? এতগুলো টাকা কীভাবে বোর্ডের অগোচরে এমন বাজে কোম্পানিতে গেল, যা এখন অনাদায়ী? তার অর্থ লোকসান। এখান থেকে প্রশ্ন ওঠে—প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বোর্ডই কি সবকিছু? দৈনন্দিন বিষয়ে বোর্ডের ‘হাত’ কতটুকু? বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আরো চারটি উদাহরণ দেব? এগুলো বণিক বার্তার খবর। খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে এ মাসের ১১ থেকে ১৪ তারিখের মধ্যে। এসব খবর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নয়। এগুলো ব্যাংকের ওপর। বলা বাহুল্য, দৈনিক বণিক বার্তা কর্তৃক চিহ্নিত চারটি ভালো ব্যাংকের খবর। ব্যাংক চারটি হচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড। আমরা রাষ্ট্রায়ত্ত এবং অনেক বেসরকারি ব্যাংকের বোর্ডের সদস্যদের নিয়ে নানা কথা বলি। তাদের অনভিজ্ঞতা, অদক্ষতা, অনিয়মে জড়ানোর কথাসহ নানা অপবাদে তারা জর্জরিত। বস্তুত ব্যাংকের পরিচালকদের সামাজিক অবস্থান এখন খুবই ‘নীচুতে’। কোনো ভদ্রলোক এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক হতে চান না। আজ চেয়ারম্যান হলে কাল বিদায়—এই হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। এমন একটা অবস্থার বিপরীতে আমাদের আলোচ্য চারটি ব্যাংকের বোর্ডের অবস্থা কী? এসব ব্যাংকের বোর্ডের পরিচালকদের নিয়ে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড সারা দেশে কেন, বিদেশেও প্রশংসিত। এই ব্যাংকে বিদেশী বিনিযোগ আছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদের মতো লোক কর্তৃক এটি প্রতিষ্ঠিত। তিনি নামকরা লোক দিয়ে এই ব্যাংক চালিয়েছেন। এখনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান একজন নামজাদা অর্থনীতিবিদ। তার কথা—মুনাফা লক্ষ্য নয়, গ্রাহকরা বাঁচুক। একথা বলার কারণ, তার ব্যাংকের লাভপ্রদতা ক্রমেই নিম্নমুখী। তাদের সাবসিডিয়ারিগুলো লোকসানে। বিখ্যাত ‘বিকাশ’-এর লোকসানই হচ্ছে ৬২ কোটি টাকা! ভাবা যায়? ঋণের ৪৫ শতাংশ ‘এসএমই’ খাতে এবং ১৮ শতাংশ ‘রিটেইল’ খাতে। এ দুটো খাত সম্পর্কে বাজারে নানা ধারণা বিদ্যমান। এমন একটা শক্ত ব্যবস্থাপনা-বোর্ডের অধীন ব্যাংক এখন ভালো করছে না। এটা আজকের বিষয় নয়, করোনা-পরবর্তী ঘটনা নয়। এর আগে থেকেই তা ঘটছে। এর পরে প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড। জাঁদরেল ব্যক্তির পরিচালনায় চলে এই ব্যাংক। পাঁচ বছর ধরে স্থবিরতা চলছে ব্যাংকটিতে। বড় বড় গ্রাহক ব্যাংক ছেড়ে দিচ্ছেন। আমানত ও ঋণের প্রবণতা নিচের দিকে। তারা ঋণ অবলোপন করছে। তাদের দুটো সাবসিডিয়ারি কোম্পানি লোকসানে। তার মানে কী? জাঁদলের বোর্ড থাকার পরও ব্যাংক চলছে না। তবে কি বলা যায়, বোর্ডই সবকিছু? তা বলা ঠিক নয়। তৃতীয় ব্যাংকটির কথা লোকমুখে। এর নাম ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড (ডিবিবিএল)। ডেবিট কার্ড, এটিএম, এজেন্ট ব্যাংকিং, রকেট সার্ভিস ইত্যাদি নতুন নতুন সফল প্রডাক্টের আবিষ্কারক এই ব্যাংক। খুবই ভালো বোর্ড। ব্যাংক চালায় নামকরা প্রধান নির্বাহীরা। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রযুক্তি প্রতিস্থাপনের ফলে ব্যাংক এখন সমস্যায়। তবে কি এসব নিম্নমানের যন্ত্রপাতি কারো হস্তক্ষেপে কেনা হয়েছিল? প্রায়ই ঘটছে এটিএম বিভ্রাট। ব্যাংকটির গ্রাহক সংখ্যা ৮৭ লাখ। দৈনিক বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের প্রদত্ত ঋণ গেছে কিছু গ্রাহকের কাছে। অর্ধেকই গেছে বস্ত্র ও পোশাক খাতে। ব্যাংকটির রেটিং করে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোম্পানি মুডি’স। তারা এবার তাদের ‘মান’ নিচে নামিয়েছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও পোশাক খাতের কারণে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক যা ঋণ দিয়েছে, তার ৭৯ শতাংশই ঢাকায়। গ্রামাঞ্চলে গেছে মাত্র আড়াই শতাংশ। ঠিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চিত্র। ২৪-২৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ২৯ জন গ্রাহকের কাছেই ৮ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। এই হচ্ছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের অবস্থা, করোনা-পরবর্তী ঘটনা নয়। এর আগে থেকেই এই পরিস্থিতি এবং ভালো বোর্ড ও ভালো প্রধান নির্বাহী থাকা সত্ত্বেও। এবার আসা যাক মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের কথায়। এই ব্যাংকের বোর্ডে আছেন দেশের স্বনামধন্য শিল্পপতিরা। এদের বিরুদ্ধে কারো কোনো কথা নেই। সবাই বরং সম্মানিত ব্যক্তি। স্কয়ার, এসিআই ও অ্যাপেক্সের মতো  কোম্পানির কর্মকর্তারা এই ব্যাংকের বোর্ডে। বলা চলে এর চেয়ে ভালো বোর্ড পাওয়া কঠিন। একসময় ব্যাংকটি ভালো করছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যাংকটির মূলধন, সম্প্রসারণ, সম্পদের মান কোনোটাই সন্তোষজনক নয়। গত পাঁচ বছরে ক্লাসিফাইড ঋণ বেড়েছে চার গুণ। ২০১৯ সালে ক্লাসিফাইড লোন ছিল ১ হাজার ২২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২০ শতাংশের মতো হবে। ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী বলেছেন, ‘ভালো ঋণগ্রহীতা চিনতে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ভুল ছিল। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ডিউ ডিলিজেন্সের অভাব ছিল। একই সঙ্গে ঋণগ্রহীতাদের মনিটরিং ও সুপারভিশনের ঘাটতি ছিল।’ বলা বাহুল্য, এই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা বাজারের সেরা বলে আখ্যায়িত। বোর্ড তো বটেই। তাহলে এর অবস্থা এমন কেন?

দেখা যাচ্ছে, ভালো-মন্দ বোর্ড নির্বিশেষে, ভালো-মন্দ প্রধান নির্বাহী (সিইও) নির্বিশেষে ব্যাংকের পারফরম্যান্সে বিশেষ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না। ভালো ভালো বোর্ডের ব্যাংকেও গ্রাহক নির্বাচনে ভুল হয়। ঋণ মনিটরিং ও সুপারভিশনে ঘাটতি হয়। সেসব ব্যাংকেও ঋণ কিছু লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। ঋণ কেন্দ্রীভূত হয় শহরাঞ্চলে। সেবা সম্প্রসারণে ভুল বিনিয়োগ হয়। সেখানেও দেখা যাচ্ছে, খারাপ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। প্রভিশনিংয়ের সমস্যা আছে। নিট মুনাফা নিম্নমুখী। কর্মচারীরা ‘ডিমটিভেটেড’। তাহলে কী দাঁড়াল? আমাদের ধারণা ছিল দক্ষ ও ভালো বোর্ড হলে, দক্ষ ও ভালো প্রধান নির্বাহী হলে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা এমন হতো না। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে ‘ভালো বোর্ড’ এবং ‘ভালো প্রধান নির্বাহী’ কোনো নিয়ামক উপাদান নয়। যদি হতো তাহলে বলা যেত সব বোর্ড বদল করে, সব নির্বাহী পরিবর্তন করে জাতীয় কোনো সংস্থার মাধ্যমে এসব গঠন করা হোক। না তার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তাহলে উপায়? ব্যাংকিং খাত কি এভাবেই চলবে? জানি না। তবে বর্তমান পরিস্থিতির একটা ভালো ব্যাখ্যা দরকার। এর ওপর পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হওয়া দরকার। এসব সাপেক্ষে কিছু কথা বলতে চাই।

ব্যাংকিং খাত আজ যে জায়গায় এসেছে, তা ৪৮-৪৯ বছরের ফল। সব কয়েকটি ব্যাংক মিলে ৪৮-৪৯ বছরে মোট বোধহয় এক-দেড় লাখ কোটি টাকার মতো শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের জন্ম দিয়েছে। জন্ম দিয়েছে শত শত সফল উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীর। সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিয়েছে বেশ কিছুসংখ্যক খারাপ উদ্যোক্তা, যারা ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয় না। আজ যে উন্নয়নের চিত্র দেখা যায়, তার মধ্যে ব্যাংকের অবদান অনস্বীকার্য। তবে এরই মধ্যে ‘ভালো-মন্দ’ বোর্ড, ‘ভালো-মন্দ’ প্রধান নির্বাহী দেশের জন্য, অর্থনীতির জন্য অনেক খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এর সংখ্যা নিরূপণ করা কষ্টকর। তবে কিছু উদাহরণ দেয়া যায়। তারা ‘পারসোনাল গ্যারান্টি’, ‘করপোরেট গ্যারান্টির’ ওপর ভর করে বিনা সিকিউরিটিতে বড় বড় ঋণগ্রহীতা সৃষ্টি করেছেন। তারা বিনা জামানতে অতিরিক্ত ঋণ পেয়ে মাত্রাতিরিক্ত হারে সম্প্রসারণের কাজ করেছেন। এর ফল ভোগ করছে চিনি শিল্প, সিমেন্ট শিল্প, ইস্পাত শিল্প, বস্ত্র শিল্প ইত্যাদি। এর বোঝা দিনে দিনে বড় হবে। ব্যাংকার ও ব্যাংক মালিকরা বড় বড় গ্রাহকের স্বার্থ দেখতে গিয়ে ‘লোন অ্যাগেইনস্ট ইমপোর্টেড মার্চেন্ডাইজ’ (এলআইএম) নিরুৎসাহিত করে জামানতবিহীন ‘ট্রাস্ট রিসিট’ (টিআর) লোনের ব্যবস্থা করেছেন। এই ‘টিআর’-এর টাকা ঋণগ্রহীতারা পরিশোধ না করে জমি, শেয়ার কিনেছেন, ব্যাংক কিনেছেন এবং ওই টাকাকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণে পরিণত করেছেন। মনে হয় না ওইসব টাকা কোনো দিন উদ্ধার হবে। কারণ ব্যবসায় বড় কথা ‘ক্যাশ জেনারেশন’। আমাদের বড় বড় গ্রাহক ‘করোনা পূর্ববর্তী ‘ক্যাশ’-এর অভাবে ভুগছিলেন। ‘ক্যাশ’ জেনারেট না করতে পারলে ব্যাংকের টাকা ফেরত আসার কোনো সম্ভাবনা নেই; ব্যাংকাররা জামানতযুক্ত প্লেজড লোন নিরুৎসাহিত করে হাউপো লোনে জোর দিয়েছেন, যেখানে জামানতের বালাই নেই। তবে একথাও বলতে হবে, বাংলাদেশে জামানতের সঙ্গে ঋণ পরিশোধের কোনো সম্পর্ক নেই। ঋণ পরিশোধে কেউ ব্যর্থ হলে ব্যাংকাররা তার ঋণ পুনঃতফসিল করে দিয়ে ঋণগ্রহীতাকে সাহায্য করতেন। তারা এর যথেচ্ছ অপব্যবহার করে এই পুনঃতফসিল ব্যবস্থাকে নষ্ট করেছেন। এটি নষ্ট করে তারা ‘ঋণ পুনর্গঠন (লোন রিকনস্ট্রাকশন)’ নামে একটি ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, সেই ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। কভিড-১৯ এসে এসব নিয়ম-অব্যবস্থা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে একটা ‘দম’ দিয়েছে। ব্যাংক মালিকরা তাদের স্বার্থে ‘বোর্ড’-এ তাদের নিয়ন্ত্রণ শক্ত করেছেন, সরকারের কাছ থেকে সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। সঞ্চয়কারীদের স্বার্থের বিপরীতে ‘নয়-ছয়’ সুদনীতি কার্যকর করেছেন। দেখা যাচ্ছে, কভিড-১৯ এসে তাদের সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের বাঁচানোর কথা সরকারের। এই অজানা শত্রু যেসব ব্যবসা ও শিল্পের ক্ষতি করেছে, তাদের ঋণের ব্যবস্থা করা, প্রভিশনিং শিথিল করা, শ্রেণীবিন্যাসকরণের নীতি শিথিল করা, ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা দীর্ঘায়িত করা—এসবই করা উচিত ছিল সরকারের। কিন্তু দেখা ও শোনা যাচ্ছে, যারা করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত নয়, আগে থেকেই যারা ‘লণ্ড-ভণ্ড’ অবস্থায়, তারাই ঋণের সব সুবিধা পাচ্ছে। করোনা-পূর্ববর্তী অবস্থায় যাদের কোনো ‘ক্যাশ জেনারেশনের’ অবস্থা ছিল না, তাদেরও সুবিধা দেয়া হচ্ছে। সিদ্ধান্তটি সঠিক কিনা, তা অবশ্যই বিচার করে দেখা দরকার। যে মৃত, তাকে ঋণ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ‘মৃতরা’ সুবিধা পাচ্ছে বেশি, কারণ তারা প্রভাবশালী। ছোট ও মাঝারিরা কিছুই পাচ্ছে না। এই খবর প্রতিদিনের। আর যেসব শিল্প ও ব্যবসা একটু সুবিধা পেলে বাঁচতে পারত, তারা হন্যে হয়ে ঘুরছে ব্যাংকের দুয়ারে দুয়ারে। এখানে ‘ভালো-মন্দ’ বোর্ডের ব্যাংক সবই আছে। বস্তুত বাংলাদেশের বর্তমান ব্যাংকিং অবস্থার জন্য ‘ভালো বোর্ডের’ ব্যাংক দায়ী নয়, দায়ী সেই সব বোর্ডের বিরুদ্ধে হরদম অভিযোগ করা হয় তারা। ব্যাপারটি এমন নয়। দায়দায়িত্ব সবাইকে ভাগ করে নিতে হবে। শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ এবং ভালো ঋণ সবটাই যেন ‘কস্ট অব ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজ’ না হয়।


ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন